কথা ছিল বাংলার ফুটবলকে জেলাস্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে বেঙ্গল সুপার লিগ ফুটবল শুরু করা হবে। কিন্তু আসল লক্ষ্যে একেবারেই ব্যর্থ, তা নিয়ে আলোচনা এই মুহূর্তে তুঙ্গে। খেলার মাঠে দর্শক নেই। কোথাও কোথাও হাতে গোনা দর্শকের সামনে চলছে আইএফ ও সাচি স্পোর্টসের এই মেগা টুর্নামেন্ট। লিগের গভীরে গেলে প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতার কোনও মৌলিক ফারাক দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। জেলার নামকে সামনে রেখে দল গঠন করা হয়েছে। আর অধিকাংশ দলই কলকাতার প্রতিষ্ঠিত ক্লাবের একটি ফ্র্যাঞ্চাইজি। নর্থ বেঙ্গল আসলে কাস্টসম দলের খেলোয়াড়দের নিয়ে গঠন করা হয়েছে। ২৪ পরগনা দল গড়া হয়েছে ইউনাইটেড স্পোর্টস ক্লাবের ফুটবলারদের নিয়ে। বীরভূম দল করা হল অ্যাডামাস ইউনিভার্সিটির খেলোয়াড়দের নিয়ে এবং সুন্দরবন দলে ডায়মন্ড হারবার দলের খেলোয়াড়দের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। নতুন দল গঠন করার ভাবনাতেই পুরনো ও পেশাদারি ক্লাবগুলোকেই ব-কলমে প্রাধান্য দিয়ে দল গঠনের চেষ্টা করা হল।
এদিকে বলা হয়েছিল, প্রতিভা অন্বেষণে এই টুর্নামেন্ট থেকে নতুন মুখদের তুলে আনা সম্ভব হবে। জেলা ও গ্রামের ফুটবলারদের সুযোগ দেওয়া হবে এই প্রতিযোগিতায়। বাস্তবে তাও হল না। মাঠের লড়াইয়ে দেখতে পাওয়া গেল বিভিন্ন দলের হয়ে খেলছেন কলকাতা প্রিমিয়ার লিগ ও আই লিগের নিয়মিত খেলোয়াড়রা।
Advertisement
বলতে দ্বিধা নেই কুন্তল পাখিরার মতো অভিজ্ঞ ফুটবলার, যিনি ইতিমধ্যেই পেশাদার স্তরে প্রতিষ্ঠিত, তাঁকে যখন ‘জেলার নতুন মুখ’ হিসেবে দেখা যায়, তখন প্রশ্ন ওঠে প্রকৃত আনকোরা ছেলেরা কতটা সুযোগ পাচ্ছে? ফ্র্যাঞ্চাইজিরা ঝুঁকি না নিয়ে মূলত ‘তৈরি’ খেলোয়াড়দের ওপরই ভরসা রাখছে। আবার এই ফুটবল টুর্নামেন্টকে নিয়ে একটা ছেলেখেলা চলছে। নির্দিষ্ট সময়ে খেলা শেষ হওয়ার পরে পেনাল্টি শুটআউটে অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে দুই দলের পাঁচজন খেলোয়াড়কে। সারা পৃথিবীতে এই ধরনের কোনও অভিনব পেনাল্টি শুটআউট হয় না। ৯০ মিনিটের খেলা ড্র হলে সরাসরি পেনাল্টি শুটআউট এবং জয়ী দলকে অতিরিক্ত ১ পয়েন্ট দেওয়ার নিয়মটি দর্শকদের বিনোদন দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এর ফুটবলীয় যৌক্তিকতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এটি অনেক সময় দলগত লড়াইয়ের চেয়ে ব্যক্তিগত ভাগ্য বা দক্ষতাকে লিগ টেবিলের ভাগ্যবিধাতা বানিয়ে দিচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদী লিগ ফুটবলের ঐতিহ্যের পরিপন্থী হতে পারে।
Advertisement
কিন্তু আইএফএ কীভাবে এই বিনোদন খেলার অনুমোদন করল? শুধু তাই নয়, আইএফএ ইতিমধ্যেই বড় পদক্ষেপ নিয়েছে, কলকাতা ময়দানে বেটিং চক্রের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত রয়েছেন, তাঁদের সাবধান করে দিয়েছে। কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। তাহলে সন্দেহভাজক যে সমস্ত ফুটবলারদের নাম আইএফএ দপ্তরে এসে পৌঁছেছে, তাদের কীভাবে এই টুর্নামেন্টে নাম নথিভুক্ত করার অনুমতি দেওয়া হল? তাহলে অন্য বিষয়টি এখানে মাথাচাড়া দিতে পারে। আসল উদ্দেশ্য থেকে সরে গিয়ে অন্য খেলায় অনেকেই ভূমিকা নিতে পারেন।
জেলার ফুটবলারদের আন্তর্জাতিক মানের কোচিং ও গাইডেন্সের সুযোগ করে দেওয়া কি সম্ভব হয়েছে? লিগের অন্যতম সফল ও উজ্জ্বল দিক। মেহতাব হোসেন, হোসে ব্যারেটো বা বিশ্বজিৎ ভট্রাচার্য’র মতো কিংবদন্তিদের মেন্টরশিপে তরুণরা আধুনিক ফুটবলের কৌশল ও পেশাদার মানসিকতা শিখছে। জেলার ফুটবলাররা যে পেশাদার ড্রেসিংরুম কালচার পাচ্ছে, তা তাদের আগামীর পথচলায় বড় সম্পদ। বেঙ্গল সুপার লিগ বাংলার ফুটবলকে জেলা শহরগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে—এটিই এর সবথেকে বড় সার্থকতা। তবে একে যদি সত্যিই ‘জেলার লিগ’ হতে হয়, তবে ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠিত ক্লাবের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জেলার নাম কেবল জার্সিতে নয়, দলের আত্মাতেও থাকা প্রয়োজন।
যদি তৃণমূল স্তরে স্বচ্ছ স্কাউটিং এবং স্থানীয় ফুটবলারদের জন্য নির্দিষ্ট কোটা রাখা না হয়, তবে এটি কেবল ‘কলকাতা লিগের দ্বিতীয় সংস্করণ’ হয়েই থেকে যাবে।
Advertisement



