অনন্য সত্যজিৎ

সত্যজিৎ রায়ের সুবিশাল কাজের পরিধির এক ক্ষুদ্র বৃত্তান্ত।

Written by Sukhen Biswas Kolkata | May 2, 2019 5:26 am

সত্যজিৎ রায়

অনেক পরিচিতিতে সমৃদ্ধ সত্যজিৎ রায়।আবার দেখা গেছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অনেক পরিচিতিকে ম্লান করে দিয়েছে।সঙ্গীতকার,চলচ্চিত্রকার,চিত্রনাট্যকার,আলঙ্কারিক,লেখক এই রকম সব বিশেষণে তাঁকে ভূষিত করা গেলেও সত্যজিতের প্রথম এবং শেষ পরিচিতি চলচ্চিত্র পরিচালক।ভারতের একমাত্র অস্কারজয়ী কখনও প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকের লেখা নিয়ে,কখনও বা নিজের কাহিনি চিত্রনাট্যের উপর ভর করেই সিনেমা বানিয়েছেন।কিন্তু কখনওই তিনি বাণিজ্যকে সর্বস্ব করে সিনেমা তৈরি করেননি।তাই তার সব ছবিতেই আছে রুচিশীল নান্দনিক ভাবনা।

তিনি মােট আটাশটি ফিচার ছবি করেছেন।তথ্যচিত্র বানিয়েছেন পাঁচটি।দূরদর্শনের জন্য তিনটি।এছাড়া অন্যের ছবিতে বিজ্ঞাপন চিত্রে সত্যজিৎ কখনও চিত্রনাট্যকার,কখনও বা ধারাভাষ্যকার হিসেবে কাজ করেছেন। বিভূতিভূষণের কাহিনিই সত্যজিতের প্রথম পছন্দ।একথা অনেকে বলে থাকেন।কিন্তু ইতিহাস বলে বিভূতিভূষণ নয়,রবীন্দ্র কাহিনির দ্বারাই প্রথম সত্যজিৎ ছবি করার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন।কারণ ১৯৪৬ সালে ডি.জে. কিমারে কাজ করার সময়ই তিনি ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসের চিত্রনাট্য লিখেছিলেন।কিন্তু কোনও কারণে সেটি সম্ভব না হওয়ায় তাঁকে ভাবায় ‘আম আঁটির ভেঁপু’ গ্রন্থের অলঙ্করণ।এরই ফলশ্রুতি ‘পথের পাঁচালী’ ছবি।

বিভূতিভূষণের উপন্যাসটা পড়লে অপু-দুর্গার যে অনাবিল স্বপ্নময়তা পাওয়া যায়,সেটা ছবিতে কিন্তু একদম নেই।এক সাক্ষাৎকারে আমাকে চিদানন্দ দাশগুপ্ত বলেছিলেন-
“এটা ইতালীয় নিওরিয়ালিজমের প্রত্যক্ষ প্রভাব। ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসে ছিল এক কোমল বাস্তবতা।অনাবিল স্বপ্নময়তা। সত্যজিৎ ছবি তৈরির সময় সাহিত্যের ওপর থেকে স্বপ্নময়তার পাতলা স্বচ্ছ মােড়ককে তুলে ফেলেন।তার বদলে সত্যিকারের রূঢ় বাস্তবতাকে ধরেছেন তিনি।উপন্যাস থেকে ছবি তৈরির ক্ষেত্রে বিভূতিভূষণকে ছাপিয়ে গেছেন সত্যজিৎ|”
ছবির পরিচালক যখন কাহিনিকারকে ছাপিয়ে গল্পের শেকড় টেনে বের করে,তখনই সেই ছবি হয়ে যায় ইতিহাস।১৯৫৫-তে তৈরি হওয়া ‘পথের পাঁচালী’ তাই এখন ইতিহাস।সত্যজিৎ সিনেমার প্রয়ােজনে যেসব ঘটনা,চরিত্র ইত্যাদি রাখা প্রয়ােজন মনে করেছিলেন ‘পথের পাঁচালী’তে সেটাই রয়েছে।আবার প্রয়ােজনে অনেক ঘটনা,চরিত্র সংযােজনও করেছেন।ইন্দির ঠাকরুণের বেশি সময় ধরে উপস্থিতি সেই কথাই বলে। ‘পথের পাঁচালী’তে সত্যজিৎ মূল উপন্যাসের উনত্রিশ পরিচ্ছেদের কিছুটা পর্যন্ত নিয়েছেন।ছবিতে যতটা নেওয়া হয়েছে,বাদ গেছে তার অনেক বেশি।যেমন ইন্দিরের শ্বশুরবাড়ি,নতুন বউ সর্বজয়ার ঘর-সংসার বা হরিহরের পূর্বপুরুষদের কাহিনি,নীলকুঠির মাঠ,আতুরি বুড়ি,নরােত্তম দাস প্রমুখের কথা।ইন্দিরা ও দুর্গার ট্র্যাজেডি ধরে অপুর মতাে এই ছবিতে অপরাজিত সত্যজিৎও।