সৈয়দ হাসমত জালাল
বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এমন অনেক অভিনেতা এসেছেন যাঁরা দর্শককে মুগ্ধ করেছেন, সময়কে ছুঁয়ে গেছেন, আবার সময়ের সঙ্গে হারিয়েও গিয়েছেন। কিন্তু এমন কয়েকজন শিল্পী আছেন যাঁরা কেবল তাঁদের সময়েরই প্রতিনিধি ছিলেন না, বরং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এক অনন্য আসনে থেকে গিয়েছেন। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এমনই এক নাম উত্তমকুমার। তাঁকে বলা হয় ‘মহানায়ক’— একটি অভিধা যা কেবল তাঁর জনপ্রিয়তা নয়, বরং তাঁর শিল্পীসত্তা, সাংস্কৃতিক প্রভাব এবং বাংলা চলচ্চিত্রকে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়ার স্বীকৃতি। উত্তমকুমার ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের রূপকথার নায়ক। তাঁর উপস্থিতি, অভিনয়, কণ্ঠস্বর, আচার-আচরণ, সবকিছুই একদিকে সিনেমাকে দিয়েছে এক নতুন সংজ্ঞা, অন্যদিকে দর্শকের কল্পনা ও আবেগকে ভরিয়ে দিয়েছে রোমান্টিসিজমে। তিনি একাধারে ছিলেন বাণিজ্যিক ছবির প্রাণভোমরা, আবার শিল্পধর্মী সিনেমারও একজন শ্রেষ্ঠ অভিনেতা। ফলে বাংলা চলচ্চিত্রে তাঁর অবস্থান বোঝাতে গেলে কেবল নায়কোচিত ব্যক্তিত্ব বা জনপ্রিয়তা দিয়ে তা ব্যাখ্যা করা যায় না; বরং তাঁকে বুঝতে হয় একটি যুগের প্রতীক হিসেবে।
Advertisement
উত্তমকুমারের আসল নাম ছিল অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়। জন্ম ৩ সেপ্টেম্বর, ১৯২৬ সালে কলকাতায়। ছোটবেলা থেকেই তিনি সংস্কৃতিমনস্ক পরিবারে বড় হয়েছিলেন। গান-বাজনা, নাটক, অভিনয়— সবকিছুর সঙ্গেই ছিল তাঁর আত্মীয়তা। তবে পেশাদারভাবে চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করা ছিল অনেকটা কাকতালীয়। তাঁর প্রথম দিকের কয়েকটি ছবি বক্স-অফিসে খুব একটা সাড়া ফেলতে পারেনি। তিনি বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন, কখনও অভিনয় নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছেন। কিন্তু নিজের পরিশ্রম, ধৈর্য ও অভিনয়শৈলীকে শাণিত করার মাধ্যমে ধীরে ধীরে তিনি নিজের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিলেন। শেষপর্যন্ত ১৯৫০-এর দশকে এসে তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন।
Advertisement
বাংলা সিনেমার ইতিহাসে এক অদ্ভুত কাকতালীয় ঘটনা হলো— একই সময়ে দু’জন অভিনেতা-অভিনেত্রীর আগমন, যাঁরা যৌথভাবে একটি যুগের সৃষ্টি করেছিলেন। সুচিত্রা সেন ও উত্তমকুমার— এই জুটি বাংলা চলচ্চিত্রকে দিয়েছে এক অনন্য রোম্যান্টিক মাত্রা। ‘অগ্নিপরীক্ষা’ (১৯৫৪) ছবি দিয়ে শুরু হয়েছিল এ জুটির জাদু। এরপর প্রায় দু’দশক ধরে তাঁদের জুটি পর্দায় রোমান্স, আবেগ, বেদনা আর সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে ওঠে। ‘হারানো সুর’, ‘সপ্তপদী’, ‘চাওয়া পাওয়া’, ‘সাগরিকা’— এই সব ছবিগুলি শুধুই হিট হয়নি, বরং দর্শকের হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছে। সুচিত্রা-উত্তম যুগের প্রভাব এতটাই গভীর ছিল যে, তখনকার তরুণ-তরুণীরা তাঁদের জীবনকে গড়ে তুলতে চাইতেন ওই চরিত্রগুলির মতো। তাঁদের পোশাক, প্রেমের ধরন, মেলামেশা, এমনকি সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এই জুটির প্রভাব পড়েছিল।
উত্তমকুমারের অভিনয়ের মূল শক্তি ছিল তাঁর স্বাভাবিক ভঙ্গি ও কণ্ঠস্বরের আবেগময়তা। তিনি কখনও অতি-নাটকীয় হয়ে উঠতেন না; বরং সহজ-সরল, অন্তর্মুখী, আবেগঘন সংলাপ উচ্চারণের মধ্য দিয়েই দর্শককে আবিষ্ট করতেন। রোমান্টিক চরিত্রে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। প্রেমিক চরিত্রে তাঁর সেই নরম দৃষ্টি, গম্ভীর কণ্ঠস্বর ও আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গি বাংলা চলচ্চিত্রের দর্শকের মনে আজও অম্লান।
