গত সপ্তাহের পর
কথাটা শোনা মাত্র সকলে চমকিত হলেন। সর্বনাশ! এখন কী উপায়? তাদের তো এবারে অনাহারে সকলকে মরতে হবে?
কী কারণে আগুন লাগল সেটা পরে ভাবা যাবে। এখন জাহাজটিকে রক্ষা করা যায় কিনা এবং তার ভিতরে ছয় সাত মাসের যে সকল খাদ্য খাবার মজুত করা আছে তার কিছু মাত্র উদ্ধার করা যায় কিনা ভাবলেন ভাস্কো দা গামা।
দ্রুত তিনি ক্রুদের নির্দেশ দিলেন এক্ষুনি দ্রুত নৌযানে চেপে সেখানে পৌঁছুতে হবে। বেশ কিছু নৌকাসহ দক্ষ ক্রুদের পাঠিয়ে দিলেন।
Advertisement
তারপর তিনি দূরবীণ হাতে নিয়ে ডেকের উপরে উঠে এলেন। বহুদূর থেকে থেকে দেখা যাচ্ছিল আগুনের কালো ধোঁয়ার কুন্ডলী পাক খেয়ে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। বাতাসে ভেসে আসছে পোড়া অ্যালকোহলের গন্ধ। ভাস্কো দা গামা বুঝতে পারলেন যে করেই হোক মদের কাউন্টারে আগুন ছড়িয়েছে। আর কোনো উপায় নেই। এবারে গোটা জাহাজটাকে গ্রাস করে ফেলবে অগ্নিদেব। নিমেষে ভস্মীভূত হবে তাঁদের বাঁচাবার সমস্ত রসদ।
মাত্র কয়েক মিনিট আগের কথাগুলো ভাবছিলেন তিনি।
Advertisement
১০
গনকাল নানস কতটা দক্ষতার সঙ্গে কিছুমাত্র সময় নষ্ট না করে যে ছোটো নৌকা করে একজন খালাসিকে পাঠিয়ে দিলেন সাও গাব্রিয়েলের উদ্দেশে। যে করেই হোক সংবাদটা ভাস্কো দা গামার কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
খানিকটা সময়ের ভিতরে সেই নৌকাই ফিরে এল কয়েকজন ক্রুর সঙ্গে করে।
এই ছোটো নৌকাটি ছিল অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতি সম্পন্ন। আর নৌকা চালক অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে খালাসিকে নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব গাব্রিয়েলের দিকে ধাবিত হয়েছিল। খালাসির হাতে একটা নিশানা ছিল। ভাস্কো দা গামা এবং কয়েকজন নাবিক তখন অন্য কয়েকজন নাবিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তাঁরা সেই নিশানা দেখতে পেয়ে শঙ্কিত হলেন এবং ভাবলেন নিশ্চয়ই তাঁদের অন্য কোনো জাহাজ বিপদে পড়েছে।
সংবাদটা দ্রুত তাঁর কানে আসায় ভাস্কো দা গামা নীচে এসে লক্ষ্য করলেন নাবিকদের কথা সত্যি। এটি মালবাহী জাহাজের নিশানা।
তৎক্ষণাৎ ক্যাপটেনকে নির্দেশ দিলেন জাহাজের গতি কমাতে।
কিছু সময়ের ভিতরে ছোটো নৌকাটি তাঁদের জাহাজের কাছে এল এবং বড়ো জাহাজ থেকে একটা মই নেমে এল নৌকার কাছে।
খালাসি নিদারুণ দক্ষতার সঙ্গে তরতর করে সেই মই বেয়ে জাহাজে উঠে এল। ভাস্কো দা গামার কাছে আগুন লাগার ঘটনাটা জানাল। এই অবস্থায় কী করণীয় সেটাও জানার জন্যে গনকাল নানস তাকে পাঠিয়েছে সেটাও ব্যক্ত করল।
ভাস্কো দা গামা নাবিক এবং খালাসিদের নির্দেশ দেন ছোটো ছোটো নৌকায় করে মালবাহী জাহাজ থেকে খাদ্যসামগ্রী অন্যান্য জাহাজগুলোতে নেওয়া হোক। সেই মর্মে অন্য জাহাজগুলোতেও সতর্কবার্তা পাঠানো হল।
ছোটো নৌকাটি দ্রুত ফিরে গেল।
