নানা চোখে সত্যজিৎ

১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ২ মে উত্তর কলকাতার ১০০ নম্বর গড়পাড় রােডের রায় পরিবারে যাঁর জন্ম সেই বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী সত্যজিৎ রায়ের প্রয়াণ ঘটে ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল। তাঁর মৃত্যুর পর অতিক্রান্ত হল প্রায় সাতাশটি বছর। শুধুমাত্র চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবেই তিনি খ্যাতির চরমসীমায় পৌছাননি, সাহিত্য-সংস্কৃতি আর চিত্রশিল্পের অঙ্গনেও তিনি ছিলেন সমান অগ্রগণ্য।

Written by Piyushkanti Sarkar Kolkata | May 2, 2019 4:25 am

সত্যজিৎ রায়. (File Photo: IANS)

১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ২ মে উত্তর কলকাতার ১০০ নম্বর গড়পাড় রােডের রায় পরিবারে যাঁর জন্ম সেই বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী সত্যজিৎ রায়ের প্রয়াণ ঘটে ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল। তাঁর মৃত্যুর পর অতিক্রান্ত হল প্রায় সাতাশটি বছর। শুধুমাত্র চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবেই তিনি খ্যাতির চরমসীমায় পৌছাননি, সাহিত্য-সংস্কৃতি আর চিত্রশিল্পের অঙ্গনেও তিনি ছিলেন সমান অগ্রগণ্য।

১৯৫৭ সালে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের একেবারে শেষ পর্বে সত্যজিৎ রায়ের ‘অপরাজিত’, ভিস কন্তি- ‘লা নটি ব্লেন্স’ আর আকিও কুরােসােয়ার ‘ম্যাকবেথ’- এর মধ্যে দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত ‘অপরাজিত’ ও ‘ম্যাকবেথ’ যুগ্মভাবে ‘গােল্ডেন লায়ন’ লাভ করে। এই প্রসঙ্গে মেরি সিটন তাঁর ‘পোট্রেট অব এ ডায়রেক্টর সত্যজিৎ রায়’ গ্রন্থে লিখেছেন- দীর্ঘকায় সত্যজিৎ রায়ের চমকপ্রদ চিন্তাধারায় সৃষ্ট অপরাজিত এবং কুরােসােয়ার ম্যাকবেথ (থ্রোন অব ব্লাড) জিতে নিয়েছিল ‘গােল্ডেন লায়ন’। সেইসঙ্গে ভিস কন্তির ‘লা নটি ব্লেন্স’- এই ত্রয়ী মিলে সবচেয়ে বেশি পুরস্কার জিতে নিয়েছিল।

তবে ভিত্তোরিয়া ডেসিকা’র যেমন ‘বাইসাইকল থিভস’, আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটেলশিপ অব পুটেমকীন’, কুরোশােয়ার ‘রশােমান’, তেমনই সত্যজিৎ রায়ের বিশ্বপরিচিতি– তিনি ‘পথের পাঁচালী’র স্রষ্টা। প্রথম শ্রেণির চলচ্চিত্র সমালােচক এবং ‘সিকোয়েন্স’ ও ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ পত্রিকার এক সময়ের সম্পাদক লিন্ডসে এন্ডারসন সেই সময় লিখেছিলেন- ‘…’পথের পাঁচালী’ ইজ এ পিকচার কমপ্লিটলি ফ্রেশ অ্যান্ড পার্সোনাল রিকোয়ার্ড গ্রেট কারেজ অ্যান্ড পার্সিভারেন্স টু মেক। ইট ইজ টু কমপ্লিমেন্ট রায়, নট টু ডিনাই হিজ অরিজিন্যালিটি দ্যাট আই মেনশন নেমস লাইক রেনােয়ার অ্যান্ড ফ্ল্যাহারথি অ্যান্ড ফারটিলাইজিং ইনফ্লুয়েন্স হ্যাস সিওরলি বিন দ্য নিওরিয়্যালিজম অব ডেসিকা’।

