• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

রসিক শরৎচন্দ্র

দেশজুড়ে তখন বিদেশি হাওয়ার রোল উঠেছে। বাঙালিদের মধ্যে কেউ কেউ বিশেষ অনুপ্রাণিত হয়ে উগ্র সাহেবিয়ানার প্রমোদে মত্ত।

ফাইল চিত্র

স্নেহা মণ্ডল‌

শৈশবের প্রাণস্ফূর্তিকে গ্রাস করে দারিদ্র্য তাঁর কৈশোরকে করে তুলেছে বেপরোয়া, উচ্ছৃঙ্খল। ভবঘুরে জীবন কাটিয়েছেন দিনের পর দিন। আর্থিক টানাপোড়েনে পড়াশোনা বন্ধ হলেও সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ ছিল অটুট।
‘পিতার নিকট হতে অস্থির স্বভাব ও গভীর সাহিত্যানুরাগ ব্যতীত আমি উত্তরাধিকার সূত্রে আর কিছুই পাইনি’— এই মন্তব্য স্বয়ং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। পিতৃসূত্রে প্রাপ্ত এই ‘সম্পদ’কে কাজে লাগিয়েই তিনি হয়ে উঠেছিলেন অপরাজেয় কথাশিল্পী।

Advertisement

জীবনে যে কখনও ভালবাসেনি, কলঙ্ক কেনেনি, বিরহ ভার বয়ে বেড়ায়নি সেই তো পরের মুখে ঝাল-খাওয়া কল্পনা নিয়ে নিজের খোরাক যোগায়। কিন্তু যাঁর বই পড়ে বাঙালির চোখজোড়া নিজে থেকেই ছলছল করে ওঠে, এক মর্মস্পর্শী, দরদী অথচ আটপৌরে কাহিনির সুনিপুণ গল্পগাথা কেমন করে যেন সমগ্র হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে জ্যান্ত হয়ে ধরা দেয়, সে লেখা শরৎচন্দ্র ছাড়া আর কারই বা হতে পারে। গভীর জীবনবোধ এবং সামাজিক সমস্যা নিয়ে লেখার পাশাপাশি জীবনকে দেখার তাঁর এক বিশেষ ভঙ্গি ছিল, যা কখনও কখনও হাস্যরস সৃষ্টি করত। তার কিছু উজ্জ্বল উদাহরণ ফিরে দেখা যাক।

Advertisement

পাঠকসমাজে তখন ‘অরক্ষণীয়া’র বেশ জনপ্রিয়তা। অন্তিম পরিচ্ছদে অতুল-জ্ঞানদার শেষ পরিণতি নিয়ে রীতিমতো তর্কাতর্কি চলছে। শরৎবাবুর কাছে এই নিয়ে খান পঞ্চাশেক চিঠি জমেছে। শেষমেষ বন্ধু হরিদাসবাবু অনেক অনুনয় বিনয় করায় তিনি পত্রের জবাবে লিখলেন, ‘তারপর তাহাদের সহিত আর আমার সাক্ষাৎ হয় নাই; সুতরাং কী হইল তা আমি বলিতে পারিব না।’

