• facebook
  • twitter
Monday, 22 December, 2025

হাইপারসনিক মিসাইলের এলিট ক্লাবে ঢুকে পড়ল ভারত

শব্দের থেকে ছয়গুন বেশি বেগে এরা লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করতে পারে। অর্থাৎ তখন এই মিসাইলের গতিবেগ থাকবে প্রতি সেকেন্ডে ২ কিমি।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

অসীম সুর চৌধুরী

গত ১৬ নভেম্বর (২০২৪) দিনটাকে ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণার ক্ষেত্রে একটা মাইলফলক বলা যেতে পারে। ওই দিন সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে ওড়িশার ড: এপিজে আবদুল কালাম দ্বীপ থেকে সফলভাবে দূরপাল্লার হাইপারসনিক মিসাইলের পরীক্ষা করা হল। এর ফলে ভারত হল পৃথিবীর মধ্যে চতুর্থ দেশ যারা এই বিশেষ ধরনের মিসাইল উৎক্ষেপনের ক্ষমতা অর্জন করল। এর আগে মাত্র তিনটে দেশ রাশিয়া, চিন আমেরিকা ওই হাইপারসনিক তৈরির ক্লাবে নাম লিখিয়েছে। কিন্তু কি এই হাইপারসনিক মিসাইল? এটা নিয়ে এতো হৈচৈ বা হচ্ছে কেন? অন্যান্য মিসাইলের সাথে পার্থক্য কোথায়? এই ব্যাপারে আলোচনা করার আগে, মিসাইল সম্বন্ধে একটু গোড়া থেকে জেনে নিই।

Advertisement

সোজা কথায় বলতে গেলে, কোনও বস্তুকে লক্ষ্যের দিকে ছুড়ে মারলে সেই বস্তুটাকে ‘মিসাইল’ বা ‘নির্দেশিত ক্ষেপনাস্ত্র’ হচ্ছে এমন একটা যান্ত্রিক অস্ত্র যা নিয়ন্ত্রিতভাবে কোনও লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করে। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণটা মিসাইলের ভেতর থেকে হতে পারে আবার দূর থেকেও করা যেতে পারে।

Advertisement

আধুনিক মিসাইলের প্রথম ব্যবহার হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির দ্বারা। এদের ব্যবহৃত প্রথম মিসাইল ‘ভি-২ রকেট’ এর আবিষ্কারক ছিলেন ‘ওয়ালানার ভন ব্রাউন’। ১৯৪৪ সালে নাৎসী বাহিনী প্রথম এই ‘ভি-২ রকেট’ এর সাহায্যে ৯০০ কিলোগ্রাম বিস্ফোরক লন্ডন শহেরর বুকে নিক্ষেপ করে ছিল। এরপর নানা দেশ নানা সময়ে নানা রকম মিসাইল ব্যবহার করেছে এবং এখনও তার পরম্পরা চলছে।

বৈশিষ্ট্য অনুসারে মিসাইলকে নানা শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। যেমন, কোথা থেকে ছোড়া হবে, কত দূরত্ব যাবে, কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে, গতিপথ কেমন হবে ইত্যাদি। এদের মধ্যে গতিপথ অনুসারে মিসাইলকে দুভাগে ভাগ করা হয়।
(১) ব্যালেস্টিক মিসাইল এবং (২) ক্রুজ মিসাইল।

এদের চরিত্রের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হচ্ছে দুটো। প্রথমত, ব্যালেস্টিক মিসাইল পৃথিবীর বায়ু মণ্ডল ভেদ করে উপরে উঠে তারপর আবার বায়ু মণ্ডলের ভিতরে প্রবেশ করে। কিন্তু ক্রুজ মিসাইলের গতিপথ সবসময় বায়ুমণ্ডলের মধ্যে থাকে কখনো বাইরে যায় না। দ্বিতীয়ত, ব্যালেস্টিকের পাল্লা ১২০০০ কিমি বা তার বেশি হতে পারে কিন্তু ক্রুজের ক্ষেত্রে সাধারণত দূরত্বটা ৫০০ কিমির ভেতরে রাখা হয়। ভারতের পৃথ্বী, ধনুস, অগ্নি— এরা সবাই ব্যালেস্টিক মিসাইল। আর পৃথিবী বিখ্যাত দ্রুত-গতির মিসাইল ‘ব্রহ্মস’ হচ্ছে ক্রুজ পরিবারের অন্তর্গত।