‘নায়ক’, ‘চৌরঙ্গী’, ‘ঝিন্দের বন্দী’— এসব ছবিতে দেখা যায় কীভাবে তিনি জটিল মানসিক অবস্থাকেও অনায়াসে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। উত্তমকুমার কেবল রোমান্টিক বা সিরিয়াস চরিত্রেই নয়, কমেডির ক্ষেত্রেও ছিলেন দক্ষ। তাঁর অভিনয়ের ভঙ্গিমায় ছিল সহজাত হালকা রস, যা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আনন্দ দিত সব ধরনের দর্শককে।
১৯৫০ থেকে ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত বাংলা চলচ্চিত্রে বাণিজ্যিকভাবে সবচেয়ে সফল নাম ছিল উত্তমকুমার। তখনকার প্রযোজক ও পরিচালকরা জানতেন, উত্তমকুমার থাকলেই ছবি ব্যবসায় লাভজনক হবে। এমনকি একটা প্রবাদই চালু হয়েছিল— ‘উত্তম মানেই হিট’। এই প্রবাদ কেবল মজার ছলে বলা হতো না; এটি বাস্তবিক অর্থেই প্রযোজক-পরিচালকরা অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা বোধ করতেন।
অনেকের ধারণা ছিল, উত্তমকুমার কেবল বাণিজ্যিক সিনেমার নায়ক। কিন্তু তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, শিল্পধর্মী সিরিয়াস চরিত্রেও সমান দক্ষ। ১৯৬৬ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ ছবিতে তিনি অভিনয় করেছিলেন একজন সুপারস্টারের চরিত্রে, যিনি বাইরের সাফল্যের আড়ালে ভেতরে ভেতরে আত্মদ্বন্দ্বে জর্জরিত।
এই ছবিই প্রমাণ করে, তিনি কেবল জনপ্রিয় নন, বরং বিশ্বমানের অভিনেতা। অন্যদিকে, ‘চৌরঙ্গী’ ছবিতে তাঁর চরিত্রটি যেন সমাজবাস্তবতার চমৎকার প্রতিফলন। আবার ‘ঝিন্দের বন্দী’ ছবিতে একাধিক চরিত্রে অভিনয় করে তিনি তাঁর বহুমাত্রিক শৈল্পিক নৈপুণ্য দেখিয়েছিলেন। এই সব ছবিই প্রমাণ করে, বাংলা চলচ্চিত্রে উত্তমকুমারের অবস্থান কেবল ‘তারকা’ নয়, বরং ‘শিল্পী’ হিসেবেও সর্বোচ্চ আসনে।
উত্তমকুমার কেবল সিনেমার চরিত্রই নির্মাণ করেননি, তিনি এক প্রজন্মের চিন্তাধারাকেও প্রভাবিত করেছিলেন। প্রেম, ভালোবাসা, সম্পর্কের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছিল তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলি। পোশাক-আশাক, চুলের স্টাইল, কথা বলার ধরন—সবই মানুষের কাছে অনুকরণীয় হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের কাছে তিনি ছিলেন এক স্বপ্নপুরুষ।
১৯৮০ সালে হঠাৎ প্রয়াণের আগে পর্যন্ত উত্তমকুমার ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের অবিসংবাদিত নায়ক। তাঁর মৃত্যুর পর সংবাদপত্র ও গণমাধ্যম তাঁকে যেভাবে স্মরণ করেছিল, তাতেই প্রতীয়মান হয় যে, তিনি কেবল একজন অভিনেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন সমগ্র বাঙালির আবেগের কেন্দ্রবিন্দু। তাঁর জন্যই বাংলা চলচ্চিত্রে সেই প্রথম জন্ম হয়েছিল ‘মহানায়ক’ শব্দটির। এই উপাধি আজও অন্য কারও ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়নি।
উত্তমকুমারের মৃত্যুর পরও বাংলা চলচ্চিত্রে তাঁর প্রভাব আজও অব্যাহত। আজকের অভিনেতারা তাঁকে তাঁদের আদর্শ হিসেবে দেখেন। টেলিভিশন ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তাঁর সিনেমা দেখানো হয় বারবার, আর নতুন প্রজন্মও তা উপভোগ করে। গবেষকরা বাংলা সিনেমার ইতিহাস লেখার সময় আলাদা গুরুত্ব দেন উত্তমকুমার অধ্যায়কে ।
বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে উত্তমকুমার কেবল একজন নায়ক নন; তিনি একটি যুগের প্রতীক, একটি সংস্কৃতির রূপকার। সে কারণেই তাঁর অবস্থান অনন্য, অতুলনীয় ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি ছিলেন রূপোলি পর্দার রোমান্সের সম্রাট, আবার ছিলেন মানুষের অন্তর্জীবনের কণ্ঠস্বর। বাংলা চলচ্চিত্রের প্রতিটি অধ্যায়ে উত্তমকুমারের ছায়া রয়েছে— কখনও উজ্জ্বল সূর্যের মতো, কখনও স্থির নক্ষত্রের মতো। তাঁর নাম উচ্চারিত হয় শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও আবেগ নিয়ে। তিনি আজও বাংলা চলচ্চিত্রের চিরন্তন ‘মহানায়ক’।
Advertisement