কৌতুকপ্রিয় হওয়ায় বন্ধুমহলে তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা করার সুযোগও কেউ ছাড়তেন না। সেবার শরৎচন্দ্র ছিলেন ভাগলপুরে। এক পিয়ন এদিক-ওদিক ঘুরে তাঁরই কাছে এসে জিজ্ঞেস করেন, মচ্ছরবাবু বলে সেখানে কেউ থাকেন কিনা। শরৎচন্দ্র দেখলেন চিঠির খামটির উপর লেখা ‘শ্রী মচ্ছরচন্দ্র শর্মা’। খানিক হেসে শরৎ বললেন, ‘এ চিঠি আমার।’ এই উত্তর শুনে খানিকটা অবাক আর বিস্ময় মিশ্রিত স্বরে পাশ থেকে তাঁর এক বন্ধু বলে উঠলেন, ‘কী হে ভায়া তোমার নাম আবার মচ্ছরচন্দ্র হল কী করে?’ তিনি তেমনি সহাস্যে উত্তর দিলেন, ‘এটা আমার এক বন্ধুর রসিকতা। আমার নামটা সন্ধি করে দিয়েছে, শ্রীমৎ শরৎচন্দ্র শর্মা।’ চিঠির প্রত্যুত্তরে তিনি বন্ধুকে দিয়ে রাস্তা থেকে একটা পাথর আনালেন। এরপর সেটিকে ভালো করে মুড়ে তার সঙ্গে দু’ছত্র চিঠি লিখে দিলেন। পাথর সমেত চিঠিখানা ডাকঘরে ওজন করালেন, মাশুলও ভিপি করে ‘মচ্ছরচন্দ্র’ লেখা সেই বন্ধুর কাছে পাঠালেন। বন্ধুটিও পয়সা খরচ করে ভিপি নিয়ে মোড়ক খুলে পাথরটি পেলেন, সঙ্গে মোটা হরফে লেখা দুই লাইন, ‘তোমার কুশল জেনে আমার মনের পাথরভার নামিয়ে দিলুম।’

এমনভাবেই হাস্যরস বন্ধুমহলের গণ্ডি পেরিয়ে মাঝেমধ্যেই ঢুকে পড়ত রাস্তাঘাটের অচেনা পরিবেশে। একবার শরৎচন্দ্র আর উপেন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় ট্রামে করে যাচ্ছিলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর উপেনবাবু কন্ডাক্টরকে আসতে দেখে মানিব্যাগ থেকে একটা টাকা বের করে দিলেন। কিছু না ভেবেই কন্ডাকটর টাকাটা তার ব্যাগের ভিতর অন্যান্য টাকার মধ্যে ফেলে টিকিট দিতে যাবে, এমন সময় শরৎচন্দ্র উপেন্দ্রর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে অথচ কন্ডাক্টর যাতে শুনতে পায় এমন ভঙ্গিতে বললেন, ‘কী, সেই টাকাটা?’ কন্ডাক্টর মনে মনে ভাবল তাঁরা বুঝি অচল টাকা দিয়েছেন। ব্যস্ত হয়ে ব্যাগের মধ্যে হাত ভরে অনেক নাড়াচাড়া ও পর্যবেক্ষণ করেও যখন সন্দেহজনক কিছুই পেল না তখন খানিকটা মুষড়ে গিয়ে টিকিট দিয়ে চলে যাওয়ার সময় বলল, ‘অচল চালালেন তো! আমারই লোকসান যাবে দেখছি।’ কাণ্ড দেখে শরৎচন্দ্র আর উপেনবাবু হাসিতে লুটিয়ে পড়লেন।

শুধু বাস্তবে নয়, কৌতুকরসের জোয়ার-ভাটা খেলেছিল তাঁর নানান গল্পে। যেমন শ্রীকান্তের প্রথম পর্বে দেখা যায়, তাঁদের মেজদা ভাইদের অহেতুক সময় নষ্ট করা বন্ধ করতে ‘থুতুফেলা’, ‘নাকঝাড়া’, ‘তেষ্টা পাওয়া’ প্রভৃতি ক্ষেত্রে টিকিট প্রবর্তন করে এক দমফাটা দুর্বিসহ অবস্থার সৃষ্টি করেছিলেন, আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছিনাথ বহুরূপীর উদ্ভট বেশভূষা এবং তার উৎপাতকে ঘিরে ভট্টাচার্য মশায়ের অনবদ্য হিন্দুস্তানি বুলি— ‘এই বজ্জাতকে বাস্তে আমার গতর চূর্ণ হো গিয়া। খোট্টা শালার ব্যাটারা আমাকে যেন কিলায়কে কাঁটাল পাকায় দিয়া।’ আবার কখনও রসবোধকে বাতিকের সঙ্গে সমপরিমাণে মিশিয়ে সৃষ্টি করেছেন নতুন আঙ্গিকের নানান আত্মভোলা চরিত্র। এর মধ্যে বিশেষভাবে মনে পড়ে ‘বামুনের মেয়ে’ গল্পের সেই প্রিয়নাথ ডাক্তারটিকে। যার কাছে ডাক্তারি ছিল প্রকৃতপক্ষে বাতিকের বাড়াবাড়ি। একবার রামময়ের খোঁড়া পায়ের চিকিৎসায় এমন অদ্ভুত ডাক্তারি জেরা শুরু করলেন, তাতে রোগীর ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। ‘কী রকমের বেদনা? সূচিবিদ্ধবৎ না বৃশ্চিকদংশনবৎ। কনকন করছে না ঝনঝন করছে?’ এদিকে রোগীর কাহিল অবস্থা। তার উপর পায়ের বেদনা সারাবার ওষুধের বদলে দিয়েছেন মৃত্যুভয় থেকে উদ্ধার পাওয়ার ওষুধ, কারণ রোগীর মনে মৃত্যুভয় ঢুকেছে।

