• facebook
  • twitter
Tuesday, 19 August, 2025

বাংলার বুকে এক টুকরো বৃন্দাবন

আড়ংঘাটা এক প্রাচীন জনপদ। এর পশ্চিমদিকে বয়ে গিয়েছে চূর্ণি নদী। এই নদীর ধারের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ যুগলকিশোর মন্দি...লিখেছেন নন্দিতা মিত্র।

খলিলুর রহমানের মতো ‘মধ্যে মাঝেই মনটা বলে, ঘরখানা আজ পুড়িয়ে দিই/ খাঁচায় রাখা পাখিটাকে হঠাৎ করেই উড়িয়ে দিই।/ একতারাটা হাতে নিয়ে, অচিন পথে বেরিয়ে পড়ি/ চৈত্রদিনের দমকা হাওয়া, জড়িয়ে বুকে বন্ধু গড়ি।/ বাউল গানের উদাস সুরটা, তার পিঠেতেই চড়িয়ে দিই/ ঘূর্ণিঝড়ে উড়ছে যা সব বুকের মাঝে জড়িয়ে নিই/ উড়াল দেব চড়ুই হয়ে ঘুলঘুলিটার ফোকর দিয়ে/ হারিয়ে যাব দূর আকাশে, সূর্যটাকে ঠোকর দিয়ে।’

নানা বৈচিত্র্য, নানা রঙ নিয়েই জীবনের বৃহৎ যাত্রাপথ। জোয়ার-ভাটার মতো এখানে বয়ে যায় নিত্য-নতুন ঘটনা, অনুভূতি আর ধূলি-ধূসরিত জীবনে একের পর এক সঞ্চিত হতে থাকে নানা অভিজ্ঞতা। বিদেশ-বিভুঁই নয়, ঘরের কাছেই আছে এমন সব মন্দির, স্মৃতি-স্মারক, দিঘি, বৃক্ষ— যার প্রতিটি স্থানেই চাপা পড়ে রয়েছে অনেক গল্প, বহু কাহিনি। এই জায়গাগুলির কোনও কোনও স্থানে পৌরাণিক কাহিনির সঙ্গে ইতিহাস এমনভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে যে কোনটা কাহিনি আর কোনটা ইতিহাস তা আলাদা করা যায় না। ইতিহাস বা কাহিনির টানে যাঁরা এইসব জায়গায় চলে যান তাঁরা এমন ভ্রমণে অনেক অজানা জিনিস খুঁজে পান। আমাদের সোনার বাংলার আনাচে-কানাচে মণিমুক্তো ছড়িয়ে রয়েছে, আছে নানা দেব-দেবীর মন্দির আর তাদের কেন্দ্র করে বিস্মৃত সেই সব ইতিহাসকে খুঁজে দেখতে মাঝে মাঝেই বেরিয়ে পড়ি এদিক-সেদিক। এসব জায়গায় যাওয়ার জন্য আগাম কোনও পরিকল্পনার দরকার হয় না, নেই আগাম টিকিট কাটা বা হোটেল বুকিং করার টেনশন। ভ্রমণসঙ্গী! নাহ এমন ভ্রমণে তারও প্রয়োজন নেই। ব্যাগে এক বোতল জল, বিস্কুট বা কেকের মতো কিছু আহার্য বস্তু আর সেই জায়গা থেকে রসদ সংগ্রহ করে লিখে রাখার মতো একটা ডায়েরি আর পেন নিয়ে অদম্য ইচ্ছেশক্তিতে ভর করে মনের পালে হাওয়া লাগিয়ে বেরিয়ে পড়লেই হল। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে-গঞ্জে যাওয়ার জন্য আর কিছু না হোক অটো, টোটো, রিক্সা পাওয়া যাবেই, আর নেহাত যদি কপাল মন্দ হয় তাহলে শ্রীচরণযুগলের ওপর তো ভরসা করতেই হবে! শীতের হিমেল হাওয়ায় খেঁজুরের গুড়ের মাদকতার গন্ধ নিয়ে হঠাৎ একদিন ঘুরতে গিয়েছিলাম ঘরের খুব কাছেই থাকা এমন একটি জায়গায় যেখানে কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’-র অপুর মা সর্বজায়াও ঘুরে এসেছিলেন।