আবার ক্রুজ মিসাইলকে গতিবেগ অনুসারে তিন ভাগে ভাগ করা হয়—
(ক) সাবসনিক: আমরা জানি, শব্দ বাতাসে প্রায় ৩৪৩ মিটার প্রতি সেকেন্ড গতিতে ছোটে। বড় এককে এটা পরিবর্তন করলে দাঁড়ায় ১২৩৫ কিমি প্রতি ঘণ্টা। এর থেকে গতিবেগে যে সব মিসাইল ছোটে তাদের ‘সাবসনিক’ বলে। ভারতের ক্রুজ মিসাইল ‘নির্ভয়’ এই গোত্রের।
(খ) সপারসনিক: এই শেণির মিসাইলগুলোর গতিবেগ শব্দের থেকে বেশি। ব্রহ্মস ব্লক— ১, ২, ৩ এরা সবাই সুপার সনিক গোষ্ঠীর অন্তর্গত।
(গ) হাইপারসনিক: শব্দের থেকে পাঁচগুন বা তার বেশি গতিতে ছোটে যে সব মিসাইল তাদের হাইপারসনিক বলে। ভারতের ব্রহ্মস-২ (এখনো বানানো চলছে) এই শ্রেণিতে পড়ে, যার সর্বোচ্চ গতিবেগ প্রতি সেকেন্ডে ২.৭৪ কিমি। অর্থাৎ শব্দের চয়ে ৮ গুন বেশি বেগে এটা ছুটে যাবে।

শুরুটা করেছিল রাশিয়া। ওই দেশের প্রেসিডেন্ট মি: পুতিন ২০১৮ সালের মার্চ মাসে সারা পৃথিবীকে চমকে দিয়ে জানিয়েছিলেন যে, তাঁরা এমন একটা হাইপারসনিক ক্ষেপনাস্ত্র পরীক্ষা করতে চলেছেন যা কারও কাছে নেই। ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে রাশিয়া তা করেও দেখাল। সেকেন্ডে ৯.২২ কিমি বেগে চলা ‘অ্যাভেনগার্ড’ নামের এই হাইপারসনিক মিসাইল ৬০০০ কিমি দূরের এক লক্ষ্যবস্তুকে সফলভাবে আঘাত করে। দুই মেগাটন ওজনের একটা পারমানবিক বোমাও অনায়াসে এই ক্ষেপনাস্ত্রের মাথায় লাগিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু রাশিয়ার এই সাফল্য দেখে তার চির প্রতিদ্বন্দ্বী আমেরিকাও হাত-পা গুটিয়ে বসে ছিল না। ২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তারাও ‘রেথিটন’ নামে এক হাইপারসনিক মিসাইল পরীক্ষা করল, যা শব্দের চেয়ে পাঁচগুন বেশি গতিতে ছুটতে পারে। এদিকে চিন কোনও কিছুই প্রকাশ্যে বলে না। সবতাতেই রাখঢাক। ২০২১ এর মাঝামাঝি সময়ে গোপনে হাইপারসনিক ক্ষেপনাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছিল। কিন্তু খবরটা চেপে রাখা যায়নি। ব্রিটেনের নামকরা সংবাদপত্র। ‘ফিন্যালসিয়াল টাইমস’ এ সংবাদটা ফাঁস হয়ে যায়। এছাড়া আরো কিছু দেশ রয়েছে যারা হাইপারসনিক মিসাইল তৈরির প্রতিযোগিতায় সামিল। প্রথমেই নাম করতে হয় উত্তর কোরিয়ার। তারপর ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ইরান ও ইজরাইল ও এই দৌড়ে রয়েছে।