‘অপরাজিত'(১৯৫৬)ছবিতেও কিন্তু বিভূতি উপন্যাসের স্বপ্নময়তা নেই, চিহ্নিত হয়েছে সর্বজয়ার সঙ্গে অপুর মধুর অথচ নির্মম সম্পর্কের স্বরূপ।’পথের পাঁচালী’ উপন্যাসে ‘অক্রুর সংবাদ’ থেকে ‘অপরাজিত’ উপন্যাসের নবম পরিচ্ছেদের ঘটনাসমূহ এই ছবিতে স্থান পেয়েছে।সত্যজিৎ অনেক প্রসঙ্গ সরাসরি বাদ দিয়েছেন।যেমন লীলা প্রসঙ্গ,বেনারসে সর্বজয়ার রাঁধুনি,নির্মলা প্রসঙ্গ,অখিলবাবুর মেসের বর্ণনা ইত্যাদি।এছাড়াও পরিমার্জিত হয়েছে কিছু ঘটনাবলী।যেমন বাের্ডের পরীক্ষার অপু জেলার মধ্যে প্রথম হলেও সত্যজিৎ দ্বিতীয় করেছেন।কলা নয়, ছবিতে অপু বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে গেল। সর্বজয়ার মৃত্যুর পর মনসাপােতা গ্রামে শ্রাদ্ধ করার পরিকল্পনা করলেও ছবিতে সে দাদুকে জানিয়েছে মাতৃশ্রাদ্ধ করবে কালীঘাটে।দুটো ছবিতেই বিভূতিভূষণ ও সত্যজিতের অপুর মধ্যে বড্ড দুরত্ব লক্ষণীয়।
সত্যজিতের ‘অপুর সংসার’(১৯৫৯)-এ পাওয়া গেল বিভূতিভূষণের অপুকে।অপরাজিত উপন্যাসের শেষাংশ নিয়েই এর চিত্রনাট্য তৈরি হয়েছিল।এখানেও সত্যজিৎ উপন্যাসের ঘটনাবলীকে অন্যভাবে সাজিয়েছেন। অপুকে তিনি সম্পূর্ণরূপে নগরকেন্দ্রিক করেছেন।ফলে মনসাপােতায় নয়,অর্পণা ও অপুর ঘর সংসারের
ছবি দেখা যায় কলকাতায়।উপন্যাসের পুলু ছবিতে কিন্তু বিলেত ফেরত ইঞ্জিনিয়ার।রাজশাহির জেলে থাকার ঘটনা যদি সত্যজিৎ এই ছবিতে রাখতেন,তবে বােধহয় অপুর কাছে পুলুর বিশ্বাসযােগ্যতা অনেকটাই খাটো হত।অপুর স্কুলে কাজ করার প্রসঙ্গ তাে একদমই নেই ছবিতে।তাঁর লেখা উপন্যাসের পাতাগুলােও একে একে মহাকালে বিসর্জন দিয়েছেন সত্যজিৎ|অপু অপর্ণার দাম্পত্য প্রেমের করুণ পরিণতি হলেও জীবনবোধে উজ্জ্বল এই ছবিটি।অপুর বিবাহপর্ব তো বাঙালি জীবনের শাশ্বত অঙ্গ।বিশেষ করে বিস্তীর্ণ ল্যান্ডস্কেপে কাজলকে কাঁধে নিয়ে অপুর এগিয়ে চলা।
রবীন্দ্রনাথ একসময় বলেছিলেন যে,চলচ্চিত্রের একটা নিজস্ব ভাষা দরকার।’পথের পাঁচালী’ ছবি থেকেই সেই ভাষা পেল বাংলা সিনেমা।চিত্রনাট্য এমনই একটি জিনিস যেখানে সাহিত্য গুণ থাকবে,আবার তা পড়ে সিনেমার স্বাদ পাওয়া যাবে।সত্যজিৎ যখন চিত্রনাট্য রচনা করতেন,তখন সংলাপের পাশেই ছবি আঁকতেন, নােটেশন তৈরি করতেন।ছোট ছোট স্কেচ দিয়ে বুঝিয়ে রাখতেন দৃশ্যগুলাে।বলা যায় চিত্রনাট্য তৈরির সময়ই তিনি ছবি তৈরির প্রায় নবুই ভাগ কাজ সেরে রাখতেন।ফলে অনেক সময় দেখা গেছে সাহিত্যের বর্ণনার সঙ্গে সিনেমার অনেক অমিল।সেটা চরিত্র,বিষয়,সঙ্গীত প্রভৃতির ক্ষেত্রেই হতে পারে।অনেক ধ্রউপদী ছবির ক্ষেত্রেও এটা হয়েছে।সাহিত্যিক সহ সমালােচকদের এইরকম অনেক অভিযােগই সত্যজিৎকে একাধিকবার শুনতে হয়েছে।
বাংলা সিনেমার পরিচালকদের শিল্পবােধের অভাব রবীন্দ্রনাথকে ভীষণভাবে পীড়িত করেছিল।এই বিষয়ে নাট্যাচার্য শিশির ভাদুড়ির অনুজ মুরারী ভাদুড়িকে একটি চিঠিও লিখেছিলেন তিনি।এই চিঠিতেই তিনি সিনেমার শিল্পরূপ সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন,সেটা এইরকম—ছায়াচিত্রের প্রধান জিনিসটা হচ্ছে দৃশ্যের গতিপ্রবাহ। এই চলমান রূপের সৌন্দর্য ও মহিমা এমন করে পরিস্ফুট করা উচিত,যা কোনও বাক্যের সাহায্য ব্যতীত আপনাকে সম্পূর্ণ সার্থক করতে পারে।