শিয়ালদহ-গেদে লাইনে রানাঘাটের কয়েকটি স্টেশনের পর আড়ংঘাটা এক প্রাচীন জনপদ। এর পশ্চিমদিকে বয়ে গিয়েছে চূর্ণি নদী। এই নদীর ধারের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ যুগলকিশোর মন্দির। অনেকটা দূর থেকে দেখা যায় মন্দিরের প্রবেশতোরণ। তিনরত্ন বিশিষ্ট সুন্দর এই তোরণের একদম ওপরে আছে রাধাকৃষ্ণের একটি বিগ্রহ, ঠিক তার নিচে অবস্থান গৌর-নিতাইয়ের, দুপাশে আছে দুটি সিংহ, তার নিচে বিষ্ণুর দ্বাররক্ষক জয় আর বিজয়ের মূর্তি। বর্তমানে এই মন্দিরটি দেখতে বেশ সুন্দর হলেও প্রাচীনকালে এখানে তালপাতার কুঁড়েঘর ছিল। সেই কুঁড়েঘর থেকে আজকের এই মন্দিরে রূপান্তরিত হওয়ার পিছনে একটি ইতিহাস এবং লোকগাথা মিশে আছে। জনশ্রুতি বৃন্দাবন থেকে আসা বিহারের বাসিন্দা নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি গঙ্গারাম দাস বর্ধমানের সমুদ্রগড়ে বসবাস করতেন। ভগবান কৃষ্ণের সেবা আর ভজনা করেই তাঁর দিন কাটছিল। কিন্তু প্রাণের ঠাকুর মূরলীধরকে কাছ থেকে দেখার জন্য একদল তীর্থযাত্রীর সঙ্গে একবার চলে যান বৃন্দাবনে। সেখানে গিয়ে বংশীবদনকে দেখে তাঁর মনে ইচ্ছে জাগল এমনই একটা মূর্তি তিনিও নিজের বাড়িতে রাখবেন। কিন্তু ভাবনা আর তাকে বাস্তবে রূপদান করার মধ্যে যে আকাশ-পাতাল ফারাক! কোনও উপায় খুঁজে না পেয়ে আকূল নয়নে কেঁদে প্রভুর কাছেই প্রার্থনা জানান বৃন্দাবনে তিনি নানারকম লীলা করেছেন। তাই গঙ্গারামকে যেন খালি হাতে ফিরতে না হয়! দিন যায় আর গঙ্গারাম তাঁর পরম আরাধ্য দেবতার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। অবশেষে দৈববাণী শুনে একদিন প্রত্যুষে যমুনা নদীতে স্নানের সময় একটি কষ্টিপাথরের শ্রীকৃষ্ণের কিশোর বিগ্রহ পেয়ে সেই মূর্তি নিয়ে চলে আসেন সমুদ্রগড়ে নিজের বাড়িতে আর নিত্যসেবা করতে থাকেন কিশোরজির।

কিন্তু হঠাৎই বাংলার আকাশে নেমে আসে দুর্যোগের ঘনঘটা। ১৭৪০ সালে সারা বাংলা জুড়ে বর্গীদের হামলা শুরু হয়। নিষ্ঠুর, নির্দয় বর্গীরা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে, লুঠপাট করে, সাধারণ নিরীহ মানুষদের হত্যা করে চারিদিকে এক ভয়াবহ পরিবেশের বাতাবরণ তৈরি করে। লোকজন প্রাণভয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে পালিয়ে যেতে থাকে বিভিন্ন জায়গায়। গঙ্গারাম দাসও তাঁর পূজিত কিশোরজির বিগ্রহ নিয়ে চূর্ণী নদীর ধারে আড়ংঘাটায় চলে আসেন তাঁর পরিচিত রামপ্রসাদ পাঁড়ের কাছে। রামপ্রসাদের পূজিত বিগ্রহ গোপীনাথজির মন্দিরের পাশে একটা কুঁড়েঘর বানিয়ে তাতে গঙ্গারাম কিশোর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে পুজো করতে থাকেন। কিন্তু গঙ্গারামের মনে হতে থাকে কিশোরজির জন্য আলাদা একটি মন্দির তৈরি করতে পারলে বেশ ভালো হত। বন্ধু রামপ্রাসাদকে সেকথা বলেন। রামপ্রসাদ ছিলেন নদিয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজকর্মচারী ও তাঁর অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। তিনি মহারাজাকে খুব ভালো করেই চিনতেন আর জানতেন যে গরিব দুঃখীদের সাহায্যকারী মহারাজ কখনোই গঙ্গারামকে খালি হাতে ফেরাবেন না। তাই রামপ্রসাদ বন্ধু গঙ্গারামকে নিয়ে গেলেন রাজদরবারে। মহারাজ সব শুনে মন্দির নির্মাণ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন।

