• facebook
  • twitter
Thursday, 20 March, 2025

ফিরছেন মহা‘নায়ক’

৫৯ বছর পর পুনরায় বড় পর্দায় দেখা যাবে ‘নায়ক’। ছবির ডিজিটাইজড ভার্সানটি আজ থেকে কলকাতা ছাড়াও মুক্তি পাচ্ছে দেশ জুড়ে। তার আগে নির্দেশক সন্দীপ রায়, অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় ও চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বললেন অবন্তী সিনহা।

‘নায়ক’ ছবিটির প্রসঙ্গ উঠলেই এক আশ্চর্য শিহরণ হয়। কারণ দু’জন লার্জার দ্যান লাইফ ব্যক্তিত্বের নাম এই ছবির সঙ্গে যুক্ত। একজন হলেন ছবির স্রষ্টা সত্যজিৎ রায়, অন্যজন ছবির নায়ক অর্থাৎ সর্বকালের মহানায়ক উত্তম কুমার।

১৯৬৬ মুক্তি পেয়েছিল ‘নায়ক’। ছবিটি অনেকেই টিভিতে দেখে থাকবেন। কিন্তু এবার এ ছবি দেখার সুযোগ পাচ্ছেন বড় পর্দায়! কারণ ৫৯ বছর পর পুনরায় বড় পর্দায় মুক্তি পেল ছবির ডিজিটাইজড ভার্সান। আজ থেকে কলকাতা ছাড়াও ছবিটি দেখা যাবে মুম্বাই, দিল্লি, বেঙ্গালুরু, পুনে, হায়দরাবাদ এবং চেন্নাই-সহ, দেশের নানা প্রক্ষাগৃহে। কলকাতায় ‘নায়ক’ দেখতে হলে আসতে হবে দক্ষিণ কলকাতার প্রিয়া-তে। ছবিটির এই ২কে ভার্সান পুনরুদ্ধার করা হয়েছে এবং ইংরেজি সাবটাইটেল-সহ তা প্রদর্শিত হচ্ছে।

‘নায়ক’ -এর কেন্দ্রীয় চরিত্র ম্যাটিনি আইডল অরিন্দম মুখার্জি। বিমানের টিকিট না পেয়ে যিনি একরকম বাধ্য হয়েই, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার নিতে রওনা হয়েছেন ট্রেনে। এদিকে মদ্যপ অবস্থায় তাঁর অভব্য আচরণের খবরটি সেদিনই প্রকাশিত হয়েছে কাগজে। ফলে সহযাত্রীদের সামনে তিনি যারপরনাই অস্বস্তিতে। হঠাৎই কামরায় পরিচয় হয় অদিতি সেনগুপ্ত নামের এক মহিলা সাংবাদিকের সঙ্গে, যে-চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন শর্মিলা ঠাকুর।

চোখ মিথ্যা বলে না। অদিতি লক্ষ্য করেন, সচেতনভাবেই নায়ক তাঁর চোখদুটিকে কালো সানগ্লাসের আড়ালে ঢেকে রেখেছেন। যাতে তাঁর অন্তরের হদিশ প্রকাশ্যে না আসে। অথচ গোটা ছবি জুড়ে এরপর বিভিন্ন মুহূর্তে ঘটনার অভিঘাতে অরিন্দমকে চশমা খোলা পরা করতে দেখা যায়। যেন বাইরের মানুষটার ভেতরের সত্তাটা বেরিয়ে আসতে চায়, কিন্তু প্রতিবার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় তাঁর নায়কচিত ‘ইমেজ’। গোটা যাত্রাপথে তরুণ বুদ্ধিদীপ্ত ওই মহিলা সাংবাদিকের কাছে তাঁর জীবনের নানান ঘটনা উন্মুক্ত করে ফেলেন নায়ক। এ যেন এক আত্মবিশ্লেষনের জার্নি। একের পর এক পরত সরিয়ে বেরিয়ে আসে তাঁর হতাশা, ভুল, নিরাপত্তাহীনতা এবং কিছুটা অনুশোচনাও। উজ্জ্বল ইমেজ খসে পড়ে, যেন রক্তমাংসের অরিন্দম প্রকাশ করে ফেলেন তাঁর মানবিক দিকগুলো। এ ছবি শুধু অরিন্দম মুখার্জিকেই আয়নার সামনে দাঁড় করায় না- একই রকম প্রসঙ্গিক হয়ে ওঠে সাফল্যের শীর্ষ স্পর্শ করা প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রেই।