সেইসময় বড়দিদি, চরিত্রহীন, গৃহদাহ প্রভৃতি রচনার সুবাদে লেখক হিসেবে শরৎচন্দ্রের বেশ নামযশ বেড়েছে। যেখানেই যেতেন ভক্তদের উৎপাত শুরু হয়ে যেত। কেউ কেউ তো শরৎচন্দ্রের চটি চুরি করে নিয়ে যেতেন, স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে রাখবেন বলে। ফলে সভা সেরে তাঁকে খালি পায়েই বাড়ি ফিরতে হত। একেই নিত্যদিন চটিজোড়া চুরি হয়ে যাচ্ছে, তার উপর খালি পায়ে হাঁটতে দেখে রাস্তার লোকেদের প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে শুষ্ক কণ্ঠে জবাব দিতেন, ‘বাবা চলে গেলেন!’ এইভাবে কখনও বাবা, কখনও কাকা-জ্যাঠাদের নাম বলে কোনওক্রমে সে যাত্রায় রক্ষা পেতেন। অবস্থা বেগতিক দেখে শরৎচন্দ্রের ছেলেবেলার বন্ধু এবং মাতুল স্থানীয় উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় একাধারে একটি উপায় এবং উপহাস করার মতলবে তাঁকে নিয়ে গেলেন চৌরঙ্গীর অভিজাত ‘রেক্স-সু’ নামের একটি জুতোর দোকানে। একজোড়া জুতো কিনতে। শরতের পায়ে তখন একজোড়া ছিন্ন মলিন চটিজুতা। একেই বিশাল দোকান তার ওপর অমন ধুলোমাখা জীর্ণ জুতো দেখে কর্মচারীরা আদৌ জুতো দেখাতে রাজি হবেন কিনা এসব সাত-পাঁচ ভেবে খানিক সংকোচ করেই ভেতরে প্রবেশ করলেন এবং উপেনের পীড়াপীড়িতে বাধ্য হয়ে সাড়ে বত্রিশ টাকা দিয়ে একজোড়া জুতো কিনলেন। কিনে পুরোনো জুতোজোড়া দোকানে ফেলে, নতুন জুতো পরে বের হলেন। ফুটপাত ধরে এগিয়ে ধর্মতলায় পৌঁছনোর পর উপেনবাবু বললেন, ‘শরৎ তোমার ছয় পয়সার চামড়া ক্ষয়িল।’ কিছুদূর যাওয়ার পর উপেন ফের বলল, ‘শরৎ তিন আনা ক্ষয়িল’। বন্ধুর এহেন আচরণে বেশ ক্ষুণ্ন হয়ে শরৎচন্দ্র একটা ট্যাক্সি ডাকলেন এবং দুই জনে ট্যাক্সিতে চড়ে বাড়ি ফিরলেন। বেশ কিছুদিন যাওয়ার পর উপেনবাবু এক সকালবেলায় তাঁর বাড়িতে উপস্থিত হলে তিনি বাড়ির কাজের ছেলেটিকে নতুন জুতো জোড়া আনতে আদেশ দেন। মনিবের কথা মতো চাকর ভোলা জুতোজোড়া আনলে তা উপেন্দ্রকে দেখিয়ে শরৎ বললেন, ‘দেখো তো উপেন কয় আনা ক্ষয়েছে? জুতো জোড়া কয়েক মাস তো পরলাম।’

