• facebook
  • twitter
Monday, 11 August, 2025

গীত আর বুলবুলির গল্প

গীত আনন্দে ওর মাকে জড়িয়ে ধরল। মা বলল, ‘তোর চিনি পিনি সিনিকে আজ চিকেন খাইয়ে দিস। ওরা জানে না ওরা কত বড় কাজ করেছে আজ।’

কাল্পনিক চিত্র

সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়


গীত স্কুল থেকে ফিরে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছে গীত। সামনে দিয়ে কোন পাখি উড়ে গেলেই গীত কথা বলে যেন কত চেনে। পাখিগুলো অবশ্য ছোটদের ভাষা বোঝে। তিনটে কুকুর থাকে সামনের বাড়ির ছাদে। গীত ওদের নাম দিয়েছে চিনি পিনি সিনি। সামনের বাড়ির গুনগুনের মা কুকুর খুব ভালোবাসে। গীতের কথা ওরাও শোনে। গীত চেঁচাতে বারণ করলে দিব্যি থেমে যায়। গীত আনমনে তাকিয়ে আছে সিনি পিনির দিকে। ওরাও আধোআধো মুখ করে জুলজুল করে দেখছে গীতকে। হঠাৎ শোনে কানের কাছে কিচকিচ আওয়াজ। কিচিরমিচির আওয়াজটা দ্বিগুণ বাড়তে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখে বারান্দার কর্নারে ছোট বাথরুমে ঢোকার দরজার ঠিক কোণটায় দুটো কাপড় মেলার দড়ি যেখানটায় মিশছে ঠিক তার মাথায় দুটো বুলবুলি পাখি বাসা বেঁধেছে। গীত তো পাখির বাসা দেখে হাঁ। মাথায় কালো রঙের ঝুঁটিয়ালা, লেজের কাছে একটুখানি লাল ছোপ। গীত দেখেই বুঝতে পারল দুটো বুলবুলির যেটা বড়ো সেটাই ছেলে আর অন্যটা মেয়ে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেখে যেই না পাখি দুটো টের পেল গীত ওদের দেখছে ফুড়ুৎ করে কালো গ্রিলের ফাঁক দিয়ে উড়ে গিয়ে বসল ওদের ফ্ল্যাটের সামনে দিয়ে যাওয়া ইলেকট্রিক তারগুলোর ওপর। গীত বুঝল ওরা ভয় পেয়েছে। গীতও ওদের আর বিরক্ত না করে চুপিচুপি ঘরে ঢুকে জানলার ফাঁক দিয়ে দেখতে লাগল ওরা দুটোতে কী করে! ছুট্টে গিয়ে মাকে ডেকে বলল, ‘মা, দুটো পাখি এসেছে বাড়িতে। নেস্ট বানিয়েছে একটা।’

মা বললেন, ‘তাহলে মা পাখিটা নিশ্চয় ডিম পাড়বে!’
‘ডিম?’
‘হ্যাঁ, তারপর মা পাখি তা দেবে। দেখবি ছোট্ট ছোট্ট ছানা হয়েছে কেমন।’
‘ওরা তো আমার বন্ধু হবে। বড়ো হলে ওদের সঙ্গে খেলব।’

মা গীতের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলেন। এই ছোট্ট ফ্ল্যাটে সারাদিন একা একা থাকা। পাখির বাসাটা নিয়ে গীত এখন বেশ খুশি। এখন শুধু অপেক্ষা কখন পাপাকে বলবে যে নতুন বন্ধু আসছে।


পাখিগুলো বাসায় দুটো ডিম পেড়েছিল। মা বুলবুলি সারাদিন ডিমে তা দিত আর বাবা পাখি তার জন্য খাবার খুঁজে আনত। কিছুদিন পরে সেই ডিম ফুটে দুটো ছোট্ট ছোট্ট ছানা হল৷ মা পাখি পাহারায় থাকে। গীতের ছানাগুলোকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছা করে। কিন্তু ছানাগুলো যে বাসার ভেতরে আর বাসাটা ওর নাগালের বাইরে।

