• facebook
  • twitter
Saturday, 6 December, 2025

আমেরিকার বুকের ভেতরে বন্দি স্বাধীনতা

ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে আদিবাসী বা নেটিভ আমেরিকানদের প্রতি নীতি অনেক ক্ষেত্রেই বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

দ্যুতিমান ভট্টাচার্য

ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর দম্ভের গগনচুম্বি টাওয়ারের ওপর থেকে চিৎকার করছে— “মেক আমেরিকাগ্রেট এগেইন। “আমেরিকা— যে দেশ সারা পৃথিবীর কাছে স্বাধীনতার প্রতীক, যার পতাকার নীচে স্বাধীনতা যেন এক চিরন্তন অঙ্গীকার—ইউক্রেন, আফগানিস্তান, মায়ানমারে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ব্রতী—অথচসেই দেশের বুকেই আজও আছে এক জাতি, যাদের স্বাধীনতা কেবল ইতিহাসের পাতায় রয়ে গেছে। তারা এই ভূখণ্ডের প্রথম অধিবাসী—আমাদের কাছে পরিচিত “রেড ইন্ডিয়ান” নামে। এক সময় প্রকৃতির বুক চিরে, পাহাড়-নদী-প্রান্তরের সাথে সহাবস্থানে তারা ছিল অদম্য স্বাধীন। আজ তারা ‘রিজার্ভেশন’ নামের এক প্রাচীরঘেরা বন্দিশালায়। বাইরে থেকে যাকে উন্নত দেশের মানচিত্রে এক খণ্ড জমি মনে হয়, ভিতরে তার চিত্র—দারিদ্র্য, বেকারত্ব আর অনিশ্চয়তার ঘনঘটা। শহরের উজ্জ্বল আলোর আড়ালে লুকানো এক অন্য আমেরিকা।
ক্যালিফোর্নিয়া, নিউ মেক্সিকো বা সাউথ ডাকোটার বিস্তীর্ণ রিজার্ভেশন অঞ্চলে দেখা যায়, স্বাধীনতার চেয়েও বড় অভাব—সম্মানের অভাব। গড় পারিবারিক আয় জাতীয় গড়ের অর্ধেকও নয়, কাজের সুযোগ সামান্য, আর কলেজের ডিগ্রি পাওয়া যেন লটারির মতো বিরল। স্বাধীনতা কেবল রাজনৈতিক অধিকার নয়, তা অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত মুক্তিও বটে—আর সেখানেই এই প্রাচীন জাতির আজকের সবচেয়ে বড় সংকট।

Advertisement

দারিদ্র্য এখানে যেন চিরস্থায়ী পোশাক। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় দারিদ্র্যের হার যেখানে প্রায় ১২%, সেখানে অনেক রিজার্ভেশন অঞ্চলে তা ৫০% ছাড়িয়ে যায়। গড় পারিবারিক আয় প্রায় $৪০,০০০—যা জাতীয় গড়ের তুলনায় বহু নিচে। কর্মসংস্থান সীমিত, সুযোগ-সুবিধা প্রায় নেই বললেই চলে। শিক্ষা আরও এক করুণ চিত্র: কলেজ ডিগ্রি অর্জনকারীর সংখ্যা মাত্র ১৬%, যা স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান-অস্ত্র পাওয়ার সম্ভাবনাকে মারাত্মকভাবে সীমিত করে। স্বাধীনতা মানে শুধু রাজনৈতিক অধিকার নয়, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত মুক্তিও—আর সেখানেই এই জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় সংকট।

Advertisement

স্বাস্থ্য—যা স্বাধীন জীবনের অপরিহার্য ভিত্তি—সেখানেও ছবিটা মলিন। ‘ইন্ডিয়ান হেলথ সার্ভিস’-এর তহবিল থাকলেও বাস্তবে অনেক সময় হাসপাতাল কয়েকশো কিলোমিটার দূরে, ওষুধের অভাব, চিকিৎসক নেই পর্যাপ্ত। গড় আয়ু কমে যাচ্ছে, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ বাড়ছে। স্বাধীনতার নাম করে আজও তারা স্বাস্থ্যহীনতার শৃঙ্খলে বাঁধা।

এই বাস্তবতাকে নিখুঁতভাবে ধরেছে ওয়েব সিরিজ Reservation Dogs—যেখানে ‘আদিবাসী’ কিশোররা চাকরিহীনতা, হতাশা আর জীবনের অর্থহীনতার মধ্যে ভাসছে। স্বাধীন জীবনের স্বপ্ন তাদের জন্য যেন কোনওদিনই পূর্ণ হবে না। War Pony ছবিতে আমরা দেখি, কীভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলা বঞ্চনা ও নির্ভরশীলতা মানুষের স্বাধীন সত্তাকে ধীরে ধীরে গিলে ফেলে। বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার মারটিন স্করসেসের ছবি Killers of the Flower Moon আমাদের নিয়ে যায় ২০শ শতকের প্রথম ভাগে—ওসেজ উপজাতি, যাদের ভূমিতে তেলের ভাণ্ডার আবিষ্কার হয়েছিল, অথচ সেই সম্পদই তাদের জন্য অভিশাপে পরিণত হয়েছিল। লোভ, প্রতারণা আর হত্যা তাদের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিল, যা আজও অনেক রূপে বিদ্যমান।

