• facebook
  • twitter
Saturday, 20 December, 2025

২০০৫ পেরিয়ে আজ ২০২৫ : অধরাই রয়ে গেলো স্বাধীন প্যালেস্তাইনের স্বপ্ন

দখলদার রাষ্ট্র ইসরায়েলের সাত দশকের ধারাবাহিক সামরিক-বেসামরিক আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত প্যালেস্তাইনের জাতীয় স্বপ্ন স্বাধীনতা। সাত দশকের ধারাবাহিক পরিকল্পিত আক্রমণে ইতোমধ্যে প্যালেস্তাইনি জাতির অধিকার ভূলুণ্ঠিত। প্যালেস্তাইনি জাতির ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষপাতমূলক ভূমিকায় ইসরায়েলের দখলদারিত্ব ক্রমেই সম্প্রসারিত হয়েছে। বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমী বিশ্বের ইন্ধনে বেপরোয়া ইসরায়েলের নিপীড়ন-নির্যাতনে নিজ ভূমি থেকেই উৎখাতের পথে প্যালেস্তাইনি জনগণ।

ফাইল চিত্র

প্রবীর মজুমদার

২০০৫ পেরিয়ে আজ ২০২৫। প্যালেস্তাইনিরা স্বাধীন রাষ্ট্রের কথা ভুলতে বসেছে। নিজভুমে পরবাসী হয়ে পশ্চিম তীর আর গাজা উপত্যকায় গৃহপালিত প্রাণীর মতো কোনোরকমে ঠাসাঠাসি করে মানবেতর জীবন যাপন করছে তারা। সংকুচিত হচ্ছে, দিন দিন সীমানা কমছে। তবু একটু শান্তির অপেক্ষায়, প্রতিদিন একটা শান্ত সূর্যোদয় আর একটি নীরব সন্ধ্যার অপেক্ষায় দিন কাটে ওদের।

Advertisement

১৯১১ সাল। তখনও মধ্যপ্রাচ্যের বিরাট এলাকা ছিল তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। ১৯১৪ সালে শুরু হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, যুদ্ধ চলল টানা চার বছর। সেই যুদ্ধে জার্মানি পরাজিত হলো ব্রিটিশ ও তার মিত্রদের কাছে। কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভীষণ ক্ষতি হলো, যার কারণ ছিল অটোম্যান সাম্রাজ্য। অটোম্যানরা ছিল জার্মানির মিত্র। ব্রিটেনের প্রয়োজন ছিল অটোম্যান সাম্রাজ্য ভেঙে দেওয়ার। আর আরবদের প্রয়োজন ছিল স্বাধীনতা। ১৯১৫ থেকে ১৯১৬, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন প্রায় এক বছর আলোচনা হলো তত্কালীন পবিত্র মক্কা নগরীর গভর্নর (শরিফ) হুসেইন বিন আলি এবং মিশরে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্যার হেনরি ম্যাকমোহনের সঙ্গে। স্বাধীনতার দাবিতে অটোম্যানদের বিরুদ্ধে আরব বিদ্রোহ তখন তুঙ্গে। এদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে, ব্রিটেনের পরিস্থিতি ভালো নয়। যুদ্ধে আরবদের পাশে চায় ব্রিটিশ অ্যালায়েন্স। হুসেইন বিন আলি ও স্যার হেনরি ম্যাকমোহনের আলোচনায় সিদ্ধান্ত হলো, আরবরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনদের পক্ষে থাকবে আর বিনিময়ে আরব স্বাধীনতা মেনে নেবে ব্রিটেন। ম্যাকমোহন-হোসেইন আলোচনায় আরব ম্যাপও প্রতিষ্ঠিত হলো, তৈরি হলো স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সীমানা। ২৪ অক্টোবর ১৯১৫ স্যার ম্যাকমোহন হুসেইনের কাছে চিঠিতে স্বাধীন আরব ও প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির কথা লিখেছিলেন। তিনি লিখেছেন: ‘…Great Britain is free to act without detriment to the interests of her ally France, I am empowered in the name of the Government of Great Britain to give the following assurance and make the following reply to your letter: Subject to the above modifications, Great Britain is prepared to recognize and support the independence of the Arabs within the territories in the limits and boundaries proposed by the Sherif of Mecca.’

Advertisement

সিরিয়ার দামাস্কাস , আলেপ্পো, হোমসের কিছু এলাকা ছাড়া পুরো আরব, প্যালেস্তাইনের স্বাধীনতা মেনে নিয়েছিলেন ম্যাকমোহন। স্বাধীনতার আনন্দে বিভোর আরবরা ম্যাকমোহনের কথামতো কাজ করল। প্রায় ৭০ হাজার আরব যোদ্ধা ব্রিটেনের পক্ষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিল। অনেকে যুদ্ধে নিহত হলো। আরব বিদ্রোহের কারণে অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতন হলো আর জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিতে গেল ব্রিটেন। কিন্তু ম্যাকমোহন যখন আরব স্বাধীনতার ব্যাপারে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন হুসেইনের সঙ্গে, ঠিক তখনই ব্রিটেন, ফ্রান্স আর রাশিয়া একটি গোপন চুক্তি করল, যা Sykes-Picot Agreement নামে পরিচিত। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের পর সেই গোপন চুক্তির কথাটি ফাঁস হয়ে যায়। ফলে স্যার হেনরি ম্যাকমোহন পদত্যাগ করেন। ২ নভেম্বর ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বেলফোর ব্রিটেনের ইহুদি নেতা ব্যারন রোডশিল্ডকে লেখেন: ‘His Majesty’s government view with favour the establishment in Palestine of a national home for the Jewish people, and will use their best endeavours to facilitate the achievement of this object, it being clearly understood that nothing shall be done which may prejudice the civil and religious rights of existing non-Jewish communities in Palestine, or the rights and political status enjoyed by Jews in any other country.’