একদিন সকালে গীত পড়তে বসেছে আর কিছুতেই অংকের উত্তরটা মিলছে না। তখনই দুটো বুলবুলি মিলে আচ্ছা কিচির-মিচির লাগিয়েছে। গীত তো গেছে ভয়ানক রেগে।

পাখি দুটো আরও জোরে চিৎকার শুরু করল। হন্তদন্ত হয়ে বারান্দায় এসে বাবা বুলবুলিকে দেখে গীতের তো চোখ ছানাবড়া। মুখে একটা ইয়াব্বড় ফড়িং নিয়ে সে ডেকে চলেছে ক্রমাগত। এদিকে গত দুদিন বৃষ্টি পড়ছিল বলে গীত একটা ছোট্ট বাটিতে কিছু ধান রেখেছিল কিন্তু এখানে তো অন্য ছিরি।

গীত ছুট্টে গেল রান্নাঘরে। মাকে বলল,
‘জানো পাখিটা আজ ফড়িং ধরে এনেছে।’
‘বাহ এতো মহা ভোজ। তুই খাবি চিকেন আর ওরা খাবে ফড়িং। তোর দেওয়া ধানগুলো কি খেয়েছে ওরা?’
‘না, মুখও দেয়নি।’

‘অরুচি হয়েছে। তোর মতো। শাকসবজি দানাপানি কিছু খান না। যত ফড়িং আর পোকামাকড় খায়।’ বলেই মা হো হো করে হেসে উঠল। কিন্তু গীতের ভারি রাগ হল। কত আশা নিয়ে ও বাটিতে ধানগুলো রেখেছিল। এসব ভাবতে ভাবতে গীত পাখিদুটোকে এক ধমক দিয়ে আবার ঘরে পড়তে চলে এল। ধমক খেয়ে ওরাও রীতিমত ফুড়ুৎ করে পালাল গ্রিলের ফাঁক দিয়ে আর গীত দেখল দুটো লাল রঙের ছানা, গায়ে কেমন ছোপ ছোপ কালো পালক, গলা বাড়িয়ে বাসার ভেতর থেকে চিঁ চিঁ করে করে ডেকেই চলল খাবার খাবে বলে।


সেদিন গীতরা বেড়াতে গেছে। সন্ধে বেলায় বারান্দার গিয়ে গীত দেখে একটা ছোট পাখি মাটিতে পড়ে গেছে। দেখেই চমকে ওঠে৷ ভয়ে কাঁটা হয়ে মাকে ডাকে। মা পাপা দেখে ছোট্ট পাখিটা বাসা থেকে মাটিতে পড়ে গেছে। ছোট্ট শরীরটা একেবারে কাঠ হয়ে আছে। পা-দুটো বুকের কাছে মোড়ানো শক্ত। চিত হয়ে শুয়ে আছে পাখিটা। মা পাপার দিকে তাকায়। মন ভীষণ খারাপ। গীতকে নিজের কাছে ডেকে জড়িয়ে ধরল পাপা। তারপর মাকে বলল, ‘কাল বিপুলাদি এলে বলো, আমি মাটি খুঁড়ে রাখব। ওকে যেন চাপা দিয়ে দেয়।’

‘তাহলে তো আমার একটা বন্ধু কমে গেল মা। ও তো আর আমার সঙ্গে খেলতে পারবে না।’

‘বোকা মেয়ে। পাখি পশু গাছপালা সবাই আমাদের বন্ধু। ওরা না থাকলে আমরাও থাকতে পারব না। আর যে পাখিটা বাসায় বড় হচ্ছে ও এমনিও দেখবি উড়তে পারলে আর এখানে থাকছে না। তাই যতদিন আছে, ওর খেয়াল রাখ। আমরা সবাই মিলে রাখব। ও বড় হয়ে যখন এদিক দিয়ে উড়ে যাবে দেখবি তোকে ঠিক মনে রেখেছে।’