কিন্তু উন্নত দেশগুলোর কাছে তো ঝুড়ি ঝুড়ি ক্ষেপনাস্ত্র রয়েছে, তাহলে এই নতুন হাইপারসনিক মিসাইল বানাবার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে কেন? কারণ হাইপারসনিক প্রযুক্তিটা একেবারেই অন্যরকম। চিরাচরিত মিসাইলগুলো গতিপথ সবসময় অধিবৃত্তাকার বা প্যারাবোলিক হয়। তাই প্রচলিত মিসাইলগুলো উৎক্ষেপনের পর এক সম্ভাব্য গতিপথ আগে থেকেই অনুমান করা যায়। অত্যাধুনিক রেডার ও স্যাটেলাইটের সাহায্যে নিখুঁত হিসাব কষে মিসাইলকে নিমেষে ধ্বংস করে দেওয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বেশ কয়েকটা দেশের হাতেই রয়েছে।

কিন্তু এই নতুন হাইপারসনিক মিসাইলের গতিপথ আগে থেকে অনুমান করা একেবারেই অসম্ভব। এরা যে কোনও সময় গতিপথ পরিবর্তন করে আঁকাবাঁকা পথে চলতে পারে। এখনকার প্রচলিত ক্ষেপনাস্ত্রের মতো অধিবৃত্তাকার পথে চলে না বলে এরা কোন দিকে যাবে তা আগে ভাগে অনুমান করা একেবারেই অসম্ভব। মাটি থেকে অনেক কম উচ্চতায় প্রচণ্ড গতিতে ছুটে লক্ষ্যবস্তুকে ধ্বংস করতে পারে। একেবারে নীচ দিয়ে যাওার সময় শত্রুর র‍্যাডারে ধরা পড়া প্রায় অসম্ভব। আর যদি দেখাও যায় তবে একে রোখা মুশকিল এর দুরন্ত গতির কারণে।

সদ্য পরীক্ষা করা ভারতীয় হাইপারসনিক মিসাইলের বৈশিষ্ট্যগুলো কি কি সেটাই এবার দেখা যাক।
(১) শব্দের থেকে ছয়গুন বেশি বেগে এরা লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করতে পারে। অর্থাৎ তখন এই মিসাইলের গতিবেগ থাকবে প্রতি সেকেন্ডে ২ কিমি।
(২) এই হাইপারসনিক ১৫০০ কিমি দূর পর্যন্ত হামলা চালাতে পারবে। অর্থাৎ পাকিস্তান ও চিনের প্রায় বেশির ভাগ শহর এর আওতায় চলে আসবে।
(৩) মাটি থেকে খুব কম উচ্চতায় উড়তে পারে। তাই শত্রুর অত্যাধুনিক র‍্যাডারও একে নজরে আনতে ব্যর্থ হবে।
(৪) চিরাচরিত বা পরমানু অস্ত্র, যাই হোক না কেন সবই এই হাইপারসনিক ক্ষেপনাস্ত্র বহন করতে পারবে।
(৫) এতে রয়েছে অত্যাধুনিক ট্রাকিং ব্যবস্থা যা লক্ষ্য বস্তুকে নিখুঁতভাবে আঘাত করতে পারবে।

কিন্তু এই হাইপারসনিক মিসাইল বানাবার প্রতিযোগিতা শুরু হল কেন? বর্তমানে শক্তিধর দেশগুলোর হাতে মিসাইলের ভাণ্ডার রয়েছে। তবে প্রযুক্তিগত ভাবে সেগুলো প্রায় একই রকম। এগুলো ঠেকাবার কৌশলও তাদের হাতে রয়েছে। কিন্তু শব্দের চেয়ে ৫ থেকে ২০ গুন বেশি বেগে চলা এই ক্ষেপনাস্ত্র প্রতিরোধ করার কোনও প্রযুক্তিই আবিষ্কৃত হয়নি। যতই অত্যাধুনিক র‍্যাডার হোক কিংবা উপগ্রহের নজরদারি, হাইপারসনিক সবাইকে ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। তার উপর এর মাথায় পারমানবিক বোমা বসানোর ব্যবস্থা রয়েছে, যা যে কোনও যুদ্ধের মোড় ঘুড়িয়ে দিতে পারে। তাই এই প্রতিযোগিতায় যে এগিয়ে থাকবে, শক্তির ভারসাম্যের পাল্লা তার দিকে পড়বে।

Advertisement