রাজ্যে কোভিড পলিসি তৈরি করতে গড়া হল উপদেষ্টা কমিটি

করোনায় আর্থিক ক্ষতি সামাল দিতে এবং মহামারী পরিস্থিতিতে রাজ্যকে দিশা দেখাতে রাজ্যের তরফে গড়া হবে গ্লোবাল অ্যাডভাইসরি বোর্ড ফর কোভিড রেসপন্স পলিসি এই ওয়েস্ট বেঙ্গল।

Written by SNS Kolkata | April 7, 2020 3:03 pm

অভিজিং বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় (File Photo: Scott Eisen/Getty Images/AFP)

করোনায় আর্থিক ক্ষতি সামাল দিতে এবং মহামারী পরিস্থিতিতে রাজ্যকে দিশা দেখাতে রাজ্যের তরফে গড়া হবে গ্লোবাল অ্যাডভাইসরি বোর্ড ফর কোভিড রেসপন্স পলিসি এই ওয়েস্ট বেঙ্গল। সোমবার নবান্নে সাংবাদিক বৈঠক করে একথা ঘোষণা করলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই কমিটির নেতৃত্ব দেবেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। এছাড়া থাকবেন হু-এর প্রাক্তন স্থানীয় কর্মকর্তা স্বরূপ সরকার। কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করবেন রাজ্যের দুই অভিজ্ঞ চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরী এবং সুকুমার মুখার্জি।

মুখ্যমন্ত্রী বলেন, যারা বিদ্যা, বুদ্ধি ও মেধায় বিশ্বজয় করেছেন, তাঁদের নিয়ে এই ধরনের কমিটি তৈরি করে দৃষ্টান্ত গড়ল বাংলা। এই চারজন ছাড়াও আরও কয়েকজনকে রাখা হবে এই কমিটিতে।

সাংবাদিক বৈঠকে এই ঘোষণার পর বিকেল পাঁচটায় পর মুখ্যমন্ত্রী টেলিফোনে যোগাযোগ করেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। অভিজিৎবাবু এই উপদেষ্টা কমিটির নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য সম্মতি জানিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, আগামী দিনে এই উপদেষ্টা কমিটিকে আরও কাকে নেওয়া হবে, সেই বিষয়েও ‘গাইড’ করবেন অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়।

মুখ্যমন্ত্রী বলেন, করোনার জন্য রাজ্যের অর্থনীতি শুয়ে পড়েছে। ব্যবসা বাণিজ্য সব বন্ধ। এর থেকে কবে মুক্তি ঘটবে কেউ জানে না। করোনার ফলে ভেঙে পড়া আর্থিক অবস্থা চাঙ্গা করতে, সামাজিক উন্নয়নের দিশা দেখাতে, প্রান্তিক মানুষদের কল্যাণের জন্য এমনকী করোনা মোকাবিলায় সার্বিক পরিকাঠামো তৈরি করতে মুখ্যমন্ত্রীকে প্রামর্শ দেবে এই কমিটি।

প্রসঙ্গত মাস কয়েক আগে এই রাজ্যে সংবর্ধনা নিতে আসার সময় নবান্নে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সময় তিনি জানিয়েছিলেন, এই রাজ্যে কাজের অনেক সুযোগ আছে। রাজ্যের হয়ে কাজ করতে চান তিনি। করোনা পরিস্থিতিতে দিন দশেক আগে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের।

এছাড়া ভারতের মতো বিপুল জনসংখ্যার দেশে করোনা সংক্রমণ কী ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে, লকডাউন বলবৎ হওয়ার কারণ নিয়ে সমাজের সবরের মানুষকে সচেতন করা ইত্যাদি বেশ কিছু সুপারিশ করে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর স্ত্রী এস্থার দুফলোর একটি লেখা জাতীয় স্তরে প্রকাশিত হয়েছিল। সেইসব পরিকল্পনার প্রতিফলন ঘটতে পারে রাজ্যের তৈরি উপদেষ্টা কমিটির মাধ্যমে।

