• facebook
  • twitter
Monday, 14 July, 2025

সংবাদমাধ্যমের সামনেই দুই রাষ্ট্রপ্রধানের নজিরবিহীন বাগযুদ্ধ

জেলেনস্কিও এই ঘটনা নিয়ে সমাজ মাধ্যমে পোস্ট করেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও সে দেশের প্রেসিডেন্টকে ধন্যবাদ জানান

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের সঙ্গে হোয়াইট হাউজে ওভাল অফিসের বৈঠকে সংবাদ মাধ্যমের সামনেই বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়লেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি। ট্রাম্প এবং জেলেনস্কির উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হওয়ার পর জেলেনস্কিকে হোয়াইট হাউজ থেকে চলে যেতে বলা হয়। বাতিল করা হয় পূর্ব নির্ধারিত যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনও। ট্রাম্প শুক্রবার জেলেনস্কিকে অসম্মানজনক আচরণ করার জন্য তিরস্কারও করেন। একই সঙ্গে, একটি খনিজ চুক্তি স্বাক্ষর বন্ধ করে দেন ট্রাম্প।

জেলেনস্কির এবারের ওয়াশিংটন সফরে ইউক্রেনের বিরল খনিজ সম্পদ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। এই বাগবিতণ্ডার জেরে তা ভেস্তে যায়। ট্রাম্প জেলেনস্কিকে বলেন, ইউক্রেনকে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ শেষ করতে হবে। জেলেনস্কি বলেন, তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে কোনও আপস করবেন না। এই কথা কাটাকাটির মধ্যেই জেলেনস্কিকে বৈঠক ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বলা হলে তিনি বেরিয়ে যান। ইউক্রেনের প্রতিনিধিদেরও বেরিয়ে যেতে বলা হয়। শুক্রবারই ইউক্রেনের উদ্দেশে রওনা হয়ে যান জেলেনস্কি। সংবাদমাধ্যমের সামনে দুই রাষ্ট্রপ্রধানের এই বাগযুদ্ধ বিশ্ব রাজনীতিতে নজিরবিহীন।

আমেরিকা এবং ইউক্রেনের মধ্যে খনিজ চুক্তি নিয়ে গত কয়েক দিন ধরেই কথাবার্তা চলছিল। জেলেনস্কিই এই চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছিলেন।  আগ্রহী ছিলেন ট্রাম্পও। ইউক্রেনের কিছু বিরল খনিজ পদার্থের দিকে আমেরিকার নজর রয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, বিনা বাধায় সেই খনি ব্যবহারের অনুমতি পাওয়ার কথা ছিল আমেরিকার। ট্রাম্প সেই কারণেই এই চুক্তিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। শুক্রবার হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে এই চুক্তি স্বাক্ষরেরই কথা ছিল।

জো বাইডেনের আমলে ইউক্রেনের দিকে আমেরিকা যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ট্রাম্প স্পষ্ট করে দিয়েছেন আমেরিকা লাভবান হবে, এমন চুক্তি বা সমঝোতাতেই তিনি আগ্রহী। জেলেনস্কি সে কথা ভেবেই খনিজ চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু চুক্তির শর্তে দুই দেশ শেষ পর্যন্ত একমত হতে পারেনি। প্রসঙ্গত, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে কিয়েভে পাঠানো আমেরিকার সাহায্যের ১৮০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পরিশোধ করার জন্য ট্রাম্প জোর দিয়েছিলেন।

প্রায় ৪৫ মিনিটের বৈঠকের শেষ ১০ মিনিট ট্রাম্প, ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স এবং জেলেনস্কির মধ্যে টানটান উত্তেজনায় পরিণত হয়। বৈঠকের একটি পর্যায়ে জেলেনস্কি জানান, পুতিন ২৫ বার যুদ্ধবিরতি চুক্তি এবং অন্যান্য চুক্তির খেলাপ করেছেন। তাঁকে বিশ্বাস করা যায়না। ট্রাম্প প্রতিক্রিয়ায় জানান, পুতিন কোনও চুক্তি ভঙ্গ করেননি। জেলেনস্কি তাতে আপত্তি জানালে ট্রাম্প বলেন, ‘আপনি লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন নিয়ে কার্যত জুয়া খেলছেন।’ ট্রাম্প এও বলেন, ‘আপনারা দেখতে পাচ্ছেন যে তিনি পুতিনের প্রতি ঘৃণা পোষণ করছেন। এই ধরণের ঘৃণার সঙ্গে একটি চুক্তি করা আমার পক্ষে খুব কঠিন।’   