এমন করেই বেশ কয়েকদিন চলল। এরপর হঠাৎ আরেকদিন কিশোরজি গঙ্গারামকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন, তাঁর প্রাণসখা শ্রীরাধিকাকে ছাড়া তাঁর একা একা এ মন্দিরে থাকতে ভালো লাগছে না। শ্রীরাধিকাকে তিনি কোথায় পাবেন সে জায়গার সন্ধানও দিয়ে দিলেন। শ্রীকৃষ্ণ বললেন, “আমার শ্রীরাধিকা আছে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে”। রামপ্রসাদই আবারও বার্তাবাহক হিসেবে উপস্থিত হন মহারাজের কাছে। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রও আশ্চর্যান্বিত হয়ে জানান তিনিও একই স্বপ্নাদেশ পেয়েছেন যে তাঁর বাড়ির মধ্যেই শ্রীরাধিকা অবরুদ্ধ হয়ে রয়েছেন! তাঁকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেন মুক্তি দেওয়া হয়! শুরু হল খোঁজাখুঁজি। যেখানে কিংবদন্তি সেখানে নানা গল্পরাও শাখা-প্রশাখা মেলে ছড়িয়ে যায়। এই রাধারানিকে খুঁজে পাওয়াকে কেন্দ্র করেও নানা মত প্রচলিত আছে। কারও মতে রাজার একটি ঘরে রাধারানির ছবি টাঙানো ছিল, সেখানে দেওয়াল খুঁড়ে বের করা হয়। কারও মতে রাজপ্রাসাদেরই কোনও একটি আবদ্ধ ঘর থেকে এই মূর্তি পাওয়া যায়। তবে জনশ্রুতি যাই হোক না কেন, রাজবাড়ি থেকেই অষ্টধাতুর রাধারানির একটি মূর্তি পাওয়া যায়। মহারাজ স্থির করলেন, এই মূর্তি তিনি আড়ংঘাটার মন্দিরে পাঠাবেন। কিন্তু রাধারানি যে রাজার দূহিতা! তাঁকে তো আর সাধারণভাবে পাঠানো যায় না! তাই প্রথমে তিনি আড়ংঘাটার মন্দিরটিকে নতুন করে অপূর্ব পঙ্খের কারুকাজ করে পাঁচটি খিলানযুক্ত অলিন্দ ও গর্ভগৃহ দু’জায়গাতেই উঁচু ভিতের ওপর এক বড়সড় মন্দির নির্মাণ করালেন। তারপর এক জাঁকজমকপূর্ণ শোভাযাত্রা করে তাঁর কন্যা রাধারানিকে নানা বস্ত্রালংকারে সজ্জিত করে চতুর্দোলায় চাপিয়ে বিয়ের তত্ত্বের মতো পোশাক, গহণা, ফলমূল, মিষ্টি, শাঁখা, সিঁদূর, আলতা ইত্যাদি নানা দ্রব্য সম্ভারে সাজিয়ে বিভিন্ন লোক-লস্করের সাহায্যে এবং বাজনা বাজিয়ে আড়ংঘাটার মন্দিরে পাঠিয়েছিলেন। সবার আগে একদল মহিলা উলুধ্বনি আর শঙ্খধ্বনি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। রাস্তার দু’ধারে আশেপাশের সব গ্রামের মানুষজন সাক্ষী ছিল সেই বিস্ময়কর শোভাযাত্রার। মন্দিরের যুগলকিশোর বিগ্রহের নিত্যসেবা ও সারাবছর জুড়ে নানা অনুষ্ঠানের খরচ বহন করার জন্য মহারাজ ১২৫ বিঘা জমি দেবোত্তর করেন দানপত্র করে। জনশ্রুতি সেই দানপত্র নাকি এখনও মন্দিরের কোনও এক স্থানে গোপনে সুরক্ষিত আছে। এই মূর্তিকে ঘিরে আরও একটি কাহিনি প্রচলিত আছে। যুগলকিশোরের সবচেয়ে বড় মন্দির মধ্যপ্রদেশের পান্নায় অবস্থিত। পান্নার চতুর্থ বুন্দেলা রাজা হিন্দুপত সিং তাঁর রাজত্বকালে ১৭৫৮ থেকে ১৭৭৮ সাল পর্যন্ত তৈরি করেছিলেন। কিংবদন্তি অনুসারে, এই মন্দিরের গর্ভগৃহে স্থাপিত মূর্তিটি বৃন্দাবন থেকে আনা হয়েছিল। তবে এর কোনও প্রামাণ্য নথি নেই। পুরোটাই জনশ্রুতি। আড়ংঘাটার যুগলকিশোরজির গায়ের অলঙ্কার এবং পোশাক বুন্দেলখণ্ডি শৈলীর সঙ্গে অনেকটা মিল রয়েছে। মন্দিরে একটি নাটমণ্ডপ, ভোগমণ্ডপ এবং একটি প্রদক্ষিণ পথসহ বুন্দেলা মন্দিরের সমস্ত স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