সুরের চলমান ধারায় সঙ্গীত যেমন বিনা বাক্যেই আপন মাহাত্ম্য লাভ করতে পারে,তেমনই রূপের চলৎপ্রবাহ কেন একটা স্বতন্ত্র রসসৃষ্টিরূপে উন্মােচিত হবে না?হয় না কেবল সৃষ্টিকর্তার অভাব এবং অলস জনসাধারণের মূঢ়তায়,তারা আনন্দ পাবার অধিকারী নয় বলেই চমক পাবার নেশায় ডােবে।’পথের পাঁচালী’ ছবিতে রবীন্দ্রনাথ লিখিত সিনেমা শিল্পরূপ হবার অত্যাধুনিক ব্যাখ্যা দ্বারাই যেন সত্যজিৎ চালিত।
সত্যজিৎ বা অন্যান্য সার্থক পরিচালকদের হাতে বাংলা সিনেমা স্বতন্ত্র স্বাবলম্বী শিল্প হয়েছে,তা রবীন্দ্রনাথের দান বললে বিশেষ বাড়িয়ে বলা হবে।’পথের পাঁচালী’ ছবিতে দরিদ্রতা আছে।কিন্তু কখনওই তা দেখা বা ভাবের জগতে আচমকা আঘাত হানেনি।মানবিক বােধের সহ্যের শেষ সীমা লঙ্ঘন করেনি।মানবিক রুচির দৈন্য প্রকাশ করেনি।বলা যায় এই নান্দনিক বােধ সত্যজিৎ,রবীন্দ্রনাথ থেকেই পেয়েছিলেন।শুধু ‘পথের পাঁচালী’ নয়, সব ছবিতেই সব কাজেই এই নান্দনিক বােধের প্রকাশ দেখা যায়।চিদানন্দ দাশগুপ্ত এক সাক্ষাৎকারে আমাকে বলেছেন-
”… সত্যজিতের গােটা মানসিকতা রবীন্দ্রযুগ থেকেই তৈরি।রবীন্দ্র ভাবজগতের বাইরে তিনি একদমই যেতে পারেননি।যখনই যাবার চেষ্টা করেছেন,তখনই হোঁচট খেয়েছেন।”
পরের ছবিতে অপু নয়,কিন্তু বিভূতিভূষণ আছেন।‘অশনি সংকেত'(১৯৭৩)ছবির শুরুতেই প্রকৃতির আনন্দময়তার মধ্যে আকাশজুড়ে কালাে মেঘের ঘনঘটা।সত্যজিৎ যুদ্ধ-দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতাকে ধরতে বিভূতিভূষণের কাহিনিকে ধীরে ধীরে বিকশিত করেছেন।মূলত হাহাকারের তীব্রতাকে ধরতে তিনি রঙের ব্যবহার করেছেন।তাই তাে গঙ্গা ও অনঙ্গ ছবির শেষ দৃশ্যে নিজস্ব নিরাপত্তা হারিয়ে মৃত্যু মিছিলের সামনে দাঁড়িয়েছে।
‘পথের পাঁচালী’ বা ‘অপরাজিত’র মতাে এই ছবিতেও সহজ সরল মানুষের দল পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হয়ে সহজভাবে বাঁচার জন্যে পথে বেরিয়েছে।ত্রয়ী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে শুধু বিভূতিভূষণের কাহিনিকেই ছবি করার জন্য বাছেননি সত্যজিৎ।তারাশঙ্করের দুটি কাহিনি নিয়েও ছবি করেছিলেন।সে দুটি ‘জলসাঘর’(১৯৫৮)ও ‘অভিযান’(১৯৬২)।‘জলসাঘর’ নাম শুনে মনে হতে পারে বাণিজ্যিক ছবির ফর্মুলায় এটি নির্মিত।কিন্তু সত্যজিতের হাতে চিত্রনাট্যটি সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয়ের কাহিনি হয়ে গেল।এই ছবি তৈরিরও একটি কাহিনি আছে।তারাশঙ্কর বাঙালি জমিদারদের ইতিহাস পড়ে ‘জলসাঘর’ গল্পটি লিখেছিলেন।কিন্তু,সত্যজিৎ প্রথমদিকে ‘জলসাঘর’-এর আদলে কোনও রাজবাড়ি খুঁজে পাননি।অবশেষে মুর্শিদাবাদের নিমতিতার অন্দরমহল দেখে পছন্দ করেছিলেন।বিষয়টা জানতে পেরে তারাশঙ্কর ফোনেই সত্যজিৎকে বলেছিলেন—
“আরে অদ্ভুত ব্যাপার।আমি নিজে নিমতিতায় কখনও যাইনি।কিন্তু বাঙালি জমিদারদের এক ইতিহাসে চৌধুরীদের কাহিনী পড়েছি।আমার গল্পের মূল চরিত্র তাে গান-বাজনা পাগল ওই উপেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীকে নিয়েই।”
