অসমের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছুদিন ধরেই নিম্নবিত্ত বাঙালিদের উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছে হিমন্ত বিশ্বশর্মার সরকার। খুবই কম দিনের নোটিসে এবং কোনও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করেই বংশানুক্রমে বাস করা এইসব মানুষকে তাঁদের ঘরবাড়ি এবং জমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। এই বর্ষার মধ্যেও মাথায় ত্রিপলটুকুও দেওয়ার অবস্থায় তাঁরা নেই। তাঁরা প্রায় সবাই ভারতের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের ‘বিদেশি অনুপ্রবেশকারী’ বলে গালাগালি দেওয়া হচ্ছে। ‘এখানে পড়ে না থেকে নিজের দেশে চলে যাচ্ছ না কেন?’– এই ধরনের উদ্ভট এবং অপমানজনক কথা শোনানো হচ্ছে তাঁদের। এমনকি তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে ধুবড়ি জেলার চাপড়-বিলাসীপাড়া অঞ্চলে উচ্ছেদ হওয়া যে সমস্ত পরিবারকে ক্ষতিপূরণ ও জমি দিয়েছিল অসম সরকার, সেইসব মানুষকে বাংলাদেশি বলে তাঁদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে। গোয়ালপাড়া জেলাতেও বিল অঞ্চল থেকে যাঁদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে, তাঁরাও প্রকৃতপক্ষে বেদখলকারী ছিলেন না কোনোদিনই।
এইভাবে উচ্ছেদ করা মানুষজনের প্রতি অমানসিক অত্যাচার চালানো হচ্ছে। এমনকি আদালতের নির্দেশ অনুসারে খাদ্য ও জলের ব্যবস্থা করা তো দূরের কথা, এই বর্ষার মধ্যে তাঁদের মাথার ত্রিপলও খুলে দেওয়া হয়েছে। এরকম বিভিন্ন অত্যাচারের ফলস্বরূপ সেখানে পুলিশ ও বনরক্ষীদের সঙ্গে বিবাদে পুলিশের গুলিতে উচ্ছেদ হওয়া মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটেছে।
Advertisement
গোলাঘাট জেলার উরিয়ামঘাটে উচ্ছেদের নোটিস পেয়ে অনেকেই গাড়িতে নিজেদের জিনিসপত্র নিয়ে পিতৃপুরুষের ভিটে নগাঁও ও মরিগাঁও-এর উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু লাচিত সেনার মতো বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যরা বিশেষ করে নওগাঁ এবং মরিগাঁও জেলায় তাঁদের যেভাবে অকল্পনীয় বাধা নিষেধ করেছে, তা মানবজাতির কলঙ্ক বললেও কম বলা হয়। এইসব সংগঠনের নামে প্রশিক্ষণহীন সাধারণ লোকেরাও তাঁদের কাগজপত্র পরীক্ষা করে এবং এইসব কাগজপত্র সন্তোষজনক নয় বলে তাঁদের পিতৃভিটেয় যেতে দেয়নি। এমনকি অনাহার ও অনিদ্রায় ক্লিষ্ট ওইসব উচ্ছেদ হওয়া মানুষদের আবার উরিয়ামঘাটেই ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে।
Advertisement
উল্লেখ্য, এইসব মানুষের পূর্ব পুরুষেরা নওগাঁও ও মরিগাঁও জেলার যে সব জায়গায় বসবাস করতেন, তা এখন নদীগর্ভে। এঁরা এখন উরিয়াম ঘাটে কৃষিকাজের মাধ্যমে নিজেদের জীবন নির্বাহ করেন। কিছুদিন আগে অসমের মুখ্যমন্ত্রী নিজেই এ কথা জানিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, এঁদের কোথাও বসবাস করার ব্যবস্থা করে দেওয়া প্রয়োজন। এখন এ কথা প্রকাশ্যে এসেছে যে, ১৮৯০ সালের আশেপাশে ব্রিটিশরা এঁদের পূর্ব পুরুষদের তৎকালীন পূর্ববঙ্গ থেকে এখানে নিয়ে এসেছিল কৃষিকাজ করার জন্য। স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা এখন অসমেরই ভূমিপুত্র। কিন্তু পঞ্চাশ বছর আগে সমগ্র ধুমকুড়া অঞ্চলটি ব্রহ্মপুত্রের গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ায় এইসব মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে কাজের সন্ধানে কার্বি আংলং, গোলাঘাট, শিবসাগর ইত্যাদি জেলায় চলে যান। আর এখন যাঁদের উরিয়াম ঘাটে উচ্ছেদ করা হচ্ছে, তাঁরা ওইসব মানুষের পরবর্তী প্রজন্ম। উচ্ছেদ ঘোষণা করার সময় তাঁদের সম্পর্কে এমন একটি ধারণা তৈরি করা হয়েছিল যে, তাঁরা নগাঁও-মরিগাঁও জেলার থেকে এসে এখানে জায়গা বেদখল করে বসবাস করছেন।
এইসব অসহায় মানুষদের, যাঁদের মাতৃভাষা বাংলা, যেভাবে নির্যাতনের মুখে পড়তে হয়েছে, তাতে প্রবল বিচলিত বোধ করছেন অসমেরই বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, সাংস্কৃতিক কর্মী ও সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত সমাজকর্মীদের একাংশ। সমাজমাধ্যমে অসমের সাধারণ জনগণের উদ্দেশে একটি আবেদনপত্র পোস্ট করেছেন। তাতে তাঁরা উপরিলিখিত তথ্যগুলি উল্লেখ করে কাতর আবেদন জানিয়েছেন যে, উচ্ছেদ হওয়া ওইসব মানুষের নিজেদের পূর্বের অথবা পূর্ব পুরুষের জায়গায় ফিরে গিয়ে বসবাস করার মৌলিক মানবিক অধিকার যেন কোনও কারণেই খর্ব করা না হয়। অসম সরকার তথা প্রশাসনের প্রতিও তাঁদের দাবি, এইসব উচ্ছেদ হওয়া মানুষের নিজেদের জায়গায় ফিরে যাওয়ার মানবিক ও নাগরিক অধিকার খর্ব করতে যেন কোনও ব্যক্তি বা সংগঠন নিজের হাতে আইন তুলে না নেয় তা প্রশাসনকে নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, আদালতের নির্দেশ অনুসারে যথোচিতভাবে আগাম নোটিস না দিয়ে এবং যথোচিত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে আর যেন কোনও নাগরিককে উচ্ছেদ করা না হয়। এছাড়াও ইতিমধ্যে যাঁদের উচ্ছেদ করা হয়েছে, তাঁদের সবাইকে উপযুক্ত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে যেন কোনও অবহেলা করা না হয়– অসম সরকারের কাছে এই দাবি জানিয়েছেন অসমীয়া বুদ্ধিজীবীরা। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ড. হীরেন গোহাঁই, অরূপা পটঙ্গীয়া কলিতা প্রমুখ।
Advertisement