সামনে পরীক্ষা। স্টাডি লিভ চলছে। ছুটি থাককে ওর মন খারাপ করে। সামনের বাড়ি ছাদে তিনটে কুকুর বোধহয় টের পেয়েছে সে কথা। ওরাও হাঁ করে তাকিয়ে আছে, গীতের দিকে। বুলবুলি পাখিদুটো ওই ছাদেই বসে। গুনগুনদের বাড়ির ছাদে বেশ কতগুলো গাছ আছে। পাখি দুটো ওতে বসে গীতদের বারান্দার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ গীত দেখে বাসা থেকে শাঁ করে ছোট্ট পাখিটা গ্রিলের ফাঁক দিয়ে উড়ে চলে যাচ্ছে ওই ছাদের দিকে। কিন্তু সবে প্রথমবার কি এতটা উড়তে পারবে? না, পারল না। ওই টবে পৌঁছানোর আগে একটা দেওয়ালে ধাক্কা খেলো। ভাগ্যিস ওটা ছাদের উপরেই ছিল। দেওয়ালে টাঙানো একটা দড়িতে কোনোমতে পাখিটা বসে পড়ল। তখনই ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা তিনটে কুকুর পাখিটাকে দেখে ওই দিকে ছুটে গেল। গীত এদিকে চিৎকার করে মাকে ডাকছে, ‘মা মা, শিগগিরই এসো পাখিটাকে খেয়ে নিল বোধহয়।’

মা পাপা দুজনেই ছুটে এল। দুজনেই দেখল ওই সামনে ছাদের দেওয়ালের গায়ে একটা তারের উপর বসে আছে পাখিটা আর ছোট্ট ছানা পাখিটার নীচে তিনটে কুকুর ওর দিকে তাকিয়ে। মা নিজের সাধ্যমত চিৎকার করে কুকুরগুলোকে সরানোর চেষ্টা করল। কিন্তু মায়ের চিৎকারে কোনো কিছুই তাদের এল গেল না। তাদের নজরে এখন ওই ছোট্ট পাখিটা। এর মধ্যে পাখিটা এদিক ওদিক নড়তে গিয়ে তার থেকে গেল পড়ে। যেই না মাটিতে পড়া কুকুরগুলো অমনি ছুটে এসে ওর দিকে তাক করে রইল। তখনই কোথা থেকে একগাদা পাখি এসে কুকুরদের মাথায় চক্কর কাটতে শুরু করল। একটা চড়ুইয়ের মস্ত ঝাঁক। কুকুরগুলো বোধহয় কিছু টের পেল। ওরা পাখিটার থেকে তিন চার পা পিছিয়ে এদিক ওদিক তাকাল। তারপর ওদের মধ্যে একটা কুকুর পাখিটাকে মুখে করে তুলে ছাদে রাখা একটা চেয়ারের উপর রাখল। ততক্ষণে মা চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। পাখিটাকে মুখে তুলতে দেখেই মা ভেবেছে এই বুঝি সব শেষ। গীত মাকে বলল, ‘মা চোখ খোলো। ও পাখিটাকে খায়নি।’

সত্যি তো তাই। তিনটে কুকুরের কেউ পাখিটাকে খেলো না। পাখিটাকে চেয়ারের উপর রেখে কুকুরগুলো সামনে বসল। পাখিটার দিকে ওরা তিনজন হাঁ করে তাকিয়ে আছে। মা-বুলবুলি বাবা-বুলবুলি উড়ে এসে পাখিটার কাছে বসল। তারপর ওকে উড়িয়ে নিয়ে গেল ওপরের ফুল গাছের দিকে। গীত দেখল চিনি পিনি সিনিও তাকিয়ে আছে ছোট্ট পাখিটার দিকে। ছানা পাখিটা ততক্ষণে মা-বুলবুলি আর বাবা-বুলবুলির সঙ্গে একটা গাছের ডালে বসে আছে আর বাবা-বুলবুলি কী যেন খাইয়ে দিচ্ছে ওকে!

গীত আনন্দে ওর মাকে জড়িয়ে ধরল। মা বলল, ‘তোর চিনি পিনি সিনিকে আজ চিকেন খাইয়ে দিস। ওরা জানে না ওরা কত বড় কাজ করেছে আজ।’