আর ‘অভিযান’ ছবির মূলে আছে ট্যাক্সি চালকের দুঃসাহসিক অভিযান ও তার পরিণতি।প্রসঙ্গক্রমে এসেছে বিভিন্ন পেশার পুরুষ নারীর প্রসঙ্গ।তবুও প্রতীকী ব্যাপারটা যেন ছবি দেখার শেষেও মনে গেঁথে থাকে। নরসিংহের ক্রাইসলার গাড়ি যেন রূপান্তরিত হয়েছে চেতন মানুষে।ফলে ফাঁদের সামনে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেছে।পাহাড়ের মাথায় বসে থাকা শকুনই যেন বলে দিয়েছে সামনে বিপদ।এখানে প্রশ্ন ছবিতে সত্যজিৎ কী কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দিয়েছে,নাকি বেঁচে থাকার আনন্দকে গুরুত্ব দিয়েছে?অবশ্যই দ্বিতীয়টা।কারণ যে গাড়ি অনেক করেও স্টার্ট নেয়নি,সেই গাড়ি চোরাচালান থেকে নরসিংহের মত বদল হওয়াতেই স্টার্ট নিয়েছে।‘পরশপাথর’(১৯৫৭)ছবিতে সত্যজিৎ তাঁর বাবার ননসেন্স রাইমকে সুন্দরভাবে ধরেছেন।যার ফলে ছবির প্রধান চরিত্র পরেশবাবুর ছড়াটি প্রবাদের মতাে হয়ে গেছে
“হলদে সবুজ ওরাং ওটাং
ইট পাটকেল চিৎপটাং
ধর্মতলা কর্মখালি মুস্কিল আসান উড়েমালী।”
এদেশে সংস্কৃতি যে টাকা দিয়ে কেনা যায়,সেটা সত্যজিৎ ব্যঙ্গের সঙ্গে পরিবেশন করেছেন।তাই এই ছবিতে বঙ্গ সংস্কৃতি ধারার প্রসঙ্গ শ্লেষে ব্যঞ্জিত।পরশুরামের আরও একটি কাহিনির চিত্রায়ণ ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’(১৯৬৫)ছবিতে।মূলত ‘মহাপুরুষ’,অংশেই পরশুরামের স্বচ্ছন্দ বিচরণ।তথ্যচিত্রের ভঙ্গিতে সত্যজিৎ এখানে প্রেমের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন।পাশাপাশি বিরিঞ্চি বাবার আসল রূপও ধরা পড়েছে।তবে সবটাই যেন সাদামাটা ভাবে।’কাপুরুষ’ অংশটি প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাহিনি।এখানে তিনটি চরিত্রের আস্ত জটিলতা ছবিটিকে অসাধারণ করেছে।
‘দেবী'(১৯৫০)ছবির কাহিনি সত্যজিৎ নিলেন প্রভাতকুমার মুখােপাধ্যায়ের কাছ থেকে।নিমতিতার রাজবাড়িতে এই ছবিরও শুটিং হয়েছিল।সত্যজিৎ এখানে ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘােষণা করেছেন।এক্কেবারে শৈল্পিক ভাষায়।ছবির প্রয়ােজনে তিনি এখানে নিজের লেখা একটি গানও ব্যবহার করেছেন ‘এ বারে তােরে চিনেছি মা।’
‘তিনকন্যা’(১৯৬১) ছবিতে সত্যজিৎ রবীন্দ্র ভাবনার প্রতিফলন ঘটালেন।‘পােষ্টমাস্টার’, ‘মণিহারা’ ও ‘সমাপ্তি’র তিন নারী রতন,মণিমালিকা আর মৃন্ময়ীই তিন কন্যা।‘পােষ্টমাস্টার’ পর্বে তাে ছবির প্রয়ােজনে একটি পাগল চরিত্র নিয়ে এসেছেন।প্রথম থেকেই ছবিতে রতনের সঙ্গে বাবুর সম্পর্কের স্বরূপ ইঙ্গিত করেছেন তিনি।কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছবিতে সে যেন দাসী হয়ে গেছে।মণিমালাকে আপাত দৃষ্টিতে অলংকারলােভী মনে হলেও তার মধ্যে নান্দনিক বােধ আছে।সমাপ্তির মৃন্ময়ী তাে নারীত্বের মধুর বিকাশ।কিশােরীর বােধ থেকে বিয়ের পিঁড়িতে বসেও চঞ্চল থেকে মুক্ত হতে পারেনি সে।শেষে বিরহই তার মনে মধুরতা এনে দিয়েছে।