মুখ্যমন্ত্রী এদিন করোনা নিয়ে মোদি সরকারের গাফিলতি ও অহেতুক রাজনীতি করার অপচেষ্টা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বলেন, ভারতে করোনায় প্রথম মৃত্যু ঘটেছিল ২১ জানুয়ারি এবং লকডাউন ঘোষণা করা হয়ে ২৪ মার্চ। এই রাজ্যে করোনা ছড়ানোর সঙ্গে বিদেশি যোগাযোগ প্রায় ৯৮ শতাংশ বলেও মন্তব্য করেন মমতা। সময়মতো আন্তর্জাতিক উড়ান বন্ধ না করার জন্যই করোনা সংক্রমণ ছড়িয়েছে সেই ইঙ্গিতও দেন মমতা।

এমনকী কেন্দ্রীয় সরকার চা বাগান খোলার প্রস্তাব দিলেও তা যে এই রাজ্যে বাস্তবায়িত হবে না সেকথা স্পষ্ট জানিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। কারণ কালিম্পং-এর ঘটনার পর উত্তরবঙ্গে চা বাগানের শ্রমিকরা কাজ করতে ভয় পাচ্ছে। যদিও কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশমতো লকডাউন মেনে চলার জন্যও রাজ্যবাসীর উদ্দেশে সোমবার বার্তা দেন মমতা।

একই সঙ্গে প্রথমে রাজি না থাকলেও আগামী ৮ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর ডাকা বৈঠকে তৃণমূলের প্রতিনিধি থাকবেন বলেও জানিয়ে দেন মমতা। প্রসঙ্গত সোমবার পশ্চিমবঙ্গে করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা নিয়ে টুইট যুদ্ধ চলতে থাকে বিজেপির আইটি সেলের প্রধান অমিত মালিয়া এবং তৃণমূল সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদারের মধ্যে।

বিজেপির পক্ষ থেকে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তথ্য গোপনের অভিযোগ আনা হয়। মমতা এদিন প্রকাশ্যে অভিযোগ করেন, ফেক নিউজ ছড়াচ্ছে কোনও রাজনৈতিক দলের আইটি সেল। কাসর ঘন্টা নিয়ে পথে নেমে মানুষকে ভুল বোঝাচ্ছে। সেইসব মহানুভবদের অনুরোধ জানাব, দয়া করে করোনা নিয়ে রাজনীতি করবেন না। এটা রাজনীতি করার সময় নয়। মুখ্যমন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কেন্দ্রের কোনও তথ্য নিয়ে চ্যালেঞ্জ করিনি। কারণ এটা চ্যালেঞ্জ করার সময় নয়।

রাজ্যে করোনা আক্রান্তদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ে ফের নিশ্চিত করলেন এই রাজ্যে অ্যাক্টিভ করোনায় মৃতের সংখ্যা ৩ এবং এনআরএস-এর কেস ধরেই সোমবার দুপুর পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৬১। তার মধ্যে ৫৫ জনই সাতটি পরিবারের। কালিম্পং-এর পরিবারের ১১ জন আক্রান্তের মধ্যে একজন মারা গিয়েছেন। কমান্ড হাসপাতালের ডাক্তারের পরিবারের ৫ জন, তেহট্টের পরিবারের ৫ জন, এগরার পরিবারের ১২ জন, হাওড়ায় ৮ জন, কলকাতায় ১২ জন এবং হলদিয়ায় ২ জন করোনায় আক্রান্ত।

মুখ্যমন্ত্রী বলেন, এঁদের সকলেরই বিদেশি যোগ কিংবা ভিন রাজ্য থেকে আসার যোগসূত্র রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাস দেন, যদিও এক্ষুণি করোনা সংক্রমণ থেমে যাওয়ার এমন ভাবার কোনও কারণ নেই।

এই প্রসঙ্গে রাজ্যে ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গি রোগের সংক্রমণের কালানুক্রমিক ইতিহাস পরিসংখ্যান দিয়ে তুলে ধরেন মমতা। ১৯৯০ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই রাজ্যে ম্যালেরিয়ার সংক্রমণের সংখ্যা ২৭ হাজার থেকে শুরু করে আড়াই লক্ষ পর্যন্ত বেড়েছে। যা গত বছর সাড়ে আঠেরো হাজারে নেমেছে। সেইসঙ্গে এই ম্যালেরিয়ায় মৃতের সংখ্যাও ২১৪ (২০০৩) থেকে ৩ (২০১৯, অক্টোবর)-এ নেমে এসেছে।