ভাস্কো দা গামা বুঝতে পারছেন না কতটা জিনিস উদ্ধার করা গেল। সেই সঙ্গে এটাও ভাববলেন, জিনিস যায় যাক, তাঁর সহকর্মীদের যেন কিছু না হয়।
সকলে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সেই জাহাজ থেকে খাদ্যসামগ্রী যতটা পেরেছে ছোটো ছোটো নৌকাতে ভরে অন্য তিনটি জাহাজে পাঠিয়ে দিয়েছে। তা সত্ত্বেও প্রচুর জিনিস নষ্ট হয়েছে।
ভাস্কো দা গামা দেখতে পেলেন বিরাট এক আগুনের শিখা আর ধোঁয়ার কুন্ডলী। কিছুটা সময় পরে শুনতে পেলেন প্রচন্ড এক শব্দ।
তিনি এবং অন্য জাহাজের সকলে চমকে উঠলেন সেই শব্দে।
ভাস্কো দা গামা বুঝতে পারলেন মালবাহী জাহাজটাতে বিস্ফোরণ ঘটল।
অ্যালকোহলের কাউন্টারে আগুন লাগলে তার থেকে বাঁচার উপায় থাকে না।
কীভাবে যে এই দুর্ঘটনা ঘটল খুঁজে বের করতে হবে। কে এমন অদূরদর্শী কাজ করতে পারল। পিপেগুলো তো খুবই সুরক্ষিত থাকে। বিশ্বস্ত কর্মী ছাড়া সেখানে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। গনকাল নানসকে তিনি তো ভালো করেই চেনেন। সে যে এ কাজ করেনি সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত। তাহলে বিপদটা ঘটালো কে?
তাহলে কি তাদের পিছনে অন্য কোনো জাহাজ আসছে?
এমন ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। কোনো শত্রু জাহাজ খুবই সংগোপনে তাদের টার্গেট করেছে তারপরে হয়তো গোলা ছুঁড়ে জাহাজটাতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু বেরিও এর পিছনেও তো একটা জাহাজ থাকার কথা। তাদের সকলকে নজরদারি করার জন্যে বেশ কিছু নিরপত্তা রক্ষী আছে। তারা কী করছে?
হাজার প্রশ্নচিহ্ন উঁকি মারছে ভারাক্রান্ত গামার মনে। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না।
গনকাল নানসের সঙ্গে সাক্ষাৎ না হওয়া পর্যন্ত কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
এরপর নাটালে বেশ কিছুটাদিন কাটিয়ে তাঁরা ২ রা মার্চ এলেন মোজাম্বিক। এখানে তাঁরা ২৯ মার্চ পর্যন্ত সময় কাটালেন। এটি ছিল ভারত মহাসাগরের বাণিজ্যিক অঞ্চলের একটি। এর পূর্বে ভারত মহাসাগর, উত্তরে তানজানিয়া, পশ্চিমে জিম্বাবোয়ে এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে সুইজারল্যান্ড। এর একটি অংশ ছিল পূর্ব আফ্রিকার উপকুলবর্তী অঞ্চল। মুসলমানদের প্রাধান্য এখানে।
ভাস্কো দা গামা এখানে জাহাজ ভেড়ালেন।
নাবিকেরা বেশ ক্লান্ত ছিলেন। তাঁরা চাইছিলেন এখানে কিছুদিন কাটাতে।
কিন্তু কয়েকদিনের ভিতরে অনেকেই সেটা ভালো চোখে দেখল না। নাবিকেরা বন্দর সংলগ্ন অঞ্চলে বাজার ঘাট করত খুব সাবধানে। বন্দরে নতুন কোনো জাহাজ এবং হঠাৎ বিদেশীদের আগমন ঘটলে স্বভাবতই সেই জায়গার সকলের মনে নানান প্রশ্নের উদয় হয়। অনেকেই যে তাঁদের প্রতি সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছে সেকথা জাহাজের ক্রু এবং অন্যান্য কর্মচারীরা বুঝতে পেরে ভাস্কো দা গামার কাছে জানালেন।