রবীন্দ্র কাহিনি অবলম্বনে সত্যজিতের আরও একটি ছবি ‘চারুলতা’(১৯৬৪)।’নষ্টনীড়’ গল্পে দেখা গেছে চারুর জীবন তৃষ্ণাকে আড়ালেই রেখেছেন রবীন্দ্রনাথ।কিন্তু সত্যজিৎ তাকে সকলের সামনে তুলে ধরলেন।গল্পের শুরুতে দেখা গেছে চারু স্বামীসুখ বঞ্চিত,অবহেলিত নারী।ভূপতি কখনও বােঝেনি ভালােবাসারও একটা আলাদা দিক আছে।তাই চারুর কাছে অমল এত প্রিয়। সত্যজিৎ সাহিত্যের এইসব জায়গায় ভাষা দিয়েছেন। ফলত চারু ও অমলের সম্পর্ক দর্শকরা সরাসরি দেখেছে।স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বােঝাতে সত্যজিত একটি নৈশ দৃশ্য এনেছেন।আবার চারু ও অমলের মনের মিল দেখানাের জন্যেই এসেছে বঙ্কিমপ্রীতি(আনন্দমঠ প্রসঙ্গ)। রবীন্দ্রনাথের মতাে সত্যজিৎও ভূপতিকে  চারু অমল সম্পর্কের এজেন্ট বানিয়েছেন।নারী চরিত্রের শৈশব কৈশাের,তারুণ্য সবই চারুর মধ্য দিয়ে দেখিয়েছেন সত্যজিৎ।প্রেম,বিশ্বাস,নিষ্ঠুরতা,হতাশা সব মিলেমিশে সঙ্গীতের মতাে হয়ে গেছে ‘চারুলতা’য়।সত্যজিতের ফিল্মি ভাষায় রবীন্দ্রনাথের চারুলতা অনেক বেশি জীবন্ত হয়েছে।তাই বােধহয় ‘চারুলতা’ ছবির বিজ্ঞাপনে সত্যজিৎ লে-আউট করে লিখেছিলেন— ‘সত্যজিৎ রায়ের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পকীর্তি’।
রবীন্দ্র কাহিনির আরও একটি সংযােজন ‘ঘরে বাইরে’ (১৯৮৪)।ছবিটি স্বদেশী ভাবনার উপরেই চিত্রায়িত। স্বদেশী আন্দোলনের নেতিবাচক দিককে কোনওদিনই সমর্থন করেননি তিনি।ফলে ছবিটির শুরুই হয়েছে আগুন দিয়ে।শেষে বিমলার সিঁদুরের টিপ মুছে গেছে কপাল থেকে,রঙিন শাড়ি পাল্টে হয়েছে সাদা থান। নিখিলেশ কিন্তু তত্ত্ব ঝেড়ে ফেলে মানুষের মধ্যে থেকেই নিজেকে পার করেছে।সত্যজিৎ উপন্যাসকে টপকে নিখিলেশ – বিমলার ঘরে সন্দীপকে নিয়ে এসেছেন।অর্থাৎ যুগের প্রয়ােজনে নিয়ম ভেঙেছে সন্দীপ।তাই ঘরের বউকে বাইরে বের করিয়ে সত্যজিৎ ছবিটিরও নামকরণ করেছেন ‘ঘরে-বাইরে’।
ক্লাসিক কাহিনি নিয়ে তৈরি সত্যজিতের আরেকটি বিখ্যাত ছবি ‘মহানগর’(১৯৬৩)।নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘অবতরণিকা’ গল্পের মূল কাহিনি থেকে অনেকটাই সরে ছবি বানিয়েছিলেন তিনি।গল্পে সুব্রত(স্বামী) ছিল প্রধান চরিত্র। কিন্তু সত্যজিৎ করলেন আরতিকে (স্ত্রী)। ছবিটি কিন্তু মােটেও নারীমুক্তির নয়।বরঞ্চ বাড়ির সকলকে সঙ্গে নিয়ে একসঙ্গে চলার।তাই একটি সংকটেই শেষ পর্যন্ত আরতি সুব্রত পরস্পর পরস্পরের কাছে এসেছে। মহানগরের(কলকাতা) রাস্তায় দুজনেই বেরিয়েছে কাজের সন্ধানে।“গণশত্রু’র ডাক্তারের মতাে আরতির ঋজুতা শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছে।
‘চিড়িয়াখানা’(১৯৫৭) ছবিতে প্রচলিত ভাবনা থেকে সরে এলেন সত্যজিৎ রায়।এটি ছিল শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গােয়েন্দা কাহিনি।ব্যোমকেশ বক্সির রহস্য উদঘাটন মােটেও গতানুগতিকতাকে ছাড়িয়ে যায়নি। ফলে ছবির শেষে অপরাধী চিহ্নিত করার বিষয়টি বড় একঘেয়েমি মনে হয়েছে।এই ছবিতে সত্যজিতের নিজের লেখা একটা গান ‘ভালােবাসার তুমি কি জানাে’ ব্যবহৃত।