‘অপরাজিত’ ভেনিস-এ ‘গােল্ডেন লায়ন অব সেন্ট মার্ক’ পাওয়ার পর ‘Robert Flaherty’-র নামের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের নাম ওতপ্রােতভাবে জড়িয়ে যায়। তাঁর বিধবা স্ত্রী ফ্রান্সিস সত্যজিতের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের পর মেরী সিটনকে লিখেছিলেন– ‘রায় শান্ত, অন্তর্মুখী একান্তে থাকা মানুষ, যেখানে বব অশান্ত, উষ্ণ এবং অত্যৎসাহী। আপনি তো জানেনই যে রায়ের উপস্থিতি সবসময় মনে ছাপ রেখে যায়, বিশেষ করে তাঁর ইংরাজি ভাষার স্পষ্ট উচ্চারণ ও প্রয়ােগের দক্ষতা আমি খুব কম মানুষকেই দেখেছি। মনকে গভীরভাবে স্পর্শ করতে পারে। এমন বিস্ময়কর তথ্য প্রকাশের অদ্ভুত ক্ষমতার বলেই তিনি ‘পথের পাঁচালী’র মতাে ছায়াচিত্র নির্মাণ করতে পেরেছিলেন।

এখন প্রশ্ন আসে এতখানি প্রশংসার পাত্র যিনি, তিনি মৃণাল সেনের একটি বক্তব্যে এতটাই ক্ষিপ্ত হলেন যে একটি ইংরাজি পত্রিকায় ‘আকাশকুসুম’ চলচ্চিত্রটিকে ‘a crow film’ বলে মন্তব্য করে ফেললেন কেন? আসলে ‘নায়ক’ ছায়াছবির চিত্রনাট্য সরাসরি রচনা করে উত্তমকুমারকে সেই ভূমিকায় অভিনয় করানােয় চিত্র সমালােচকদের সুরে সুর মিলিয়ে একজন সফল চিত্রপরিচালকের অবনমন-এর ধুয়ো তুলে ‘বাণিজ্যিক স্তরে নেমে এসেছেন’ জাতীয় মন্তব্য করেছিলেন মৃণাল সেন। ‘আকাশকুসুম’-এর সাফল্যে তিনি তখন উদ্বেল। একজন চিত্রপরিচালকের এহেন মন্তব্যে একপ্রকার বাধ্য হয়েই প্রতি আক্রমণে উঠে আসতে হয়েছিল সত্যজিৎ রায়কে। প্রয়ােজনে ‘ফেঁস’ করার নির্দেশ তাে স্বয়ং ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণই দিয়ে গিয়েছেন।

সত্যজিৎ রায়ের প্রিয়বন্ধু চিদানন্দ দাশগুপ্তের কন্যা অপর্ণা দাশগুপ্ত পরবর্তীকালে যিনি ‘অপর্ণা সেন’ তিনি সত্যজিতের অনন্য আবিষ্কার। সেই অর্পণাই অভিনয় করেছিলেন ‘আকাশকসম’-এ। অথচ সেই ছবিকে ‘a crow film’ বলেছিলেন সত্যজিৎ রায়- ফলে বােঝাই যায় মৃণাল সেনের ব্যবহারে কতটা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন তিনি।

সমকালীন আর এক বিখ্যাত চিত্রপরিচালক ‘ঋত্বিক ঘটক’ সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘… আমি মনে করি ভারতবর্ষে ছবির মাধ্যমটাকে যদি কেউ বােঝেন, তবে তিনি হচ্ছেন একমাত্র সত্যজিৎ রায়। দেখুন, মেজে-ঘষে পড়াশুনাে করে একটা স্তর পর্যন্ত রগড়াতে রগড়াতে পৌছানাে যায়। এমনকী হয়তাে প্রবন্ধকার বা ইস্কুল মাস্টারের স্তর ছাড়িয়ে একধরনের শিল্পীতেও পরিণত হওয়া যায়, কিন্তু জাতশিল্পী হতে গেলে অন্য আরেকটা এলেম লাগে।

একই ভাবে ঋত্বিক ঘটক সম্পর্কে সত্যজিৎ বলেছিলেন, ‘ঋত্বিক মনে-প্রাণে বাঙালি পরিচালক ছিল, বাঙালি শিল্পী ছিল– আমার থেকেও অনেক বেশি বাঙালি। আমার কাছে সেইটেই তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় এবং সেইটেই তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান এবং লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য।’

এই যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবনত ভাব- মণাল সেনের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটেছিল সত্য, তবে পরবর্তীকালে বৈরীভাব দূর হয়ে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।

সত্যজিতের আর একজন কঠোর সমালােচক ছিলেন অভিনেত্রী নার্গিস দত্ত, যিনি সত্যজিৎ রায়ের বিরুদ্ধে দারিদ্র রফতানির অভিযােগ এনেছিলেন।

