চিড়িয়াখানার খাঁচায় আটকে থাকা প্রাণীদের দেখা এবং তাদের প্রাকৃতিক আবাসস্থলে তাদের দেখার রোমাঞ্চের মধ্যে, একটি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। আপনি যদি জঙ্গলে যান, তখন একটি গভীর অনুভব হয় যে, মানুষ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী নয়। বান্দিপুর জাতীয় উদ্যানে যদি দেখেন যে, কোনও চিতাবাঘ অবাধে তার রাজকীয় ভঙ্গিতে ঘোরাফেরা করছে- তাহলে অবাক হবেন না। কারণ এটা তাদেরই সাম্রাজ্য। এখানে, ফিসফিস করে গাছ কথা বলে নিজেদের মধ্যে। ঝাঁঝালো বন্য গন্ধের সঙ্গে আপনি আবিষ্কার করবেন নাম না জানা লতা, গুল্ম, ফুল- যা আপনার আত্মায় চিরকালের জন্য ছাপ ফেলে যাবে।
ভারতবর্ষে যতগুলি ন্যাশনাল পার্ক রয়েছে, তার মধ্যে সৌন্দর্যে শীর্ষ স্থানে রয়েছে বান্দিপুর ন্যাশনাল পার্ক। বান্দিপুর জাতীয় উদ্যান ব্যাঙ্গালোর থেকে মাত্র পাঁচ ঘণ্টার পথ। আপনার নিজের গন্তব্য থেকে ব্যাঙ্গালোর ভ্রমণ করে আপনার অভিযান শুরু করুন। মোটামুটি আপনি যদি বিকেল ৪টে নাগাদ ব্যাঙ্গালোর ছেড়ে যান, রাত সাড়ে আটটার মধ্যে বান্দিপুরে পৌঁছে যাবেন। দ্বিতীয় একটি বিকল্প পথও আছে। মাইসোর থেকে বান্দিপুরের দূরত্ব মাত্র ৮০ কিলোমিটার এবং উটি থেকে ৭০ কিলোমিটার। সরকারি বাস, প্রাইভেট বাস এবং ট্যাক্সি যোগাযোগ রয়েছে মাইসোর থেকে।
বহু ধরনের বৃক্ষরাজিতে পরিপূর্ণ এই অঞ্চল। তার মধ্যে প্রধান টিক এবং রোজউড। বাঘের সংখ্যার নিরিখে, বান্দিপুর জাতীয় উদ্যান ভারতের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। এছাড়াও ভাল্লুক, মুগারস, ইন্ডিয়ান রক পাইথন, চার শৃঙ্গযুক্ত মৃগ, ধূসর ল্যাঙ্গুর, প্যান্থার, জংলি কুকুর, শুয়োর, অ্যান্টিলোপ, চিতল, সম্বর, বার্কিং ডিয়ারের দেখা মেলে। হাতির সংখ্যা প্রচুর। হাতির দলের দেখা না পেয়ে এখান থেকে কাউকে ফিরে আসতে শোনা যায় না। সরীসৃপের মধ্যে পাইথন, কিং কোবরা, র্যাট স্নেক, গ্রিন পিট ভাইপার হামেশাই চোখে পড়ে। জলাশয়গুলিতে দু’শোর উপরে পাখির দেখা পাওয়া যায়। কুইলম, মালাবার গ্রে হর্নবিল, ট্রোগান, ব্লুউইং প্যারাকিট ইত্যাদি আরও বহু পাখির দেখা মেলে এখানে, যা পৃথিবীর কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না।
এই জঙ্গলের অন্যতম আকর্ষণ হিমাবাদ গোপালস্বামী বেট্টা (পাহাড়) মন্দির। পার্কের সর্বোচ্চ শিখরে (১৪৫৪ মিটার) এই মন্দির অবস্থিত এবং এখান থেকে পুরো বান্দিপুরের অপার্থিব সৌন্দর্য পাখির চোখে দেখা যায়। বান্দিপুরের সংরক্ষিত এলাকার বুক চিরে বয়ে গেছে মোয়ার, কাবিনি এবং নুগু নদীর জলধারা। একসময় মাইসোরের মহারাজাদের প্রিয় মৃগয়াক্ষেত্র ছিল এই বান্দিপুর। এখানে যাওয়ার সবথেকে ভালো সময় হল অক্টোবর থেকে মার্চ। বান্দিপুর টুরিজম বোর্ডের ‘জঙ্গল বাড়ি’ আছে পার্কের ভিতর। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের গেস্ট হাউসেও থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে বেশিরভাগ পর্যটকই মাইসোরে থেকে একদিনের জন্যে গাড়ি ভাড়া করে ঘুরে আসতে পছন্দ করেন।
কর্ণাটকের পশ্চিমঘাট পর্বতমালার কোলে নীলগিরির গায়ে মাইসোর-উটি হাইওয়ের উপর, চামরাজনগর জেলায় অবস্থিত এই পার্কটির আয়তন ৮৭ স্কোয়ার কিলোমিটার। তামিলনাড়ুর মুদুমালাই বণ্যপ্রাণী সংরক্ষণ, কেরলের ওয়েনাড বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং উত্তরে নাগারহোল ন্যাশনাল পার্ক, বান্দিপুরের সঙ্গে যোগ হয়ে- একত্রে ভারতের সবথেকে বড় প্রাণী সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে। একবার ঘন জঙ্গলের সবুজে ঢুকে পড়লে, আপনার ইন্দ্রিয়কে তীক্ষ্ণ সজাগ রাখুন। হয়তো কোনও বাঘ নিঃশব্দে লুকিয়ে থাকতে পারে মাত্র কয়েক হাত দূরেই। বনের ফিসফিস শব্দ শুনুন, কারণ প্রকৃতিই আপনাকে এমনভাবে সতর্ক করে দেয়, যা আপনি কখনও কল্পনাও করতে পারবেন না।