চিড়িয়াখানা ছবি দর্শকদের গােয়েন্দা রস দিতে ব্যর্থ হলেও নিজের লেখা দুটো গােয়েন্দা কাহিনিতে কিন্তু সত্যজিৎ সার্থক।সেই দুটি ‘ সােনার কেল্লা’ (১৯৭৪) ও ‘জয় বাবা ফেলুনাথ ‘ (১৯৭৮)।দুটি ছবির কাহিনিই গােয়েন্দা গল্প আকারে সন্দেশ- এ প্রকাশিত হয়েছিল।ফেলু মিত্তির ব্যোমকেশের সার্থক উত্তরসুরি হলেও এই ছবি দুটিতে ফেলুদা ব্যোমকেশকে ছাড়িয়ে গেছে।সােনার কেল্লা  ছবিতে জাতিস্মর তত্ত্বকে টপকে মুখ্য হয়েছে গােয়েন্দারস।সত্যজিৎ যে কখনওই পরজন্মে বিশ্বাস করতেন না , তা অনুমান করা যায় ‘নায়ক’ ছবিতে জ্যোতি ও অরিন্দমের কথাবার্তায় আর কমিক রিলিফ হিসাবে লালমােহনবাবু আলাদা মাত্রা এনেছে ছবিতে।‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবিতে তাে হেঁয়ালি,চুরি,গােয়েন্দা রস,খুন-খারাপি সব একাকার হয়ে গেছে। ভারতীয় সংস্কৃতি বিকৃত হচ্ছে,দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে এই ব্যাপারটা সত্যজিৎ একেবারেই মেনে নেননি।তাই ধর্মের আড়ালে গড়ে ওঠা পাপকে ফেলুদা শাস্তি দিয়েছে।মগনলালের শাস্তি আসলে গােয়েন্দাগিরির নতুন মজাও বটে।
সত্যজিৎ রায়ের একই ঘরানার ছবি মূলত তিনটি।’অরণ্যের দিনরাত্রি’(১৯৭০),’প্রতিদ্বন্দ্বী’(১৯৭০) ও ‘সীমাবদ্ধ ’ (১৯৭১)। প্রথম দুটির কাহিনীকার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়,শেষেরটির শংকর।তিনটে ছবিই সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর নান্দনিক রূপ।
 সমসাময়িক জীবন যন্ত্রণা,বিশেষ করে যুবক-যুবতিকে যেভাবে দ্বিধায় ফেলে দেয় তারই বলিষ্ঠ চিত্ররূপ ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’।উপন্যাস থেকে অনেকটাই সরে এসেছিলেন সত্যজিৎ।কারণ নর নারীর নগ্ন নাচ সুনীলের উপন্যাসে ছিল।কিন্তু ছবিটিতে সত্যজিৎ নগ্নতার বদলে যুবকদের উদ্দাম নাচ দেখিয়েছেন ঠিকই,তবে সেটা জয়া-অপর্ণাদের কাছে। উপন্যাসে যুবকদের নিরুদ্দেশ যাত্রাকেও সত্যজিৎ চালিত করেছেন অভিষ্ট পথে।
‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ তাে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সিদ্ধার্থর লড়ে যাওয়ার গল্প।শেষে সত্যজিৎ চিরদিনই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন।কিন্তু কখনওই ধ্বংসাত্মক দিককে গ্রহণ করেননি,তার ইতিবাচক মন নকশাল আন্দোলনের ভাবাবেগকে স্পর্শ করলেও সত্যজিতের অপূর্ব মুন্সিয়ানায় কলকাতার সবকিছুই যেন রূপান্তরিত হয়েছে  সিদ্ধার্থর প্রতিদ্বন্দ্বী।আর এখানেই ছবিটির সার্থকতা।প্রতিদ্বন্দ্বীর বিপরীত মেরু যেন সীমাবদ্ধ।কারণ এই ছবির নায়ক শ্যামলেন্দু জীবনে প্রতিষ্ঠা পাবার জন্যে নিজের আদর্শকেও জলাঞ্জলি দিতে চেয়েছে।ন্যায়নীতি, আদর্শ বা আন্তরিকতা নয়,স্বাধীনতা পরবর্তীকালে মানুষের জীবন ভাবনা ছিল চাকরির মধ্যে সীমাবদ্ধ।তাই শেষ দৃশ্যে শ্যামলেন্দু কোম্পানির ডিরেক্টর হয়ে সিঁড়ি  উপরে ওঠার সময় একমাত্র সঙ্গী হয়েছে তারই পায়ের শব্দ।
এই পর্বের আরও একটি ছবি ‘জনঅরণ্য'(১৯৭৫)। শংকরের কাহিনি নিয়ে সত্যজিতের দ্বিতীয় ছবি।এখানে যেন সত্যজিৎ নির্মম সমালােচকের ভূমিকায়।ক্ষয়ে যাওয়া কলকাতার নগর জীবনের ছবিকে তিনি রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করেছেন।সামনে রেখেছেন সােমনাথকে।এই ছবিতে দুর্ভিক্ষ,হাহাকার, উদ্বাস্তু সবই আছে।কিন্তু সত্যজিৎ দেখাতে চাইলেন কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করে আমরা অসাঢ় হয়ে যাচ্ছি , তা ক্রমশই আমাদের জীবনে ভয়াবহতাই নিয়ে আসছে।