প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০১৮ সালে সকল অসংগঠিত শ্রমিকের জন্য নিশ্চিত পেনশন বলে ঢালাও প্রচার করে প্রধানমন্ত্রী শ্রমযোগী মানধন যোজনা (পিএনএসওয়াইএম) প্রকল্প চালু করেন। অসংগঠিত শ্রমিক ১৮ থেকে ৪০ বয়সিরা এই পেনশন প্রকল্পে মাসে ৫৫ টাকা থেকে ২০০ টাকা জমা দেবেন, বিনিময়ে সরকার সমান অর্থ জমা দেবে ওই তহবিলে। এতে ৬০ বছর বয়সে মাসে কম করে ৩ হাজার টাকা পেনশন মিলবে শ্রমিকের। প্রথম ধাপে পাঁচ বছরের ১০ কোটি লক্ষ্যমাত্রা রেখে কিছু নাম নথিভুক্ত হলেও বর্তমানে দেখা যাচ্ছে শ্রমিকরা নাম প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন।
সম্প্রতি শ্রম মন্ত্রকের স্থায়ী কমিটির রিপোর্টে প্রকাশ, দেশজুড়ে চরম বেকারি, বর্তমানে শ্রমিক ছাঁটাই এবং মজুরি হ্রাসের ঘটনা বেড়ে চলায় আর্থিকভাবে শ্রমিকরা অক্ষম হয়ে পড়ায় তাঁরা পেনশন প্রকল্প থেকে নাম প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। একই সঙ্গে নতুন করে নাম নথিভুক্তিও কমে গিয়েছে। মাত্র তিন বছরের মধ্যে এই প্রকল্পে কেন্দ্রের বরাদ্দ অর্থ কমে অর্ধেক হয়েছে। পাঁচ বছরে ১০ কোটি শ্রমিককে এই প্রকল্পের আওতায় আনার লক্ষ্যমাত্রা স্থির হলেও তা হয়নি। মাত্র ৫ শতাংশ শ্রমিক গ্রাহক হয়েছেন। এর মধ্যে প্রতিদিন আবার শ্রমিক গ্রাহকরা প্রকল্প ছেড়েও দিচ্ছেন। অর্থের অভাবে পেনশন প্রকল্প থেকে শ্রমিকের নাম প্রত্যাহারের ঘটনায় অর্থনৈতিক সংকটের চেহারা প্রকট হয়ে ধরা পড়ছে।
Advertisement
প্রসঙ্গত, শ্রম দপ্তরের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি চলতি শীতকালীন অধিবেশনে যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে অসংগঠিত শিল্প শ্রমিকদের পেনশন প্রকল্পের বেহাল চিত্র উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, পিএমএসওয়াইএম প্রকল্পের মধ্য দিয়ে সমস্ত অসংগঠিত শিল্প শ্রমিকদের পেনশন প্রকল্পের আওতায় নিয়ে াসার কথা ঘোষণা করে কেন্দ্র। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল প্রথম পাঁচ বছরে ২০ কোটি, পরবর্তী আওতায় নিয়ে আসার কথা জানায়। পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে লক্ষ্যমাত্রার আশেপাশে পৌঁছনো যায়নি। শ্রমমন্ত্রী সংসদে জানিয়েছেন, চলতি ডিসেম্বরে এই প্রকল্পে শ্রমিক সদস্য সংখ্যা হলো ৫০ লক্ষ ৮৪ হাজার ৫০ জন।যা মোদী সরকারের লক্ষ্যমাত্রার ৩ শতাংশের কম। ৫০ লক্ষের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের সদস্য সংখ্যা মাত্র ১ লক্ষ ১৭ হাজার।
Advertisement
আবার অসংগঠিত ক্ষেত্রের শিল্প ছাড়া ছোট ব্যবসা, হকার, দোকানদার, স্বনিযুক্তি প্রকল্পের উদ্যোগী— যাঁদের দেড় কোটি টাকার কম বার্ষিক লেনদেন, তাঁদের এই পেনশন প্রকল্পে নিয়ে আসার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। পাঁচ বছরে মোট আড়াই কোটি ছোট উদ্যোগীকে প্রকল্পে নিয়ে আসার লক্ষ্য স্থির হয়। দেখা যায়, পাঁচ বছরে প্রকল্পে গ্রাহক হয়েছেন মাত্র ১ হাজার ৫৯১ জন। লক্ষ্যমাত্রার এক শতাংশও এই প্রকল্পের সদস্য হননি।