দেশজুড়ে তখন বিদেশি হাওয়ার রোল উঠেছে। বাঙালিদের মধ্যে কেউ কেউ বিশেষ অনুপ্রাণিত হয়ে উগ্র সাহেবিয়ানার প্রমোদে মত্ত। হঠাৎ করে এই ভোল বদলানোর বিষয়টা ব্যাঙ্গরসিক লেখকের নজর এড়ায়নি। সজোরে চপেটাঘাতস্বরূপ রচিত হল উপন্যাস ‘বড়দিদি’। মমতাময়ী অতল স্নেহস্পর্শী চরিত্রের পাশাপাশি সাহেবি ধাঁচের বিলাস-বাহুল্যকে ব্যাঙ্গাত্মক মূর্ছনায় মুড়ে তৈরি করলেন এই উপন্যাসের আরেক প্রধান চরিত্র শশাঙ্কমোহনকে। যার রং ছিল নেটিভ, মেজাজ ব্রিটিশদের ন্যায়, অশুদ্ধ হলেও বাংলা বলার ক্ষমতা ছিল, তবে ইংরেজি বলতেন সম্পূর্ণ ভুল।

শরৎচন্দ্রের যেকোনও লেখার প্রতিই ছিল বাঙালির আকাশ সমান ভালোবাসা এবং কৌতূহল। বিশেষত নারী চরিত্রগুলোকে অতি সযত্নে গড়ে তিনি এমন জীবন্ত রূপ দিতেন যে তা ভ্রম বললে ভ্রম হতো। কখনও পতিতার কলহ যন্ত্রণা, কখনও অ-সমবয়সী প্রেম, তার আত্মত্যাগ, আবার কখনও মায়ের স্নেহ, পত্নীর ভালোবাসা, ঘৃণা, আক্ষেপ সবকিছুকেই যেন কেমন করে এক অদৃশ্য মন্ত্রবলে তিনি তা শতদলের শোভার মতো ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। আবার আত্মসম্মানে আঘাত লাগলে সেই নারীজাতি যে কী ভীষণ হতে পারে, কতখানি দপ করে জ্বলে উঠতে পারে তাও এঁকেছেন তাঁর সুনিপুণ অক্ষরে। নারীজাতির মন তিনি দর্পণের ন্যায় হুবহু পড়ে ফেলতে পারতেন। তাঁর এহেন গুণের জন্য কলঙ্ক রটাতে লোকে বলতেন, ‘শরৎ চাটুজ্জ্যে লোকটা মাতাল, তেমনি চরিত্রহীন। পতিতাদের মধ্যেই থাকে।’ স্বামী চিতায় উঠলে বিধবাদের নিয়ে বোষ্টমদের কটূক্তির জ্বালা তিনি নিজ চামড়ার নীচে অনুভব করতেন। নারীদের সহমরণ প্রসঙ্গে তাঁর মত জানতে চাওয়া হলে তিনি বলতেন, ‘কটির চন্দ্রহার নাচিয়ে নাচিয়ে গোপী দধিমন্থন না করলে পুরুষ মানুষের কি ভালো লাগবে?’
এমনই ছিলেন কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। অকপট, কর্তব্যপরায়ণ, কৌতুকপ্রিয় অথচ অন্যায়ে আপসহীন একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাই আজও তিনি অমলিন হয়ে রয়েছেন বাঙালির মনে, মননে।

Advertisement