সত্যজিৎ ছবিতে যেন তারই প্রতিবাদ করলেন।এরই সঙ্গে দুটো ছবি করে নিলেন সত্যজিৎ।একটি মুন্সি প্রেমচাঁদের লেখা ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ী ’ (১৯৭৭) এবং ইবসনের কাহিনি  অবলম্বনে ‘গণশত্রু’ (১৯৮৯)|প্রথম ছবিটিতে অযােধ্যার ক্রমপতনকে ছবিতে যেভাবে দেখানাে হয়েছে,তাতে সত্যজিৎ ইতিহাসকে চেপে গেছেন বলেই সমালােচকরা মনে করেছেন।এই ছবিতে রাজ বীরত্বের থেকে পুরনাে লখনউয়ের ছবি,চমৎকার মনে হয়েছে।দ্বিতীয় ছবিতে তিনি নিপুণভাবে ইবসনের বিদেশিয়ানা খসিয়ে দেশি ইমেজ তুলে ধরেছেন।কারণ মন্দিরের চরণামৃত খেয়ে অসুস্থ হওয়ার ব্যাপারটা পশ্চিমবাংলারই কোনও গ্রামের ঘটনা।মনে হয়েছে ছবিতে সততার সঙ্গে নােংরা রাজনীতির দ্বন্দ্ব এই ছবিতে স্বচ্ছ।মানবিক অবক্ষয়,ধর্মীয় সংস্কার,বিজ্ঞান বিমুখতা সবকিছুতেই শেষ পর্যন্ত জয়ী ডাক্তার গুপ্ত ,সত্যজিৎও।
ভুত, রূপকথা মিলিয়ে-জুলিয়ে সত্যজিতের আরও দুটো ছবি ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন'(১৯৬৯) এবং ‘হীরক রাজার দেশে ’ (১৯৮০)।প্রথমটির কাহিনিকার ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশাের রায়চৌধুরী।পরেরটি সত্যজিৎ নিজে।প্রথম ছবিতে সত্যজিৎ অনেক নতুন চরিত্র এনেছেন।আমলকির রাজা,হাল্লার মন্ত্রী,বরফি,ভুতের রাজা প্রমুখ। আর গুপী বাঘা তাে এখানে নতুন রূপে উপস্থাপিত।ছবিতে গানের অসাধারণ ব্যবহার সমসাময়িক সমাজজীবনে নতুন মাত্রা এনেছে।সত্যজিৎ এখানে দশটা গান ব্যবহার করেছেন।সবই তাঁর নিজের লেখা। ফলে ভূতে-রূপে-সঙ্গীতে অসাধারণ ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’।হীরক রাজার দেশে ছবিতে রাজা সপার্ষদ প্রমুখের অন্তরালে হীরক রাজার শয়তানি ধরা পড়েছে।কারণ তার গান,সমালােচনা,শিক্ষা,কৃষক, শ্রমিক শিল্পী শিক্ষক কাউকেই সে পছন্দ করে না। যে তার স্তুতি করে তাকেই সে ভালােবাসে।আসলে সত্যজিৎ এর , একটা সময়ােপযােগী পলিটিক্যাল রূপকেই তুলে ধরেছেন । একই সঙ্গে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে উদয়ন পণ্ডিতের বিদ্রোহ ও জয়লাভ । সত্যজিতের ইতিবাচক ভাবনারই ফল । বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে । সত্যজিৎ বারােটা গান ব্যবহার করেছেন । সবই তার নিজের লেখা । আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে তাে বাঙালির জয়যাত্রার আবহসঙ্গীত।
নিজের কাহিনি নিয়ে সত্যজিৎ এই প্রথম ছবি করলেন ‘কাঞ্চনজঙঘা’(১৯৬২)। ছবিতে লাবণ্য ধনী পাত্রের বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে দার্জিলিংয়ের প্রকৃতিকে ভালােবেসেছে।অলােকের রুচিকে ক্রমাগত অস্বীকার করে মনীষা বলেছে – আপনার কুয়াশা ভালাে লাগে না বুঝি?অন্যদিকে লাবণ্যের লিপে ‘এ পরবাসে রবে কে’ আলাদা মাত্রা এনে দিয়েছে।নিজের সত্তা আবিষ্কারের মধ্যেই এই ছবির মহত্ত্ব ধরা পড়েছে।