ব্যুৎপত্তির দিক থেকে দেখলে জানতে পারি ‘আড়ং’ শব্দের অর্থ মেলা। এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসে মেলা হয়। প্রকৃতপক্ষে এই মেলার নাম ছিল ‘যুগলকিশোর মেলা’, কিন্তু দূর-দূরান্ত থেকে জামাই-মেয়ের জন্য মানত করতে এবং আশীর্বাদ নিতে আসার কারণে ক্রমশই ‘জামাইষষ্ঠীর মেলা’ হিসাবেও পরিচিত হয়েছে। মন্দির প্রাঙ্গণে আছে একটি বকুল গাছ যা ‘সিদ্ধ বকুল’ নামে পরিচিত। মন্দিরের এক সেবাইতের কাছ থেকে জানতে পারলাম প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো এই বকুল গাছের নিচে মহারাজ নিজে উপস্থিত থেকে পুরোহিত দিয়ে মহা সাড়ম্বরে পুজো করে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীরাধিকার যুগল মূর্তি। ১৭২৮ সালে আড়ংঘাটায় প্রতিষ্ঠিত হয় মন্দিরের পঙ্খ অলংকৃত ও পাঁচটি ফুল কাটা খিলানের দুই সারি যুক্ত প্রশস্ত দালান মন্দির। মন্দিরগাত্রে বিভিন্ন পটচিত্র আর অনেক কলকার কারুকাজ রয়েছে। যুগলকিশোরের স্থান কারুকার্যময় একটি সিংহাসনে, যা পুরো পরিবেশকে আলোকিত করে রাখে। প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসে মন্দিরকে কেন্দ্র করে মেলা বসে। মেলার সময় এখানে প্রচুর লোক সমাগম হয়। রাতে বাউল গানের আসর বসে। অনেক দর্শনার্থী মেলায় এসে রাত্রিবাস করে পর দিন ঘরে ফেরে। একসময় পূর্ণদাস বাউল আর তাঁর সম্প্রদায় আসতেন বাউল গান পরিবেশন করতে। মন্দিরের প্রবীণ সেবায়েতদের কথায়, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত এই যুগলকিশোর মন্দির রাধাকৃষ্ণের মিলনের সাক্ষী, নবদম্পতি কিংবা যুগলদের মনস্কামনা পূর্ণ করার পীঠস্থান। জামাইষষ্ঠীর দিন এই মন্দিরের বকুল গাছে ঢিল বেঁধে পুজো দিলে নাকি মনের ইচ্ছা পূরণ করেন রাধাকৃষ্ণ! তাই প্রতিবছরই জামাইষষ্ঠীর দিন শতাব্দী প্রাচীন যুগলকিশোর মন্দিরে ষষ্ঠীপুজো উপলক্ষে ভিড় করেন বিভিন্ন বয়সি দম্পতিরা। মন্দির প্রাঙ্গণে থাকা সিদ্ধবকুল আজও শোনায় কিশোর কৃষ্ণ আর রাধারানির জোড় বাঁধার কাহিনি। ধূপ-ধুনোর গন্ধ, ঢাকের আওয়াজ আর গৃহিণীদের উলুধ্বনিতে গমগম করে ওঠে গোটা মন্দির প্রাঙ্গণ।  মহিলাদের বিশ্বাস যুগলকিশোর দর্শন করলে তাঁরা এজন্মে তো বটেই, পরজন্মেও বিধবা হবেন না। এই প্রার্থনা মনে নিয়েই ভিড় জমান তাঁরাও। ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর…।’