ম্যালেরিয়ার প্রকোপ কমার পরে ডেঙ্গির ক্ষেত্রেও একইভাবে সংক্রমণের ও মৃত্যুর সংখ্যাভিত্তিক হিসেব তুলে ধরে বলেন, যে কোনও জীবাণু প্রকট হলে তার প্রকোপ কমতে সময় লাগে। করোনার ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটার সম্ভাবনা। তবে করোনা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ারও কোনও প্রয়োন নেই। কারণ করোনায় সুস্থ হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। যেমন কালিম্পং-এর যে পরিবারটি করোনায় আক্রান্ত হয়েছিল, তার মধ্যে চারজনের রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে।

রাজ্যের মধ্যে সাতটি অঞ্চলে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেশি বলে মন্তব্য করেন মুখ্যমন্ত্রী। বেলেঘাটা আই ডি হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ১৩ জন বাড়ি ফিরতে পারছেন। এখনও যে ১৭ জন ভর্তি রয়েছেন, তাদের মধ্যে ১২ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক নয়। একজনের অবস্থা একটু সংকটজনক। হোম কোয়ারেন্টাইনে যে ৫৪,৮২৩ জন রয়েছেন তাদের মধ্যে ৩,৭৪৯ জনকে রিলিজ করা হচ্ছে। রাজ্যের ৫১১’টি সরকারি কোয়ারেন্টাইন বা বলা ভালো সেফ হাউস সেখান থেকেও ৪০১০ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আর ৫৯’টা কোভিড হাসপাতালে ৪৭০৬’টা বেডের বন্দোবস্ত রয়েছে।

তবে করোনা মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকার যথেষ্ট সহযোগিতা করছেন না সেই বিষয়টিও সোমবার সাংবাদিক বৈঠকে তথ্য দিয়ে বুঝিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি রাজ্য সরকার এখনও পর্যন্ত ১১ লক্ষ পারসোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) অর্ডার দিয়েছে। তার মধ্যে ২ লক্ষ ৬০ হাজার ১০০’টি রাজ্য সরকার সংশ্লিষ্ট স্থানে পৌঁছে দিতে পেরেছে। সেক্ষেত্রে কেন্দ্র এতদিনে পাঠিয়েছে মাত্র ৩ হাজার। তাও আবার বিশেষ হলুদ রঙের।

মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, আইসিএমআর-এর নিয়ম মেনে এই পিপিই তৈরি করতে সময় লাগছে। আমেরিকার মতো ধনী দেশে যেখানে রেনকোটকে পিপিই’র বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেখানে রাজ্য সরকার এখনও তা করেনি। কয়েকটা বাজারে বেরিয়েছিল সেটাও তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে পরবর্তীকালে যদি প্রয়োজন করে ‘মেডিকেল অ্যাডভাইস’ নিয়ে তা ব্যবহার করা যাবে কিনা ভাবনাচিন্তা করতে হবে।

রাজ্য সরকার ৭ লক্ষ ৯২ হাজার এন নাইন্টি ফাইভ মাস্ক অর্ডার দিয়েছে। যার মধ্যে হাতে এসে পৌঁছেছে ৭৮,৭৫০ টা। সেক্ষেত্রে কেন্দ্র পাঠিয়েছে মাত্র ১০ হাজার। এছাড়া সাড়ে চার লক্ষের মতো টু লেয়ারড মাস্ক, সাড়ে আট লক্ষের মতো থ্রি লেয়ারড মাস্ক অর্ডার দিয়েছে রাজ্য সরকার। এক লক্ষের বেশি গ্লাভস, ৮৮,৬০০ লিটার হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং ২০ হাজার থার্মাল গানও অর্ডার দেওয়া হয়েছে।

মুখ্যমন্ত্রী বলেন, রাজ্য সরকার তার সীমিত ক্ষমতার মধ্যে যতটা পারছে করছে। মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যেও ডাক্তার ও নার্সের অভাবে ওখার্ড হাসপাতাল বন্ধ করে দিতে হয়েছে।