কাঞ্চনজঙ্ঘার পরে নিজের কাহিনি নিয়ে সত্যজিতের পরের ছবি ‘নায়ক’(১৯৬৬)।অরিন্দম মুখার্জির বিখ্যাত চিত্রতারকা হয়ে যাওয়া ও তার থেকে মুক্তির সন্ধানই ছবির মূল সুর।সাংবাদিক অদিতিই এই ছবিতে অরিন্দমকে বাস্তবের মুখােমুখি দাড় করিয়েছে।অদিতির সঙ্গে অনেকটাই যেন মিল আছে ‘সীমাবদ্ধ’ ছবির টুটুলের।শুধু অরিন্দম নয়,মি.বােস,প্রমীলা বসুর চরিত্রের অভাববােধও ফুটিয়ে তুলেছেন সত্যজিৎ।ছবির মধ্যে একমাত্র অদিতিই আলাদা।তাই সহজেই বিভিন্ন স্টেশনে নেমে সে আর কারোর বিবেক জাগাতে মিশে গেছে ভিড়ে। অরিন্দম শুধুই চেয়ে থেকেছে ।
এক বিদেশি সমালােচক একসময় সত্যজিৎকে বলেছিলেন বৃক্ষ।এই ধারণাকে সামনে রেখে বলা যায় তার ছবির টেকনিশিয়ান,শিল্পীরা শাখা-প্রশাখা।সত্যজিৎ কী এই ভাবনা নিয়েই নিজের কাহিনি অনুসারে ছবি করলেন শাখা – প্রশাখা( ১৯৯০ )।যাই হােক,একটি পরিবারকে কেন্দ্র করেই শাখা – প্রশাখা বিন্যস্ত।ছবিটির শেষে দেখা যায় আনন্দবাবুর নিজের অসুখ সেরে গেছে।কিন্তু অন্য অসুখ ছড়িয়ে পড়েছে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে অর্থাৎ মূল্যবােধের সংকট কিভাবে শাখায় শাখায় বিন্যস্ত,সত্যজিৎ যেন তারই মানবিক দলিল করেছেন।“আগন্তুক”(১৯৯১)ছবি তাে সত্যজিতের নিজের লেখা গল্প অতিথির সার্থক চিত্ররূপ।সাহিত্যের ভাষা আর চলচ্চিত্রের ভাষা বােঝা যায়।অতিথির বাইরের জগতের আভাস ছবিতে সরাসরি দেখিয়েছেন সত্যজিৎ ‘অতিথি’তে।অপরিচিত আগন্তুককে (শেতলমামা) বিশেষ খারাপ ব্যবহারের সম্মুখীন হতে হয়নি।কিন্তু ছবিতে সে(মনােমােহন)সত্যিই মামা কি তার জেরা হয়েছে পরিবারের তরফ থেকে।সত্যজিৎ এই ছবিতে প্রথম দিকে সভ্য সমাজের নগ্নতাকে তুলে ধরলেও মানবিকতারই জয়গান করেছেন।নিজের সমস্ত টাকা-পয়সা ভাগ্নি অনিলাকে দেওয়ার মধ্যেও রয়েছে আত্মিক বন্ধনের টান।আবার নতুন করে মামার নিরুদ্দেশ হওয়ার মধ্যেও রয়েছে দুরের হাতছানি,পথেই নিশ্চয়তা,বিশ্বমানবতার সন্ধান।ফিচার ছবির পাশাপাশি সত্যজিৎ পাঁচটি তথ্যচিত্র করেছেন।পাঁচটিরই চিত্রনাট্য পরিচালনা,সঙ্গীত ও ভাষ্যে তিনি নিজে।সেগুলি ‘রবীন্দ্রনাথ’(১৯৬১),“সিকিম”(১৯৭১),’ইনার আই ’ (১৯৭৪),’বালা'(১৯৭৬) ও ‘সুকুমার রায়'(১৯৮৭)|’রবীন্দ্রনাথ’ তথ্যচিত্রে বিশ্বমানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথকেই ধরেছেন।‘সিকিম’ তথ্যচিত্রে সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তুলে ধরার পাশাপাশি সত্যজিৎ কি সিকিমের অন্য কোনও অন্ধকার দিক তুলে ধরতে চেয়েছিলেন?যার জন্য এটিকে নিষিদ্ধ করা হল।ইনার আই তাে বিনােদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের কর্মজীবন নিয়ে তৈরি।’বালা ’ তথ্যচিত্র দক্ষিণী নৃত্যশিল্পী বালা সরস্বতীর নৃত্যশৈলীর ছবি।আর ‘সুকুমার রায়’ তথ্যচিত্রে সুকুমারের জীবন ও শিল্পকর্ম বিশেষ স্থান পেয়েছে।এর পাশাপাশি সত্যজিৎ তিনটি দুরদর্শন চিত্র করেছেন। সেগুলি ‘টু’ ( ১৯৬৪),“পিকু”(১৯৮২)ও ‘সদ্গতি ‘(১৯৮২)।প্রথম দুটির কাহিনি,চিত্রনাট্য ও সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন সত্যজিৎ স্বয়ং।’সদগতি’ মুন্সি প্রেমচাঁদের কাহিনি অবলম্বনে সত্যজিতের পরিচালনা ‘টু’ ছােটদের শৈশব বিষয়ক ছবি।’পিকু ‘ ছবিতে বাবা – মায়ের প্রেমহীনতা এবং মায়ের সঙ্গে পরপুরুষের অবৈধ সম্পর্কের স্বরূপ ধরা পড়েছে।আর ‘সদ্গতি’ তাে এক অন্ত্যজের শবদেহ সৎকারের কাহিনিরই প্রতিফলন।