এই অবস্থা একদিনে তৈরি হয়নি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভূমি দখল, ভঙ্গ প্রতিশ্রুতি, এবং একের পর এক সরকারি নীতি—যেমন Dawes Act বা Relocation Policy—আদিবাসীদের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে। আজও তারা যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে এক ‘নির্ভরশীল জাতি’ হিসেবে বেঁচে আছে, যেখানে নিজের ভূমি, সম্পদ, এমনকি সংস্কৃতির ওপরও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই।আজও তারা আমেরিকার ভেতরে এক ‘নির্ভরশীল জাতি’—যেখানে ভূমি, সম্পদ, এমনকি সংস্কৃতির ওপরও পূর্ণ স্বাধীনতা নেই।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে আদিবাসী বা নেটিভ আমেরিকানদের প্রতি নীতি অনেক ক্ষেত্রেই বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তাঁর প্রশাসন তেল ও গ্যাস পাইপলাইন সম্প্রসারণে জোর দেয়, যা বহু উপজাতীয় ভূখণ্ড ও জলাশয়ের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলেছে—বিশেষত ডাকোটা অ্যাক্সেস পাইপলাইন প্রকল্প, যা ২০১৬-১৭ সালে Standing Rock Sioux সম্প্রদায়ের তীব্র প্রতিবাদের কারণ হয়েছিল। ট্রাম্প প্রশাসন উপজাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে একাধিকবার আদালতে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে উপজাতীয় জমির মালিকানা ফেডারেল সরকারের অধীনে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেয়। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ফান্ড কাটছাঁটের প্রস্তাবও নেটিভ আমেরিকান সম্প্রদায়ের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এই নীতিগুলি কেবল অর্থনৈতিক নয়, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবেও নেটিভ সমাজকে আরও নির্ভরশীল ও প্রান্তিক করে তুলেছে।

কিন্তু গল্প এখানে শেষ নয়। স্বাধীনতা আদিবাসীদের রক্তে মিশে আছে। তারা এখনও তাদের ভাষা, গান, নৃত্য ও রীতিনীতির মাধ্যমে নিজের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রেখেছে। স্বাধীনতার গান আজও বাজে তাদের বাদ্যের তালে, নাচের ছন্দে, প্রার্থনার ধ্বনিতে। তরুণ প্রজন্ম ধীরে ধীরে শিক্ষার পথে এগোচ্ছে, রিজার্ভেশন থেকে বেরিয়ে এসে রাজনীতি, শিল্পও ব্যবসায় নিজের অবস্থান তৈরি করছে। এটি ধীর, কঠিন, কিন্তু অবিচল এক লড়াই— যেখানে স্বাধীনতা মানে শুধু শৃঙ্খলমুক্তি নয়, বরং নিজের ভাগ্যের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। স্বাধীনতা তাদের রক্তে, তাদের স্মৃতিতে, তাদের ভাষায়।
আমেরিকান নেটিভ সমাজের ভেতরে থেকেও যাঁরা জাতিগত গর্ব ও স্বাধীনতার স্বপ্নকে নতুন রূপ দিচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম স্টার্লিন হার্জো। ওকলাহোমায় জন্মানো এই ক্রি-সেমিনোল চলচ্চিত্র নির্মাতা তাঁর সিরিজ Reservation Dogs-এর মাধ্যমে বিশ্বদরবারে তুলে ধরেছেন রিজার্ভেশনের বাস্তব জীবন—হাসি, কান্না, ক্ষোভ, আর মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। হার্জোর কাজের বিশেষত্ব হল, তিনি নেটিভ আমেরিকানদের গল্প নিজের কণ্ঠে বলছেন, বাইরের দৃষ্টিতে নয়। তাঁর সৃজনশীলতা প্রমাণ করেছে, স্বাধীনতা কেবল রাজনৈতিক নয়—নিজের ইতিহাস বলার অধিকারও স্বাধীনতারই অংশ।

তাঁর পাশাপাশি আছেন বহু শিল্পী, লেখক ও কর্মী—যেমন জয় হার্জো, আমেরিকার প্রথম নেটিভ আমেরিকান “Poet Laureate”, যিনি কবিতার মাধ্যমে উপজাতীয় ইতিহাস ও আত্মপরিচয়ের লড়াইকে নতুন ভাষা দিয়েছেন। অথবা উইলমা ম্যানকিলার, চেরোকি নেশনের প্রথম মহিলা প্রধান, যিনি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। আজকের প্রজন্মে এমন বহু নেটিভ যুবক-যুবতী আছেন যারা রাজনীতি, ব্যবসা, পরিবেশ রক্ষা, এবং সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের মাধ্যমে নিজেদের সমাজকে ‘নির্ভরশীলতা’ থেকে বের করে আনার চেষ্টা করছেন। তাঁদের প্রত্যেকের পদক্ষেপ আমেরিকার বুকের ভেতরে স্বাধীনতার হারিয়ে যাওয়া ছন্দকে আবার ফিরিয়ে আনার লড়াই।

আমেরিকার ইতিহাস শুরু হয়েছিল এই ভূমির ওপর শ্বেতাঙ্গদের অবাধ পদচারণায়। স্বাধীনতা শুধু বইয়ের পাতায় বা সরকারের ঘোষণায় নয়—তা হবে কেবল তখনই, যখন ‘রেডইন্ডিয়ানদের’ সেই স্বাধীনতা ফেরত দেওয়া হবে—সম্মান, সমান সুযোগ, এবং আত্মমর্যাদার সঙ্গে।

Advertisement