ভাস্কো দা গামা বুঝতে পারলেন এখানকার মুসলিমরা খ্রিস্টানদের উপরে আক্রমণ করতে পারে। তিনি তখন একটা কৌশল বার করলেন।
একদিন নানান উপঢৌকন নিয়ে ভাস্কো দা গামা কয়েকজন নাবিককে সঙ্গে করে মোজাম্বিকের রাজার কাছে গেলেন এবং সুলতানের শরণাপন্ন হলেন।
ভাস্কো দা গামার কাছে সেই সময়ে উপহার স্বরূপ মূল্যবান কিছু ছিল না যাতে সুলতানের মন জয় করা যায়।
সুলতানের সত্যি সেই উপহারে মন ভরল না। উপহার সামগ্রীর ভিতরে না আছে সোনা, হীরে, মুক্তা, না দুষ্প্রাপ্য কিছু। সুলতান এবং স্থানীয় বাসিন্দারাও ভাস্কো দা গামার প্রতি সন্দেহ পোষণ করতে লাগল। তাঁর কপালে ভাঁজ পড়ল। তিনি তাঁর ভাষায় কথা বলে গেলেন আর ভাস্কো দা গামা তাঁর নিজের ভাষায়। কেউই কারো কথা বুঝতে পারলেন না। তবে এটা বুঝতে পারলেন সুলতান তাঁদের উপরে মোটেও সন্তুষ্ট নন।
সুলতানের কথাবার্তা মোটের উপরে সুবিধাজনক বলে মনে হল না। ভাস্কো দা গামার মনে হল, সুলতান তাঁদের বন্দী করতে পারেন যে কোনো সময়ে।
পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ভাস্কো দা গামা তাঁর দলবলকে দ্রুত জাহাজে ওঠার নির্দেশ দিলেন। এবং যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে জাহাজের নোঙর তোলার নির্দেশ দিলেন।
ভাস্কো দা গামার নির্দেশ মতো সকলে কাজ করতে লাগল। সবে দ্বিপ্রহারিক আহারের বন্দোবস্ত করছিল পাচক। তার সাহায্যকারীরা স্থানীয় বাজার থেকে ক্রয় করা গো মাংস রান্নার জন্যে ব্যস্ত ছিল। রান্না প্রায় শেষের পথে। সেই অবস্থায় তাঁদের চুলা নিভিয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে নিতে হল। আগে প্রাণ তারপর না হয় বেঁচে থাকলে খাওয়া-দাওয়া করা যাবে।
সকলেই যখন জাহাজে উঠে যেতে প্রস্তুত এর ভিতরে একদল মুসলমান তাদের উপরে হামলা করার জন্যে এগিয়ে এল। ভাস্কো দা গামার দলের সঙ্গে তাদের হাতাহাতি, মারামারি বেধে গেল। দুই পক্ষই যুযুধান। কেউই কম যায় না। ভাস্কো দা গামার দলের অনেকেই আহত হলেন। মারামারি করতে গিয়ে স্থানীয় কিছু মুসলমান লোকও গুরুতরভাবে জখম হল। রক্তাক্ত হল মোজাম্বিক বন্দর। খবরটা সুলতানের কানে গেল।
একজন নাবিক তখনও বাইরে ছিল। ভাস্কো দা গামা বারে বারে তার খবর নিতে লাগলেন। সেই নাবিক ছদ্মবেশে ঘুরে ঘুরে সংবাদ সংগ্রহ করছিল। সে এসে খবরটা দিল, সুলতানের লোক আসছে তাদের ধরে নিয়ে যাবার জন্যে।
সংবাদটা পাওয়া মাত্র ভাস্কো দা গামা সকলকে নির্দেশ দিলেন দ্রুত গুছিয়ে নিতে।
অনেকেই সেই সময়ে বাইরে ছিল। জাহাজের কর্মচারীরা যুদ্ধকালীন তৎপরতায় জিনিসপত্র গুছিয়ে সকলকে নিয়ে দ্রুত জাহাজে উঠে গেল।
ভাস্কো দা গামা এই ঘটনায় অত্যন্ত অপমানিত এবং ক্রুদ্ধ হলেন। জাহাজ বন্দর থেকে ছেড়ে যাবার ঠিক পুর্ব মুহূর্তে তিনি এর প্রতিশোধ-রূপ মোজাম্বিক শহরে গুলিবর্ষণ করে গেলেন।
(ক্রমশ)
Advertisement



