কল্যাণ গঙ্গোপাধ্যায়
‘জোজো, বাজারে চল।’ বিজনমামা বলতেই আমি ব্যাজার মুখে বললাম, ‘মাছ আনবে?’
‘শুধু মাছ! সঙ্গে অনেককিছু। ফর্দ হাতে ধরিয়ে দিয়েছে তোর দিদিমা। নাতিকে খাওয়াবে।’
‘মাছের বাজারে ওরা জল ছেটাতে থাকে, আমার ভালো লাগে না। তা ছাড়া এই শীতে!’
‘আমারও বাজারে যেতে ভালো লাগে না। কি করবো! বলেছে যখন যেতে হবেই। চল গরম জিলিপি খাওয়াবো।’
Advertisement
বিজনমামা কলেজ ছেড়ে এখন কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়ছে। আমি সামনের বছর উচ্চমাধ্যমিক দেবো। ছোটমামাকে আমার খুব ভালো লাগে।
বিজনমামা মাছওয়ালাকে বলল, ‘তোমার সঙ্গে দরকারি কথা আছে।’
‘কোনও কথা হবে না বাবু। মাছ একেবারে ফাস্টোকেলাস।’
‘আমি তোমার ফাস্টোকেলাস মাছ চাই না। রদ্দি মাছ আছে?
‘কী আশ্চয্যি!’
‘আমার বাড়িতে যারা এসেছে, ওদের তাড়াতে চাই। রদ্দি মাছই লাগবে। রদ্দি মাছগুলি একদিকে করো।’
মাছওয়ালা তড়িঘড়ি তাই করল। বিজনমামা বলল, ‘তুমি ভালো মাছগুলি থেকে আমাদের বাড়ির লোকের জন্য দু’টো ভালো মাছ ওজন করো।’
দু’টি মাছ ওজন করে কেটে গুছিয়ে মাছওয়ালা সবুজ ব্যাগে দিয়ে বলল, ‘এবার রদ্দি মাছগুলি কোন ব্যাগে দেব।’
বিজনমামা বলল, ‘লাল ব্যাগে। এই ভালোমাছের দাম কত হল?’
‘পাঁচশো দশ। আপুনি পাঁচশোই দেবেন। রদ্দি মাছ ক’টা তুলবো বাবু?’
‘ফোনটা আবার বাজে কেন?’ পকেট থেকে ফোন বের করে বিজনমামা বলল, ‘কী বললে? মাছ নিতে হবে না? আমি তো কিনে ফেললাম। এখন ফেরত দিতে পারবো না। একটু আগে বলবে তো।’ এই কথা বলে একটা পাঁচশো টাকার নোট এগিয়ে দিল।
‘বাবু ফোনে শব্দ নাই?’
আমি বললাম, ‘না। কাঁপুনি আছে।’
বিজনমামা আমার পিঠ আলতো করে ছুঁয়ে আদর করল। তারপর সবজি বাজারে কেনাকাটা করল। ব্যাগ ওজনদার হয়ে উঠেছে। বিজনমামা বলল, ‘একটু কষ্ট কর। রিকশা করে বাড়ি ফিরবো।’
Advertisement
কেনাকাটা হয়ে গেলে বিজনমামা বলল, ‘এবার দুটো ঝামেলার সাবজেক্ট আছে। মোয়া আর পাটালিগুড় কেনা। আমার মা তার আদরের নাতিকে মোয়া, পিঠে, পায়েস খাওয়াবে। তুই আমার আদরের ভাগ্নে। তোকে খাওয়াবার জন্য আমি মোয়া আর পাটালি গুড় কেনার মতো মহান যুদ্ধযাত্রায় যেতে রাজি।’
আমরা একটা মোয়ার দোকানের সামনে দাঁড়ালাম। সেখানে বড় বড় করে লেখা জয়নগরের আসল মোয়া।
দোকানদার একগাল হেসে বলল, ‘আসুন আসুন। সব একেবারে খাঁটি পাবেন।’
বিজনমামা মুখে বিরক্তি এনে বলল, ‘খাঁটি জিনিস চলবে না। যারা আমাদের বাড়িতে এসেছে, আমরা যখন তাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম একটা বাজে দোকানের জঘন্য মিষ্টি খাইয়েছিল। আমি কেন তাদের খাঁটি জয়নগরের মোয়া খাওয়াবো?’
দোকানদার বলল, ‘বটেই তো, বটেই তো!’
‘তা হলে জয়নগরের মোয়ার নামে যে নকল মোয়াগুলি হয়, সেই মোয়া কোন দোকানে পাবো?’
দোকানদার একগাল হেসে বলল, ‘আমার দোকানেই আছে।’
‘তা হলে জয়নগরের আসল মোয়া একেবারেই কি নেই?’ বিজনমামা জানতে চাইল।
‘আছে। সেসব ইস্পেশাল লোকের জন্য।’
‘আমাকে কি সেখান থেকে দু’প্যাকেট দেওয়া যায় না?’
‘আপনি যে বললেন…’
‘সে তো অন্যদের জন্য। আমরা বাড়ির লোকেরা কি খাবো না!’
দোকানদার একটা ঘুপচি তাক থেকে দু’প্যাকেট জয়নগরের মোয়া বের করল। বিজনমামার হাতে দিয়ে বলল, ‘তাড়াতাড়ি ব্যাগে রাখুন। সবাই চাইলে দিতে পারবো না।’
বিজনমামা হেসে বলল, ‘সেগুলি ইস্পেশাল লোকের জন্য?’
সবক’টা দাঁত বের করে হাসল দোকানদার। বলল, ‘এই প্যাকেটগুলি ক’টা দেব?’
ততক্ষণে পকেট থেকে মোবাইল বের করে বিজনমামা বলল, ‘এখনই চলে যাচ্ছেন? আমি আপনাদের জন্য বাজারের সেরা জয়নগরের মোয়া নিচ্ছিলাম। খেয়ে যাবেন না?’
দোকানদারের দিকে তাকিয়ে বিজনমামা বলল, ‘যাদের জন্য ওই যাচ্ছেতাই মোয়াগুলি নেবো ভেবেছিলাম, তারা বাড়ি চলে যাচ্ছে। আবার তো আসবে। তখন কিন্তু ওই নকল জয়নগরের মোয়া চাই।’
বিজনমামা বলল, ‘এবার মিশন পাটালিগুড়।’
বিজনমামা একটা দোকানের সামনে দাঁড়াল। সামনেই থাক করা পাটালি গুড়।
বিজনমামা দোকানদারকে বলল, ‘আমাদের যে গোয়ালা দুধ দেয়, তা একেবারে যাচ্ছেতাই। আজ পরীক্ষার জন্য ডেকেছি। এমন পাটালিগুড় চাই, যা দুধে দিলে দুধ কেটে যাবে। তখন ওকে বোঝাবো যে, ওর দেওয়া দুধ কতটা খারাপ।’
‘এই কথা? চিন্তা কীসের! সামনে যতগুলি পাটালিগুড় আছে সবই ওইরকম। যে কোনও একটাতেই দুধ কাটবে। গ্যারান্টি।’ কথাটা বলে দোকানদার হেঁ-হেঁ করে হাসল।
‘তা হলে আপনার দোকান থেকে কেউ চাইলেও ভালো গুড় কিনতে পারবে না।’
‘তা কেন? তেমন মানুষের জন্য খুব ভালো পাটালিগুড় আছে। তাঁরা তো কেজি কেজি নিয়ে যান।’
বিজনমামা দুঃখ দুঃখ মুখ করে বলল, ‘আমি তো মাত্র দু’কেজি নেব। মায়ের জন্য। আমাকে কি আর আপনি সেই পাটালিগুড় দেবেন?
বিজনমামার মুখের দিকে তাকিয়ে দোকানদার বলল, ‘মায়ের কথা বললেন, তাই দিতে পারি, তবে আপনাকে কথা দিতে হবে যে, যখনই পাটালিগুড় কেনার দরকার হবে আপনি আমার দোকান থেকেই নেবেন।’
‘সে কথা আর বলতে হবে! আজকাল বিশ্বাস করার মতো লোক পাওয়াই মুশকিল পাটালিগুড় ভালো হলে জানবেন আমি আপনার এক নম্বর খদ্দের।’
দোকানদার দু’কেজি পাটালিগুড় দিতেই তা ব্যাগে ঢুকিয়ে দোকানদারকে বলল, ‘বাড়িতে একটা ফোন করে দেখি গোয়ালা এসেছে কি না।’ ফোন নিয়ে ডায়াল করে বিজনমামা বলল, ‘কী বললে, আসেনি! না এসে ও যাবে কোথায়। আজ না এলেও কাল তো আসতেই হবে।’
ফোন পকেটে রেখে আমাকে দেখিয়ে বিজনমামা দোকানদারকে বলল, ‘গোয়ালা যখনই আসবে আমি ওকে আপনার দোকানে পাঠিয়ে দেবো। আপনি ওর হাতে ওই দুধকাটা পাটালিগুড় দেবেন।’
দোকানদার বলল, ‘আপনি একদম চিন্তা করবেন না। ওইরকম দুধ কেটে যাওয়ার মতো পাটালিগুড় আমার দোকানে অঢেল আছে।’
বাড়ি ফেরার পথে রিকশার দুলুনিতে দু’জনে মিলে গরম জিলিপি খাচ্ছি।
বিজনমামা বলল, ‘জোজো বাজারে গিয়ে কেনাকাটা করতে গিয়ে ঠকে গেলাম না তো? একটু এদিক ওদিক হলে তোর দিদিমা কিন্তু আমাকে খুব বকুনি দেবে। সবার সামনে সেটা খুবই লজ্জার।’
Advertisement



