• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

লাওয়াপানির পথে…

'অপরূপ আনন্দের হাট চাদ্দিকে। তনভীর হুঁশ ফেরাল। আবার চলা। এবার রাস্তা ঘন সবুজের রঙমহলে পাল্টে যাচ্ছে। কাছাকাছি কোন‌ও জনপদ চোখে পড়ছে না।'

আজ এই সকাল বেশ অন্য আলোয় বোনা। কুয়াশা নেই। নেই ম্যাজমেজে ঘুমঘোর। তনভীর ঠিক আটটায় এসে হাজির। বলল, স্যার, চলুন? উঠে পড়লাম টমেটো ডিজায়ারে। গাড়ি দাপটে ছুটছে। আজ আলাদা রুট। এন এইচ/১৪৩-এ। পরিষ্কার পিচমোড়া রাস্তা। এ রুট গিয়েছে গুমলা থেকে লোহারদাগা হয়ে কুরু। লোহারদাগা এখান থেকে ৫২ কি.মি.। আমরা যাচ্ছি আর‌ও আর‌ও দূরে। এত আলো চারপাশে। এত গাছগাছালি। দু’ধারে সবুজের উষ্ণ আলাপ। ভিজছি। ভিজতে ভিজতে চলা। দেখছি। চুপ আখরে লেখা সুন্দরকে। এই হেমন্ত আলোর বাউল হয়ে টানছে উধাওপুরের ধুলোয়।

দেখতে দেখতে কখন যে ৫২ কি.মি. রাস্তা ফুরিয়ে এসে পড়লাম লোহারদাগায়। কে বলবে এ জনপদ বুনো। লোহারদাগা বাজারপল্লির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। এখন বেলা ১০টা। জমজমাট স্বরগরম বাজার। একটা দোকানের সামনে তনভীর গাড়ি দাঁড় করাল। উদ্দেশ্য, জলখাবার। খেলাম। সঙ্গে চা পান। তারপর আবার চাকায় গড়ানো। দেখতে দেখতে ৭ কি.মি. পথ পেছনে ফেলে পৌঁছলাম বগড়ুতে। বগড়ু বিখ্যাত বক্সাইট খনির জন্য। চাদ্দিকে পাহাড় পাহাড়। সামনে অবারিত সোনালি ধানের গল্প। ওই দূরে দেখছি, একটা পাহাড়ের মাথা থেকে পরপর ট্রলিতে নীচে নেমে আসছে বক্সাইট পাথর। যাচ্ছে ২০ কি.মি. দূরে লোহারদাগা। লম্বা রোপ‌ওয়ে। বেশ অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে দেখলাম।

Advertisement

অপরূপ আনন্দের হাট চাদ্দিকে। তনভীর হুঁশ ফেরাল। আবার চলা। এবার রাস্তা ঘন সবুজের রঙমহলে পাল্টে যাচ্ছে। কাছাকাছি কোন‌ও জনপদ চোখে পড়ছে না। শুধু রকমারি গাছপালা। এরা আমার চোখে অচিন সবুজের মায়া ছাড়া অন্য কিছুই নয়। অপরিচয় এখানে কোন‌ও বাধা না, বরং অজানার ঘোরে সাজিয়ে নিচ্ছি আমার ভেতরটুকু। নৈঃশব্দ্যের আল্পনায় কী নিপুণ করে আঁকা এ তল্লাট। রাস্তা এখন আর‌ও আর‌ও নির্জন। স্তব্ধ বনস্থলি। মেটে ভুবনের একতারায় বাজছে আশ্চর্য বেলার গৎ। একসময় একটা আওয়াজের সামনে থমকে দাঁড়ালাম। ঝরনা। ঝোর। নাম তার কেকরঙ।

Advertisement

ছোট্ট অথচ উল্লাসদোলায় দামাল। সামনে যাওয়াই যায়। চলে গেলাম। নেমে আসছে কেকরঙ জলের কেকাধ্বনি নিয়ে। দেখছি। দেখছি। জলবিন্দু ছিটে স্নানে অন্তর ভেজাচ্ছি। পাঠক, এখানে এলেই বোঝা যায় আমদের যে জীবন জীবিকার নগরযাত্রা তা চাতকের গল্প হয়ে কেন বারেবারে পালাতে চায় এমন আলোর মাতলামি দেখতে। বিভোর ছিলাম। আবার তাড়া খেলাম তনভীরের। যাচ্ছি। সামনে। খুব খুউব নিবিড় হয়ে আসছে সবুজ গেরস্থালি। মাটিতে বুনো জলসা আর মাথার ওপর নীল খেলছে আকাশ। হেমন্ত এখন মুখর চুপগানে। দেখতে দেখতে পৌঁছলাম পেশরার গাঁয়ে। দু-একটা মাটির কুঁড়ে টপকে এবার পায়ে পায়ে সেই অঝোরতলিতে। উন্মাদ জলসংহারের জীবনকথা দেখতে যাচ্ছি। লাওয়াপানির রূপকথা। দাঁড়িয়েছি লাওয়াপানির টপে। ছুটে আসছে সে।