জেলেনস্কির অভিযোগ, ট্রাম্প কেবল খনিজ চুক্তিতেই আগ্রহী। ইউক্রেনের নিরাপত্তার বিষয়ে কোনও পরিকল্পনা নেই তাঁর। বরং তিনি রাশিয়ার সঙ্গে হাত মেলাতেও প্রস্তুত। রাশিয়ার সঙ্গে বা ইউক্রেনের নিরাপত্তার বিষয়ে আপস না-করা নিয়ে অনড় জেলেনস্কি তাই ট্রাম্পের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না-হলে খনিজ চুক্তি স্বাক্ষর করবেন না, সাফ জানিয়ে দেন জেলেনস্কিও। সেক্ষেত্রে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধও বন্ধ হবে না। নিরাপত্তা এবং আমেরিকার সাহায্যের বিষয়ে কথা বলতে চেয়েছিলেন জেলেনস্কি। কিন্তু সেই আশ্বাস না পাওয়ায় ভেস্তে যায় শুক্রবারের বৈঠক, এমনটাই মনে করা হচ্ছে।

অন্যদিকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির বাগবিতণ্ডার সময় আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স দাবি করেন, গত বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বীর হয়ে প্রচার করেছিলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট। ওই নির্বাচনে রিপাপলিকান নেতা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী ছিলেন কমলা হ্যারিস। ভোটের সময় তিনি ছিলেন আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে। রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে পেন্টাগনের সামরিক সহয়তা চাইতেই আমেরিকা সফরে গিয়েছিলেন জেলেনস্কি। মার্কিন সমর্থনের গুরুত্বের কথা বলেছিলেন তিনি। তবে সরাসরি কোনও প্রার্থীর নাম করে সমর্থন বার্তা দেননি। সে সময় বাইডেন সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন কমলা। বস্তুত, ওই সফর চলাকালীন ওয়াশিংটনে বাইডেন এবং কমলার সঙ্গে পৃথক ভাবে বৈঠকও করেছিলেন জেলেনস্কি। তার পরদিন ট্রাম্পের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন তিনি।

এদিকে শুক্রবারের বাদানুবাদের পর ট্রাম্প তাঁর সমাজ মাধ্যমে প্লাটফর্মে লেখেন,  ‘যখন শান্তির জন্য প্রস্তুত হবেন, তখন ফিরে আসবেন।’  জেলেনস্কি যুক্তরাষ্ট্র ও ওভাল অফিসকে ‘অপমান করেছেন’ বলেও লিখেছেন ট্রাম্প।

জেলেনস্কিও এই ঘটনা নিয়ে সমাজ মাধ্যমে পোস্ট করেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও সে দেশের প্রেসিডেন্টকে ধন্যবাদ জানান। পরে সংবাদ মাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকার তিনি বলেন, প্রকাশ্যে যে বাদানুবাদ হলো সেটা ঠিক ছিল না, তবে ট্রাম্প ও তাঁর সম্পর্কের পুনরুদ্ধার সম্ভব। তিনি বলেন, ‘কারণ এই সম্পর্ক শুধু দুই জন প্রেসিডেন্টের মধ্যেকার সম্পর্কের চেয়েও বেশিকিছু। আমাদের দুই দেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়ও এখানে রয়েছে।’

এদিকে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে শুক্রবার রাতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের বাদানুবাদ এবং বৈঠক ভেস্তে যাওয়ার ঘটনায় মস্কো যারপরনাই খুশি মস্কো। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের অনুগামীরা হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে ওই ঘটনার জন্য জেলেনস্কিকেই দায়ী করেছেন।পুতিনের বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেন, ‘যে হাত তাঁকে খাওয়াচ্ছে, সেই হাতেই কামড় বসাচ্ছেন তিনি।’ট্রাম্প এবং জেলেনস্কির মধ্যে সংবাদমাধ্যমের সামনে বাদানুবাদকে ‘ঐতিহাসিক’ বলেও চিহ্নিত করেছে রাশিয়া।