১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হলো ইসরাইল রাষ্ট্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি, পোল্যান্ড, নেদারল্যান্ড থেকে বাস্তুহারা ইহুদিদের পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত হলো। ইউরোপের প্রচুর অনাবাদি জমি থাকা সত্ত্বেও ইহুদিদের পুনর্বাসনের জন্য তারা বেছে নিল মধ্যপ্রাচ্যের প্যালেস্তাইনিদের আবাস স্থলকে। ১৯১৪ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত পশ্চিমীদের প্রত্যেকটি বিশ্লেষণ, চুক্তি, ঘোষণাতে স্বাধীন দুটি রাষ্ট্রের পাশাপাশি অবস্থানের কথা উল্লেখ থাকল। সেই ১৯৪৮ সাল থেকে একটি স্বাধীন প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়িয়েছেন ইয়াসির আরাফাত। কখনো ওয়াশিংটন, লন্ডন, এশিয়া, ইউরোপ আর কখনো ল্যাটিন আমেরিকা। কখনো জঙ্গল, কখনো গুহায় আবার কখনো ট্যাংকের গোলার সামনে। কিন্তু আজও সেই সফলতা আসেনি।

দু’হাজার তেইশের শেষ সপ্তাহে দুবাইয়ের গ্লোবাল ভিলেজে আলাপ হয়েছিলো প্যালেস্তাইনি যুবক আবদেলের সঙ্গে। ততদিনে নতুন করে গাজায় মরণ খেলায় মেতে উঠেছে ইসরাইল। সুন্দর অ্যারাবিয়ান ড্রেস, লম্বা নাক, চোখা চাহনি— কী দারুণ শোভিত, পল্লবিত ছেলেটা। একদিন বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে মালয়েশিয়ার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা শেষ করে ফিরে গিয়েছিলো নিজভূমিতে। সেখান থেকে কাজের খোঁজে দুবাইতে। এই যে, ‘নিজভূমি’ লিখলাম। কেন লিখলাম? ঐ যে আবদেল বলছিল, ‘স্যার, আমাদের কোনো সীমানা নেই। প্রতিদিন আমাদের সংকুচিত করে দিচ্ছে।’ ওর চোখের দিকে তাকালাম— এ যেন ভূমিহীন ভৌগোলিক মানচিত্রহীন অসহায় একটা চাহনি। ওর সেই ক্ষীণ চাহনি আমার বিদ্রোহকে উসকে দিল। ওর হাতটা চেপে ধরে বললাম, ‘কে বলেছে তোমাদের সীমানা নেই? সমগ্র পৃথিবীই তোমাদের সীমানা।’

তারপর গত হয়েছে একটা বছর। জানিনা ও প্যালেস্তাইন ফিরতে পেরেছিলো কিনা কিংবা ফিরতে পারতেও বেঁচে আছে কিনা? ওরা সবাই মিসিং। ওরা জন্মগতভাবেই মিসিং। শিশু-কিশোর যৌবনপ্রাপ্ত অথবা প্রৌঢ়; জীবনের কোনো একটি অধ্যায়ে ওরা ‘ইন দ্য লাইন অব ফায়ার’। ২০০৫ সালের মধ্যে স্বাধীন প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ওদের কাছ থেকে আদায় করে নেওয়া হয়েছিল ইসরাইলি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি। দুর্বল আর ভঙ্গুর হলো পিএলও। প্যালেস্তাইনিরা হারাল তাদের সবচেয়ে বড় অভিভাবক ইয়াসির আরাফাতকে। ২০০৪ সালে আরাফাতের মৃত্যুর পর সব স্বপ্ন ভঙ্গ হয়ে গেছে আবদেলদের।

দখলদার রাষ্ট্র ইসরায়েলের সাত দশকের ধারাবাহিক সামরিক-বেসামরিক আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত প্যালেস্তাইনের জাতীয় স্বপ্ন স্বাধীনতা। সাত দশকের ধারাবাহিক পরিকল্পিত আক্রমণে ইতোমধ্যে প্যালেস্তাইনি জাতির অধিকার ভূলুণ্ঠিত। প্যালেস্তাইনি জাতির ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষপাতমূলক ভূমিকায় ইসরায়েলের দখলদারিত্ব ক্রমেই সম্প্রসারিত হয়েছে। বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমী বিশ্বের ইন্ধনে বেপরোয়া ইসরায়েলের নিপীড়ন-নির্যাতনে নিজ ভূমি থেকেই উৎখাতের পথে প্যালেস্তাইনি জনগণ। এই প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘ বরাবরই বিতর্কিত ভূমিকায় অবতীর্ণ থেকেছে এবং থাকছে। গত দুই দশকের আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার সূত্রধরে ইতোমধ্যে ধামাচাপা পড়েছে প্যালেস্তাইন ইস্যু। এই প্রেক্ষিতে ইসরায়েল কর্তৃক সম্ভাব্য প্যালেস্তাইনি রাষ্ট্রের কাঠামো প্রায় ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সংগত কারণেই এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে— ১৯৪৮ সালের বিভক্তি পরিকল্পনা অনুযায়ী প্যালেস্তাইনি জাতির জাতীয় স্বাধীনতার স্বপ্ন কি পূরণ হবে? অন্যদিকে পশ্চিমতীর কেন্দ্রিক চলমান প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রের যে কাঠামো— এরই ভবিষ্যৎ কি?

Advertisement