আটটি রাজ্য নিয়ে গঠিত উত্তর-পূর্ব ভারত তথা আসাম, অরুণাচল প্রদেশ, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা, মেঘালয়, সিকিম ও মিজোরাম। তবে সিকিম ব্যতীত বাকি সাত রাজ্যকে মূলত সেভেন সিস্টার্স বা সাত বোন বলেই অভিহিত করা হয়। প্রত্যেক রাজ্যই যে নিজস্ব ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষা বজায় রেখেছে, তা অবশ্য কখনওই অগ্রাহ্যনীয় নয়। আমার এই ভ্রমণকে এক শিক্ষণীয় ভ্রমণ হিসেবেই মনে করি। কারণ এর দরুন আমি অসমের সংস্কৃতিকে, তার কলা ও বিজ্ঞান উভয় বিভাগকেই বেশ সুন্দরভাবে উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছিলাম।
কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস সকাল সকাল পৌঁছে দিল গুয়াহাটি। কিছুক্ষণ সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় ছিলাম। তারপর রাস্তার স্টলে লুচি সবজি খেয়ে দশটা নাগাদ রওনা দিলাম অসম স্টেট মিউজিয়ামের দিকে। ১৯৫৩ খ্রীস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় এই ‘অসম রাজ্যিক সংগ্রহালয়’। ভেতরে গিয়ে দেখলাম কলা বিভাগের অন্তর্গত উত্তর-পূর্ব ভারতের বস্ত্র, নানা ভাষার সাহিত্য ও ঐতিহাসিক পাণ্ডুলিপি, যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র, চিত্র, অভিলেখ, মুদ্রা, প্রাক ও আদি ঐতিহাসিক তথা পোড়ামাটির, কাঠের ও ধাতুর ভাস্কর্য, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, নৃত্য, অসমের গ্রামীণ দৈনন্দিন জীবন, ঘরবাড়ি ও চাষবাস, মুক্তি যোদ্ধাদের মূর্তি, হস্তশিল্পের কারুকার্য এবং প্রাকৃতিক ইতিহাসের মতো আরও কয়েকটি ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী সম্পদ সংগৃহিত ও সংরক্ষিত রয়েছে।
অতঃপর রওনা দিলাম অনতিদূরে দিঘালিপুখরি জলাশয়ের দিকে। সেখানে দুটি প্যাডেল বোট ভাড়া করে সকলে দীর্ঘক্ষণ কাটালাম। তারপর রওনা দিলাম শ্রীমন্ত শঙ্করদেবা কলাক্ষেত্রের অভিমূখে।
টিকিট কেটে প্রবেশ করলাম কলাক্ষেত্রের অন্তরে। দেখতে দেখতেই নেমে এল প্রদোষ। মন্থরে অন্ধকার ছেয়ে ফেলল পুরো আকাশ। এমনই এক পরিবেশে চোখে ভেসে উঠল চমৎকার এক দৃশ্য। এক পুষ্করীণির মধ্যে গানের তালে মত্ত হয়ে নেচে চলেছে নানারঙের ফোয়ারা। তার মধ্যভাগে রয়েছে ছোট একটি সেতু। ঠিক রাজ্য মিউজিয়ামের মতো আরও এক মিউজিয়াম ভ্রমণ করলাম তার মধ্যেই। এখানে অসম রাজ্যের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে অবশ্য আরও বিস্তারিত জানতে পারলাম।
ফেরার পথে দেখি একদিকে অন্ধকার যেমন ঘনিয়ে আসছে অপরদিকে আকাশে চনমনে চাঁদও উঠেছে। তারা মিটমিট করছে। যেতে যেতেই কানে ভেসে এল ঢোলকের তাল, গানের সুর, নৃত্যের ছন্দ। ছুটে গেলাম সেই ছন্দ আর সুরকে অনুসরণ করে। পৌঁছে স্বচক্ষে দেখছি ঝুমুর নাচে মেতে উঠেছে এক মাঠ ভর্তি মেয়ে। নৃত্য শেষে ঢোলক-ভায়ারা শ্রান্ত শরীরকে একটু বিশ্রাম দিতে কচি ঘাসের উপরেই বসে পড়ল। তাদের কথাবার্তায় বুঝতে পারলাম যে, তারা প্রতিযোগিতার জন্য অনুশীলন করছে এবং তারা আদিবাসী গোষ্ঠীর। সকলেই চায়ের চাষবাস করে থাকে। এককথায় বলা যায় এই কলাক্ষেত্রটিতে নানা প্রকার সাংস্কৃতিক উৎসব ছাড়াও, বিভিন্ন কলা ও সাহিত্য অনুষ্ঠানও আয়োজন করা হয়। সেই থিয়েটারে বিহুর মতো রাজ্যের ঐতিহ্যবাহী নৃত্য, লোকসঙ্গীত, চিত্রকলা প্রভৃতি প্রদর্শন করা হয়।
গুয়াহাটি ভ্রমণের সময় একটি লক্ষণীয় বিষয় হল এর ভাষা। হ্যাঁ, অসমিয়া ভাষা ঠিক বাংলার মতোই। পার্থক্য কেবল দুই তিনটি অক্ষরে। বাংলায় আমরা ‘র’ বর্ণকে ব-এর নীচে একটা বিন্দু দিয়ে লিখি কিন্তু অসমিয়া ভাষায় র-কে, ব-এর মধ্যে পেট কেটে লেখা হয়। কিন্তু এই ভাষায় বাংলার র বর্ণের মতো দেখতে অন্য কোনো বর্ণ নেই। এছাড়াও লক্ষ্য করলাম, এই ভাষার লিপিমালায় রয়েছে ৱ, বর্তমানের বাংলা ভাষা ও লিপিমালায় যার প্রয়োগ নেই বললেই চলে। আর এই অক্ষরটি অসমিয়া লিপিমালায় অন্তর্ভুক্ত থাকায়, বর্ণ সংখ্যা বাংলার চেয়ে একটি বেশি হয়ে ৫২ দাঁড়িয়েছে। ব্যাকরণগত দিক দিয়েও রয়েছে এই দুই ভাষার মধ্যে চরম মিল। সংস্কৃতি, সাহিত্য, দৈনিন্দিন জীবন, আচার-আচরণ, কৃষ্টির মধ্যেও রয়েছে দুই রাজ্যের অনেক সাদৃশ্য।