মন্দির প্রাঙ্গণে গেলে মন যেমন শান্ত হয়, তেমনই এখানে ধরা পড়ে পুরাণের ছোঁয়া। দু’পাশের দেওয়াল জুড়ে দশাবতারের চিত্র বারবার স্মরণ করায় বাংলার লোকসংস্কৃতির কথা। বৈষ্ণব সংস্কৃতির নিদর্শন হিসেবে মন্দির প্রাঙ্গণের চার কোণে চারটি তুলসী মঞ্চ রয়েছে। মন্দিরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও রাধিকার যুগলমূর্তি ছাড়া আরও মূর্তি পূজিত হয়। যার মধ্যে রয়েছে কালাচাঁদ, গোপীনাথ, শ্যামচাঁদ, রাধাবল্লভ, গোপীবল্লভ, শালগ্রামশিলা, বলরাম, রেবতী, সাক্ষীগোপাল, বালগোপালসহ বিভিন্ন মূর্তি এবং প্রায় ৬০০-র বেশি নারায়ণ শিলা। মন্দিরের শ্রীকৃষ্ণ মূর্তিটি কষ্টিপাথর দ্বারা নির্মিত। তবে সেবাইতের অভাবে সব মূর্তিকে বর্তমানে একটি ঘরে রাখা হয়েছে। জ্যৈষ্ঠ মাসের শুধুমাত্র এই সময় বিগ্রহদের চরণ দর্শন ও স্পর্শ করতে দেওয়া হয়। মন্দিরের পিছনদিকে বাঁধানো ঘাটের ধারে একটি ছোট শিবমন্দির আছে। তবে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার অন্যান্য নানা জায়গার মতো যুগলকিশোরের মেলাও ক্রমশই তার প্রাচীন ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলছে। অতীতের গৌরবময় ইতিহাস আর কিংবদন্তি বর্তমান প্রজন্মের বিস্মৃতির অন্তরালে চলে যেতে বসেছে। মন্দিরের বিগ্রহগুলোর নিত্যদিন দেখাশোনা করার মতো প্রয়োজনীয় লোকও নেই। প্রাচীন এই মন্দিরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবি এই স্থবির স্তম্ভ, খিলান, দেওয়ালের ভিতর দিয়ে সময় আজও চুপিসারে হেঁটে যাচ্ছে। নিঃশব্দে নিরুত্তাপ এক স্মৃতি হয়েই সমস্ত রাজকীয়তা নিয়ে একাকী দাঁড়িয়ে আছে পাঁচটি খিলানযুক্ত দেওয়াল জুড়ে সুন্দর পঙ্খ অলংকারের কাজের এই মন্দির। ঐতিহ্যমণ্ডিত মন্দিরটির প্রতি যদি সঠিকভাবে দৃষ্টি দেওয়া হত তাহলে নিঃসন্দেহে পর্যটকদের মধ্যে নদিয়ার একটি উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারত।