• facebook
  • twitter
Sunday, 8 December, 2024

ভাস্কো দা গামা

ভাস্কো দা গামা ছিলেন একজন পর্তুগিজ পর্যটক। তাঁর জন্ম আনুমানিক ১৪৬০ খ্রিস্টব্দে। ইউরোপ থেকে ভারতে আসার সমুদ্রপথ আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষে সমুদ্রপথে ভারতে আসেন। ১৪৯৮ সালের ২০ মে ভারতের কালিকটে পৌঁছান তিনি। তখন কালিকটের রাজা ছিলেন জামোরিন। ভাস্কো দা গামাকে সংবর্ধনা জানান তিনি। সেই ভাস্কো দা গামার ছোটবেলা থেকে জীবনের নানান কাহিনি ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ছন্দা বিশ্বাস।

ভাস্কো দা গামা। আনুমানিক চিত্র

গত সপ্তাহের পর

নানা আনুষ্ঠানিক কর্মের মধ্য দিয়ে জাহাজ ছাড়লেন ভাস্কো দা গামা এবং তাঁর দলবল। স্বয়ং রাজা এসেছিলেন সেদিন তাঁদের যাত্রা করাতে। তুমুল হর্ষধ্বনির ভিতর দিয়ে জাহাজ বন্দর ছাড়ল। ৮ জুলাই একেবারে ঝকঝকে পরিষ্কার রৌদ্রোকরোজ্জ্বল দিনে সকাল সকাল তারা লিসবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। জলের উপরে ধীর গতিতে এগিয়ে চলল সাও গাব্রিয়েল। সাও রাফায়েল। মালবাহী বোরিও জাহাজ আসছে পিছনে। সকলেই দারুণ উল্লসিত। ভাস্ক দা গামা সকলকে বলেছেন মনে আনন্দে নিয়ে কাজ করতে আর সকলের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজা রাখতে। নিজেদের ভিতরে যেন অহেতু কোনো ঝামেলা ঝঞ্ঝাট না বাধে। আর সর্বোপরি চোখ কান খোলা রাখতে। জলে নানান বিপদ আপদ যে কোনও সময়ে উঁকি মারতে পারে। সেদিকে সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। নতুন পথ, কিছুই চেনা নেই, তাই সকলেই সাবধান!
ভাস্কো দা গামা তার সঙ্গী নাবিকদের আগেই বলে রেখেছিলেন তেনেরিফা এবং ভারিডি অন্তরীপের দ্বীপসমূহ হয়ে আফ্রিকার উপকূল বরাবর পথ অতিক্রম করতে হবে। সেইমতো তিনি নাবিকদের সামনে একটা পুরানো দিনের ম্যাপ খুলে দিলেন। যে পথে এর আগে কয়েকজন আফ্রিকান নাবিক পাড়ি দিয়েছিলেন। এবং তাঁরা রীতিমতো সফল হয়ে নিজের দেশে ফিরে আসেন। খুবই গোপনে তিনি এই ম্যাপ সংগ্রহ করেছেন।

সারাটা দিনের ক্লান্তিতে ভাস্ক দা গামা তাঁর বিশ্রামকক্ষে এসে একটু বিশ্রাম নিচ্ছেন। জানালা দিয়ে দেখতে পাচ্ছিলেন দূরে উপকূল রেখা। সবুজ নারকেল গাছের সারি। মাথার উপরে ঝকঝকে নীলাকাশ। ঢেউয়ের মাথায় শাদা ফেনার মুকুট। জল কেটে কেটে এগিয়ে চলেছে তাঁর স্বপ্নের জাহাজ। নিজের মনের মতো করে সাজিয়েছেন তাকে। এই একটি বছর যাতে কোনোরকম স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব না ঘটে। তিনি তেমন ভোগবিলাসী ছিলেন না, কিন্তু স্বাচ্ছন্দ্য তো দরকার। তাঁর কক্ষটি রীতিমতো রাজকীয় ভাবে সাজান। অত্যাধুনিক কোনো হোটেলের বিলাস কক্ষের সমতুল বলা যেতে পারে। চোখ বন্ধ করে কাউকে এই কক্ষে নিয়ে এলে সে বুঝতেই পারবে না জলে নাকি স্থলে আছেন। বাহারী পর্দা, দামী গালিচা, গদি আঁটা বসার জায়গা। তাকিয়া বিছানা, তার ব্যবহৃত জিনিস পত্রে আভিজাত্যের ছোঁয়া। আর হবে নাই বা কেন? তিনি তো আর যে সে মানুষ নন। এই মুহূর্ত্যে পর্তুগালের সব চাইতে বিখ্যাত এবং দামী মানুষদের ভিতরে একজন।

ভাস্কো দা গামা দামী সুরা পাত্র থেকে এক পেগ পানীয় ঢেলে নিলেন। তারপর কিছু কাজু, কিশমিস,কিছু আলমন্ড আর য়্যাফ্রিকট একটু একটু করে মুখে দিয়ে খেতে লাগলেন। আস্তে আস্তে পান পাত্র থেকে এক সিপ করে পানীয় পান করতে লাগলেন।
ইউরোপের সব চাইতে দামী হুইস্কি পান করতেন তিনি।

সেদিন তাঁর মনে দারুণ আনন্দ। চোখে লেগে আছে খুশীর ছোঁয়া। যত তিনি এগোচ্ছেন ততই তাঁর মনে আনন্দের প্রকাশ দেখা যাচ্ছে। তিনি সুরাপাত্র থেকে বেশ কয়েক সিপ টেনে তাকিয়াতে ঠেস দিয়ে আয়েশ করতে লাগলেন।
ঢেউয়ের দুলুনিতে সুরার নেশায় এবং ক্লান্তিতে তাঁর দুই চোখ মুদে এলো।
ভাস্কো দা গামা গভীর নিদ্রায় ডুবে গেলেন।
যখন তাঁর ঘুম আস্তে আস্তে পাতলা হয়ে এল তখন তিনি একটা মধুর স্বপ্ন দেখলেন।

দেখলেন তিনি যেন এক স্বপ্ন রাজ্যে এসে পৌঁচেছেন। সেই দেশটা যেন আগাগোড়া সোনা দিয়ে মোড়া। মাটি গাছ পালা সব কিছুই সোনার। যে রাজার অনুগ্রহ লাভ করেছেন সেই রাজার গোটা প্রাসাদটি সোনা দিয়ে তৈরি। রাজার সিংহাসনটি বহু মূল্যবান রত্নরাজি এবং সোনা দিয়ে তৈরি। রাজ মুকুটে শোভা পাচ্ছে অগণিত হীরে। কী তাদের দ্যুতি। ভাস্কো দা গামার খুব শখ হল যদি অমন একটি সিংহাসনে তিনি বসতে পারতেন। আর অমন মুকুট মাথায় দিয়ে রাজ্য শাসন করতেন তবে কী ভালোই না হতো।
এইসব সুখকর দৃশ্য দেখতে দেখতে অনেকটা বেলা হয়ে গেলো।

যখন তাঁর ঘুম ভাঙলো দেখলেন নাবিকেরা নিজেদের ভিতরে বেশ হল্লা করছে। সকলেই দারুণ ফূর্তিতে আছে। ভাস্ক দা গামা নাবিকদের কাছে এলেন। দেখলেন তাঁর নির্দেশিত পথ ধরেই তারা চলছে।


সাও গাব্রিয়েলকে নিয়ে নাবিকেরা উপকূল বরাবর অগ্রসর হতে লাগলেন।
ভাস্কো দা গামার সঙ্গে ছিল বার্থালোমিউ দিয়াজের বর্ণিত পথ নির্দেশ। সেই সব নির্দেশ পথ খুব মনযোগ দিয়ে দেখে, চিহ্নিত করে তারা এগিয়ে গেলেন।

প্রথম দিকে তাঁরা সকলে বেশ খোশ মেজাজে ছিলেন। নিজেদের ভিতরে ঠাট্টা তামাশা, পরস্পরের কাছে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার গল্প বলে দিন কাটালেন।

নাবিকদের ভিতরে একজন শোনালেন তাঁর নিজের এক অভিজ্ঞতার কাহিনি। রোমহর্ষক সেই কাহিনি।
‘সেবার তাঁরা পর্তুগাল থেকে অ্যাজরস দ্বীপের দিকে যাচ্ছিলাম। লিসবন বন্দর থেকে মাঝারি মাপের একটা জাহাজ ছেড়েছিল। তবে জাহাজটার গতি আমাদের জাহাজের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। জাহাজটা লম্বায় এই ধরো ১২০ ফুট এবং ওজনে প্রায় ৩০০ টন ছিল। প্রায় একই সময়ে আমাদের জাহাজ ওই জাহাজটার সঙ্গে যাত্রা শুরু করল। কয়েক দিন চলার পরে প্রায় আমরা যখন বারমুডা ট্রাঙ্গেলের দিকে যাচ্ছি সেই সময়ে দেখা গেল জাহাজটাকে। কেমন যেন সন্দেহজনক মনে হল। মহাসাগরের উপরে আস্তে আস্তে চলছে। এলোমেলো তার গতি। দেখে মনে হচ্ছে কোথায় যাচ্ছে সে নিজেই জানে না। জাহাজের সব পাল খাটানো আছে। পালগুলো বাতাসে ফুলে ফুলে উঠছে। কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো দিকে যাচ্ছে না। আমাদের ক্যাপ্টেন ছিলেন হার্ডস। তিনি কয়েকজনকে নির্দেশ দিলেন কয়েকটা নৌকা নিয়ে দেখে আসতে ব্যাপারখানা কী।

আমরাও দেখেছি ওই জাহাজে ক্যাপ্টেন তার বৌ বাচ্চা নিয়ে উঠেছিলেন।
কিন্তু আমাদের লোক সেখানে গিয়ে দেখল জাহাজে কেউ নেই।’

‘হতে পারে কোনো যান্ত্রিক গোলোযোগ ঘটেছিল।’

একজন পাশ থেকে বলে উঠলেন।

‘উহু, আমাদের লোক গিয়ে দেখেছে জাহাজের কোনো ত্রুটি নেই, কোনো যান্ত্রিক গোলযোগ কিছুই ঘটেনি। নাবিক থাকলে এখনি সেটা চলা শুরু করত।’

‘তাহলে দেখো কোনো জলদস্যুরা আক্রমণ চালিয়েছিল কিনা।’

অপর একজন তার অনুমানটা ছুঁড়ে দিল।

‘নাহ, তার কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি। জাহাজটা যে জলদস্যুর কবলে পড়েছিল তার কোনো প্রমাণ নেই। কোনো হিংস্রতার চিহ্ন নেই, সব কিছু একেবারে ঠিকঠিক জায়গায় সাজানো ছিল। খাবার, পানীয়, পিপেভর্তি অ্যালকোহল ভাঁড়ার ঘরে যেমনটি মজুত ছিল তেমনটাই আছে। এমনকি রান্না করা খাবার প্রস্তুত ছিল। দেখে মনে হচ্ছিল এখনি সকলে আহার সারবে। টেবিলে পানীয়ের গেলাস পর্যন্ত সাজানো ছিল। একজন দাড়ি কামাচ্ছিল তার শেভিং ব্রাশে শেভিং ক্রিম পর্যন্ত লাগানো ছিল। ক্যাপ্টেনের ঘরে ঢুকে দেখা গেল তাঁর বাচ্চাকে হয়তো পত্নী দুধ খাওয়বার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিলেন ঠিক সেইভাবে সেই দুধের বোতলে দুধ ভর্তি ছিল। পাশের ডেকে বাচ্চাদের কিছু জামাকাপড় শুকাতে দেওয়া ছিল। ক্যাপ্টেনের স্ত্রীর গয়নার বাক্সের গয়নাগুলোতে কেউ হাত দেয়নি। সব তেমনই আছে শুধু মানুষগুলোই নেই।’
‘সমুদ্রে কি কোনো ঝড় উঠেছিল?’
‘নাহ, তাও নয়, আমরা যদিও একশো মাইল পিছনে ছিলাম কিন্তু এই জাতীয় খবর ছিল না।’

‘দেখো নাবিকেরা কেউ কেউ বিদ্রোহ করেছিল কিনা। এরকম তো আগেও শুনেছি নাবিকেরা বিদ্রোহী হয়ে ক্যাপ্টেন এবং তার বৌ বাচ্চাকে মেরে নিজেরা পালিয়ে গেছে।’

‘না তারও কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি। কোনো রক্তের দাগ নেই। মৃতদেহগুলোকেও কেউ ভাসতে দেখেনি।’
‘তাহলে কী হয়েছিল বলে তোমার মনে হয়?’

‘সেটাই তো আশ্চর্যের। কেউ বলছে একটা ডুবোজাহাজ থেকে নাকি কামান দাগা হয়েছিল, তার ফলে জাহাজটাতে ধোঁয়ায় ভরে যায় আর তারা প্রাণ বাঁচানোর জন্যে জলে ঝাপ দেয়। আবার কেউ বলেছে অনেক সময়ে

অ্যালকোহলের পিপেতে আগুন ধরে গেলে জাহাজে বিস্ফোরণের সম্ভাবনা থাকে। সেটাও হতে পারে বিস্ফোরণের ভয়েই হয়তো তারা পালিয়েছে।’

‘সে তো বুঝলাম, কিন্তু এরকম ঘটনা ঘটলে সবার আগে ক্য্যাপ্টেন বন্দরে এসে জানাবে সেই ঘটনা। কিন্তু আজ পর্যন্ত তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।’

নানান কথোপকথনের ভিতর দিয়ে সাত দিন কেটে গেলে। তাঁরা একদিন সিয়েরা লিয়ন উপকূলে পৌছুলেন। এরপর তাঁরা মুক্ত সাগরের দক্ষিণ দিকের পথ ধরে বিষুবরেখা অতিক্রম করে আটলান্টিকের পশ্চিম দিকের পথ অনুসরণ করলেন। এই পথের সন্ধান দেন বার্থালোমিউ দিয়াজ।

ভাস্কো দা গামা তাঁর দলবল নিয়ে ৪ নভেম্বর আফ্রিকা উপকূলের তটরেখায় আসেন। এতে তাঁদের তিন মাস অধিক সময় লেগে গেল। ভাস্কো দা গামার কাছে এটি হল দীর্ঘতম সমুদ্র অভিযান।

১৬ ডিসেম্বর তাঁরা পার হলেন বিশাল এক নদী। যেটি ‘মৎস নদী’ নামে খ্যাত। যাকে ভৌগলিকেরা বলেন ‘প্রাচ্যের অন্তরীপ’। সেই নদী পার হয়ে ডায়াস ফিরে আসেন। এবং ডায়াস থেকে পাড়ি দিলেন এক অজানা সমুদ্র পথে। ভাস্কো দা গামা জানতেন না তাঁরা কোথায় এসে পৌছেছেন। তখন ছিল খ্রীষ্ট মাস। তাই ভাগবান যীশুকে স্মরণ করে তার নামকরণ করলেন, ‘নাটাল’। পর্তুগীজ ভাষায় যার মানে হল— ‘যীশুর জন্ম।’

আফিকার সাও ব্রাস উপকূলের কাছে আসার আগেই হঠাৎ ভাস্ক দা গামার কানে এল একটি দুঃসংবাদ।
গনকাল নানস যে জাহাজটির দায়িত্বে ছিলেন সেখান থেকে একজন ক্রু দ্রুত একটি নৌকায় চেপে সংবাদটি দিতে এসেছেন। জাহাজটি তাঁদের থেকে বেশ একটু পিছিয়ে আসছিল। তিনি জানতে পারলেন সেই মালবাহী জাহাজ যার নেতৃত্বে ছিলেন গনকাল নানস সেটিতে হঠাৎ করে আগুন লাগে। (ক্রমশ)
(ক্রমশ)