ছবি জুড়ে অরিন্দমের জীবনের টুকরো টুকরো ঘটনার ফ্ল্যাশব্যাক এমনকী দুঃস্বপ্নের কথাও প্রকাশ পায় দর্শকদের সামনে। অদিতির চোখে যে-অরিন্দম ধরা পড়েন, তিনি এক নিঃসঙ্গ নায়ক, যাঁর জীবনে খ্যাতি, যশ, ঐশ্বর্য থাকার পরেও- অতৃপ্তি আর শূন্যতার ভাগটাই বেশি। দিল্লিগামী ট্রেন প্রান্তিক প্ল্যাটফর্ম ছুঁয়ে ফেলার ঠিক আগে, অদিতি সিদ্ধান্ত নেন এই সাক্ষাৎকার তিনি প্রকাশ করবেন না। সব সত্য প্রকাশ্যে আনতে নেই। অরিন্দম তাঁকে বলেছিলেন, অভিনেতা আসলে ছায়ার জগতের মানুষ। দর্শকদের সামনে খুব বেশি তাঁর অস্থিমজ্জা প্রকাশিত না-হওয়াই ভালো। সুতরাং রহস্যের আড়ালটুকুই থাক না হয় ‘নায়ক’-কে ঘিরে।

চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘ নায়ক-এর ফিরে আসা তো খুব আনন্দের খবর! আমরা তো বড়ো পর্দায় সত্যজিতের সেরা ছবিগুলোকেই দেখলাম না। শুধু দেখলাম ‘গুগাবাবা’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’, ‘সোনার কেল্লা’ আর ‘আগন্তুক’। কিন্তু যে-জন্য তিনি সত্যজিৎ রায় হয়েছেন, ১৯৫৫ সালের সেই ‘পথের পাঁচালি’ বা ১৯৬৪ সালের ‘চারুলতা’- সেই ফিল্মগুলো কোথায়! সেগুলোও এখনই রেস্টোর করা উচিত। এত নিখুঁত বাংলা ছবি আর হয়নি। এই ছবিগুলো তো টিভির ফরম্যাটে তৈরি হয়নি। সেলুলয়েডে, অন্য অ্যাপারচারে ২৪ ফ্রেম প্রতি সেকেন্ড ফরম্যাটে শুট করা হয়েছিল। টিভিতে দেখলে সেটা ২৫ ফ্রেম প্রতি সেকেন্ডে দেখা যাচ্ছে। তাতে ডিসটর্টেড হয় ইমেজ। লোকে সেটা ধরতে পারেন না ছবির গল্পে মনোযোগ আটকে থাকে বলে। কিন্তু সত্যজিতের যে-ঈশ্বরপ্রতিম ক্যামেরা-চালনা, সুব্রত মিত্রের সাহায্যে, বা ঋত্বিক ঘটকের যে-অবিশ্বাস্য ওয়াইড অ্যাঙ্গেল শটগুলো, তা বড়ো পর্দায় না দেখলে এই প্রজন্ম তাঁদের বুঝবে কীভাবে!’

‘নায়ক’ ১৯৬৬ সালে বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে জিতেছিল একাধিক পুরস্কার। ‘স্পেশাল জুরি অ্যাওয়ার্ডের’ পাশাপাশি ‘শ্রেষ্ঠ ফিচার ফিল্ম’ এবং ‘শ্রেষ্ঠ কাহিনি ও চিত্রনাট্য’ বিভাগেও পুরস্কার জেতে। পরের বছর ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পায়।

‘এই ছবিতে তো উত্তম কুমার তাঁর নিজের অভিনয় বিশ্লেষণ করেছেন। যে-দৃশ্যে দুর্গাদাস বন্দ্যেপাধ্যায় তাঁকে বলছেন, তোমরা আজকাল এত মিনমিন করে সংলাপ বলো কেন- তখন উত্তম বলছেন, আজকালকার অভিনয় এটিই। অর্থাৎ থিয়েটারের মতো উচ্চগ্রামে সংলাপ বলতে হয় না। সিনেমা এমনই একটা সাউন্ড মেকানিজম, এটা উত্তমকুমারই একমাত্র বুঝতেন- যেখানে ফিসফিস করে কথা বললেও শেষ দর্শক অবধি সকলেই শুনতে পাবে। উত্তমকুমারের ওই ‘লো কী’ অভিনয়, তিনি যে কত বড়ো একজন প্রতিভা,তা এই প্রজন্ম এই ছবি দেখলে বুঝবে।
এই রেস্টোরেশনের কাজ নিঃসন্দেহে একটি বিপ্লব। টেকনোলজির সাহায্যে হারিয়ে যেতে বসা ক্লাসিক ছবিগুলি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব।

সঞ্জয়বাবুর মতে, ‘এই যে মার্টিন স্কর্সেসে একের পর এক সত্যজিৎ আর ঋত্বিকের ছবি আমেরিকায় রেস্টোর করছেন, শিবেন্দ্র সিং দুঙ্গারপুরের সহযোগিতায়- এটা দৃষ্টান্তমূলক। ৬০-এর দশকে যে-সব ছবি হয়েছিল, সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন বা ঋত্বিক ঘটকের ছবি শুধু নয়- অজয় কর, নির্মল দে বা তরুণ মজুমদারের ছবিও যদি ফিরিয়ে আনা যায়, সেটা খুবই আনন্দের হবে।’