পঞ্চাশের দশকের প্রথমভাগেই রাজ কাপুর-নার্গিস জুটি নজর কেড়েছিলেন। মধ্যভাগে ‘শ্রী ৪২০’– কৌতুক ও রােমান্সের মিশ্রণে চুড়ান্ত পর্বে পৌছায় কিন্তু তারপর রাজ কাপুর, ক্রমশ নতুন নায়িকার সন্ধানে মেতে ওঠেন। ওয়াহিদা রহমান (তিসরি মঞ্জিল), পদ্মিনী (জিস দেশ মে গঙ্গা বহতি হ্যায়) এবং বৈজয়ন্তীমালা (সঙ্গম)– তাঁর নায়িকার স্থান পূরণ করতে শুরু করেন। নার্গিসি আর কে গ্রেডকশন থেকেই সেই যে বেরিয়ে গিয়েছিলেন আর কখনওই ফিরে আসেননি। নার্গিসকে এড়িয়ে যে ওয়াহিদা রহমানকে আবিষ্কার করেন রাজকাপুর, সত্যজিৎ রায় তাঁকেই সুযােগ দেন তাঁর অন্যতম চলচ্চিত্র ‘অভিযান’ (১৯৬২)-এ। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ (১৯৬৭)-তে তিনি সুযােগ দেন সিমি গারেওয়ালকে। ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ী’ (১৯৭৭)-তে সুযােগ পেয়েছিলেন শাবানা আজমি এবং শেষমেশ ‘সদগতি’ (১৯৮১)-তে অভিনয় করেন স্মিতা পাতিল, কিন্তু সত্যজিৎ একবারের জন্যও নার্গিসকে ডাকেননি। হয়তাে নার্গিসের একান্ত ইচ্ছে ছিল সত্যজিতের কোনও ছবিতে অভিনয় করার, কিন্তু সুযােগ না পাওয়ার জন্যই বােধ করি ক্ষোভে ১৯৮০ সালে রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের পর তাঁর বিরুদ্ধে ‘দারিদ্র রফতানি’র অভিযােগ তুলে ক্ষোভ উগলে দেন। কেউ কেউ এ ব্যাপারে ‘সদগতি’র নাম উল্লেখ করেন, কিন্তু এটি তো নিতান্তই ভারতীয় দূরদর্শন প্রযােজিত চিত্র, যা ১৯৮২ সালের ২৫ এপ্রিল সম্প্রচার করা হয়। এই ছায়াচিত্রটি কীভাবে দারিদ্র রফতানি করতে পারে? প্রধানত সত্যজিতের সমালােচকরা দারিদ্র প্রচারের অভিযােগ তুলতেন ‘পথের পাঁচালী’ এবং ‘অশনি সংকেত’-এর বিরুদ্ধে।

প্রথম ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত কান চলচ্চিত্র উৎসব থেকে ডেনমার্ক-এর ‘বদিল’ পুরস্কার– মােট এগারােটি পুরস্কার লাভ করে আর তাঁর জীবন-সায়াহ্নে এনে দেয় ‘অস্কার’।

অপরদিকে দ্বিতীয় ছায়াছবিটি ১৯৭৩ সালে চিকাগাের ‘গােল্ডেন হুগাে’ পুরস্কারে ভূষিত হয়। তা ছাড়া সত্যজিৎ শ্রমিক শ্রেণিকে নিয়ে ছবি করেন না বা শ্রেণিসংগ্রামের কোনও বার্তা তাঁর ছবি দিতে পারেনি-বামপন্থীদের এই অভিযােগের জবাব দিতেই তিনি ‘হীরক রাজার দেশে’ আর ‘সদগতি’ নির্মাণে প্রয়াসী হয়েছিলেন।

নার্গিসের অভিযােগের জবাব দেওয়ার বদলে তাঁর একটি কার্টন এঁকেছিলেন সত্যজিৎ রায়। তিনি ছিলেন শিল্পী। ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় সহ বহু বিখ্যাত মানুষের রেখাচিত্রও অঙ্কন করেছিলেন তিনি। তাইতো প্রয়াণের দুই দশক পরেও সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের মিলন জগতে তিনি অমর হয়ে আছেন।

(তথ্যসূত্র : ১. ‘সত্যজিৎ রায় ভিন্ন চোখে’ – শীতলচন্দ্র ঘোষ ও অরুণকুমার রায় সম্পাদিত। ২. অনন্য সত্যজিৎ — প্রবোধকুমার মৈত্র সম্পাদিত।)