প্রতিটি ভোটের মুখে মোদী সরকার দেদার প্রকল্পের কথা ঘোষণা করে। ভোটের শেষে সেসব প্রকল্পের কোনও হদিশ মেলে না। অসংগঠিত ক্ষেত্রে পেনশন প্রকল্পের একই পরিণতি দেখা যাচ্ছে। এই পেনশন প্রকল্পে বাজেট বরাদ্দ প্রতি বছর কমে এশন প্রায় উঠে যাওয়ার পথে। স্থায়ী কমিটির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২১-২২ সালে এই প্রকল্পে বাজেট বরাদ্দ ছিল ৪০০ কোটি টাকা, তা সংশোধিত বাজেটে কমে দাঁড়ায় ৩৫০ কোটি টাকা। খরচ হয় আরও ২৬৯ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ সালে বাজেট বরাদ্দ হয় ৩৫০ কোটি টাকা, সংশোধিত বাজেটে তা কমে হয় ২০৫ কোটি টাকা। খরচ হয় মাত্র ১৬২ কোটি টাকা। ২০২৪-২৫ সালে বরাদ্দ আরও কমে হয় মাত্র ১৭৭ কোটি টাকা। তিন বছরে এই প্রকল্পে বরাদ্দ অর্ধেকের বেশি কমে গিয়েছে। উল্লেখ্য, এই প্রকল্পে যাঁরা নাম নথিভুক্ত করছেন, তাঁদের অংশের ৫৫ টাকা বা ২০০ টাকা জমা করায় সরকার একই পরিমাণ টাকা তাঁদের খাতে বরাদ্দ করবে। বাজেটে যে অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে এই প্রকল্পে তা শ্রমিকদের পেনশন খাতে জমা দেওয়ার লক্ষ্যে। বাজেটে পেনশন প্রকল্পে সেই অর্থের বরাদ্দ কেন কমেছে বলে প্রশ্ন ওঠে কমিটি বৈঠকে।
কেন্দ্রীয় সরকার বৈঠকে স্পষ্ট জানিয়েছে, এই পেনশন প্রকল্প হলো চাহিদা নির্ভর প্রকল্প। পেনশন গ্রাহক কমতে থাকায় চাহিদা কমেছে, চাহিদা কমায় বাজেটে তাই বরাদ্দ কমেছে। প্রশ্ন ওঠে, সরকার তার প্রচারে অসংগঠিত ক্ষেত্রের জন্য প্রথম আকর্ষণীয় পেনশন প্রকল্প বলে ঘোষণা করলেও তাতে কেন সাড়া মিলল না? এর জবাবে সরকার জানাচ্ছে, প্রথমত দেশে বর্তমান নিয়মিত চাকরি সুলভ নয়। দ্বিতীয়ত, করোনা মহামারীর জন্য বহু শ্রমিক কাজ হারান। তাতে আর্থিক সংকটের জন্য অনেকেই এই প্রকল্পের সুযোগ নিতে পারেননি। তৃতীয়ত, এই পেনশন প্রকল্প নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে চেতনা গড়ে না তোলায় তারা এতে আগ্রহী হয়নি। চতুর্থত, বর্তমানে শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের শিল্প কমে গিয়েছে। পঞ্চমত, আরও কিছু বেসরকারি পেনশন প্রকল্প থাকায় শ্রমিকরা এই প্রকল্পে গ্রাহক হওয়ায় আগ্রহী হয়নি। ষষ্ঠত, এই প্রকল্পে যেহেতু গ্রাহককে তার অংশের অর্থ দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পে চালিয়ে যেতে হবে, আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে তা চালানো সম্ভব হয়নি। অনেকেই তাই মাঝপথে ছেড়ে দিয়েছে এই প্রকল্প। ফলে গ্রাহক কমে গিয়েছে।
দেশে চড়া মূল্যবৃদ্ধি মানুষের জীবনযাপনের খরচ বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। তাতে বহু পরিবারে নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচে কোপ পড়েছে। এই কোপের শিকার হয়েছে এই প্রকল্প। এতে দেখা যাচ্ছে মাসে সামান্য ৫৫ থেকে ২০০ টাকা জমা করার ক্ষমতা হারিয়েছে বহু অসংগঠিত শ্রমিক। ফলে তাঁরা পেনশন প্রকল্পের খরচ বহন করতে পারছে না। তাই তাঁরা প্রকল্প ছেড়ে দিচ্ছেন।
অসংগঠিত ক্ষেত্রে সর্বজনীন পেনশন প্রকল্প চালু করার দাবি জানিয়ে আসছে শ্রমিক সংগঠনগুলি। সরকারকেই তার আর্থিক দায় বহন করতে হবে। শ্রমিকদের যা মজুরি মেলে তাতে আলাদা করে কোনও প্রকল্প অর্থ জমা করার ক্ষমতা তাঁদের থাকে না। তাই মোদী সরকারের ‘পেলো কড়ি মাখো তেল’-এর মতো নিজের পেনশন নিজে জমাও প্রকল্প সফল হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী শ্রমযোগী মানধন যোজনা মুখ থুবড়ে পড়ায় সেই আশঙ্কা সঠিক বলে প্রমাণ হয়ে গেল।
Advertisement