একটা জায়গায় দেখছি, লাওয়াপানির জলের গ্রাসে তলিয়ে গিয়েছে একটা পার্ক। সামান্য মাথা তুলে সে ডুবির সাক্ষী একটা বিশ্রাম বেঞ্চি। তনভীর বলল, এবারের অতিবৃষ্টিতে এমন হাল হয়েছে। ঝোর তার গতিপথ পাল্টে ফেলে অজস্র ধারায় নীচে নেমে যাচ্ছে। তনভীর সামনে। আমি ওর পেছনে। একটা জায়গায় সামান্য একটা বোল্ডার টপকাতে গিয়ে হড়কে পড়লাম। না। তেমন কিছু না। ডানপায়ের বুটটা ভিজে গেল। কুছ পরোয়া নেহি। তনভীর বলল, আইয়ে, থোড়া দেখকে! দু’হাতে বুনো ঝোপের ডাল ভাঙতে ভাঙতে পায়ের তলায় নুড়ির চুমু মাখতে মাখতে নীচে আর‌ও নীচে নেমে যাচ্ছি। কানে ভেসে আসছে গতি লহরি আর সামনে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে লা-জবাব লাওয়াপানি। দেখতে দেখতে কিভাবে যে সামনে চলে গেলাম লাওয়াপানির! ঝরনা তো এই সামান্য জীবনে কম দেখিনি৷

চিত্রকোট, তমাসিন, লোধ, কাঞ্চনজঙ্ঘা, সুরকাইঘাগ। এমন অনেক। কিন্তু লাওয়াপানির কাছে এসে মনে হচ্ছে এ এক অনন্যা জলপরী। অনিশ্চুপ লোরের আলাপে লাবণ্যময়ী এক নির্ঝরিণী। বেপরোয়া। উদ্দাম জলপসরা উজার করে সে বুঝি ভেসেছে মহাসাগরের তরঙ্গযাত্রায়। স্তব্ধ আমি। হতবাক আমি। এই এত কাছে হাতের নাগালে স্বর্গ! ছুঁয়ে ফেললাম টুক করে। এ অবকাশ কি বারবার পাওয়া যায়? না। তাই অধরার আলিঙ্গন মেখে নিচ্ছিলাম। ওদিকে আকাশে কখন যেন অকাল মেঘের বাজনা বাজছে। তনভীরের ঠেলায় ওপরে উঠতে শুরু করলাম। ওঠা-নামা যে অনেকখানি। খিদে ভুলে তেষ্টা ভুলে চলার চাকায় মজে আছি। থাক না। একটা দিন নাই-বা হলো রুটিন খাওয়া।

এবার ফেরার রাস্তায় কোনও একটা অন্য মেঠো পথে ডিজায়ারের চাকা গড়াচ্ছে। কে জানে কোথায় চললাম। এখন বেলা ৪টে। হাওয়ায় কথা বলছে হৈমন্তী শীত। ক্লান্তি দখল নিচ্ছে চোখের। একজায়গায় তনভীর গাড়ি থামিয়ে বলল, স্যার, মেলা ঘুমেঙ্গে। বললাম, কিস চিজ কা মেলা? ও বলল, এ আদিবাসী মেলা, কালীপূজা মে চলতা হ্যায় সাত দিন তক। নেমে পড়লাম তড়াক করে গাড়ি থেকে। মেলা। গেঁয়ো পরব। অনার্য ভারতীয়দের সুন্দর মিলনের এ তীর্থ। সে মেলা না দেখে ফিরি কেমন করে! বিশাল এক ছড়ানো ধানমাঠ জুড়ে হাজারো মানুষ ঝুমধুমে মেতে। ধামসা মাদল নিয়ে নারী-পুরুষ একসঙ্গে গাইছে। তার‌ই তালে তালে নাচ চলছে। এর নাম ভুয়াং। ওড়িশার কেওনঝরে দেখেছি একবার। তবে এখানে এত্ত বড়ো খোলা চত্বরে এমন ভুবন টলানো আমোদপুর চোখের সামনে এই প্রথমবার দেখছি। এ গ্রামের নাম গামারিয়া।

এখানে প্রত্যেক বছর এই সময় এই সাঁওতাল মেলা বসে। প্যান্ডেল খাটানো মঞ্চের সামনে গিয়ে কর্মকর্তাদের কাছে জেনে নিলাম এ মেলা কেন হয়। এ মেলা এদের কাছে অস্তিত্ব রক্ষার এক লড়াই। আদিবাসী সমাজের অধিকার আদায়ের আশ্চর্য ঘোষণা এই মেলা। আমি কিভাবে যেন মিশে গেলাম ওদের সঙ্গে। কোমর আমার আপনি তালে দুলে উঠল। পায়ে পায়ে কখন যেন ওদের‌ই একজন হয়ে গেলাম। যে গানের ভাষা জানি না, যে নাচের মুদ্রা থেকে আমার চলন বহু বহু দূরে সেই মহোৎসবে নিজেকে ওদের‌ই আত্মজন মনে হলো।

তনভীর যে কোথায় হারিয়েছে এই ভিড়ে! চাদ্দিকে তাকিয়ে দেখছি। সব্বাই ডুবে আনন্দভাসানে। শিশু যুবক যুবতী প্রৌঢ় পুরুষ মহিলা একসঙ্গে এক সহবতে বাঁধা। এই বুঝি হৃদয়ডাঙার মেলা। সূর্য ডুবুডুবু। আঁধারের উঁকিঝুকি পশ্চিম পাড়ায়। মেলার মূল মঞ্চে গিয়ে মাইক বাগিয়ে হাঁক দিলাম, তনভীর, তুম কাঁহা হো, ভাই? সে হাঁক ফিরে আসছে সহস্র ডাক নিয়ে… আমি তোমাদের‌ই লোক… তুমি আমাদের‌ই। কতক্ষণ এই দশায় কাটল জানি না। একসময় দেখলাম… ডিজায়ার আবার ছুটছে। আবার। আবার‌ও। আরেক জ্বরের খোঁজে।

Advertisement