সৈয়দ হাসমত জালাল
দীর্ঘ ২৭ বছর পর আবার দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গড়ছে বিজেপি। গত নির্বাচনেই বিজেপি যেখানে পেয়েছিল মাত্র ৮টি আসন, সেখানে এবার বিজেপি জিতে নিল ৪৮টি আসন। আর আম আদমি পার্টি বা আপ যেখানে ৬২টি আসন জিতে বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গড়েছিল, সেখানে এবার তারা পেয়েছে ২২টি আসন।
এবার আপের জেতা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় তৈরি হয়েছিল। আপের মূল চালিকা শক্তি অরবিন্দ কেজরিওয়াল দুর্নীতির অভিযোগে কারাবাস করেছেন। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি আর মুখ্যমন্ত্রীর আসনে না বসে মুখ্যমন্ত্রী করেছিলেন আতিশী মারলেনাকে। কেজরিওয়াল জানিয়েছিলেন, দিল্লিবাসী চাইলে তিনি নির্বাচনে জিতে এসে তবেই মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেবেন। কিন্তু কেজরিওয়ালের সে আশা আর পূর্ণ হল না। অথচ তিনিই ক্ষমতায় এসে সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা দিয়েছিলেন দিল্লিবাসীকে। তার মধ্যে প্রধান দুটি হলো, ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিলে ছাড় আর মহিলাদের বিনামূল্যে বাসে যাতায়াতের সুবিধা। স্কুলশিক্ষার ক্ষেত্রেও করেছিলেন নানা সংস্কার, যাতে শিক্ষার্থীরা সুবিধা পায়। এবার নির্বাচনের আগে কেজরিওয়াল ঘোষণা করেছিলেন, ফের ক্ষমতায় ফিরলে পুরোহিতদের মাসিক ভাতা দেবেন ১৮ হাজার টাকা করে। কিন্তু এর পরেও তিনি এবং তাঁর দলের এই অবস্থা হলো কেন!
আসলে মানুষ শুধুমাত্র সরকারের দয়া-দাক্ষিণ্যে বেঁচে থাকতে চায় না। তারা চায় নিজেদের উপার্জনের সংস্থান, চায় উন্নয়ন এবং অধিকার। দিল্লির বায়ুদূষণ, যমুনার জলদূষণ সব মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে। অফিস-আওয়ার্সে দিল্লির যানজট কখনও কখনও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। মানুষ চায় উন্নত পরিকাঠামো। আপের একাধিক মন্ত্রীকে জেলে যেতে হয়েছে। ফলে তাঁদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতা হারিয়েছে। আবার কেজরিওয়ালের জমানাতেই পূর্ব দিল্লির একাংশে ঘটেছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। সে সময় তা সামলানোর ক্ষেত্রে আপের উল্লেখযোগ্য কোনও ভূমিকা দেখা যায়নি। এবার মুসলিম এলাকার ভোট ভাগাভাগি হয়েছে কংগ্রেস এবং আসাদউদ্দিন ওয়েইসির এআইএমআইএম (মিম)-এর মধ্যে। যে এলাকায় দাঙ্গা হয়েছিল, সেখানেও আপ ও মিমের ভোট ভাগাভাগিতে জিতে গিয়েছেন বিজেপি প্রার্থী।
গত ৫ বছরে দিল্লিতে আপের শীর্ষ নেতা-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে হামেশাই দেখা গিয়েছে ইডি-সিবিআইয়ের তদন্ত।
এমনকি নির্বাচনের দিনেও কেজরির বাড়িতে হানা দিয়েছিল অ্যান্টি-কোরাপশন ব্যুরো। আপ বারবার অভিযোগ করেছে, এসবই কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় থাকা বিজেপির চক্রান্ত। আবগারি দুর্নীতির অভিযোগে কেজরিওয়াল ও তাঁর উপ-মুখ্যমন্ত্রী মনীশ সিসোদিয়াকে জেলে যেতে হয়েছিল। উল্লেখ্য, তাঁদের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ দিতে না পারায় ইডিকে ভর্ৎসনাও করেছে আদালত এবং জামিন পেয়েছেন তাঁরা। এভাবে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের সঙ্গে সংঘাত লেগেই ছিল আপ সরকারের। এই সংঘাতের কারণে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্প থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে আপ সরকার।
তাতে দিল্লিবাসী সাধারণ মানুষ কিছু ক্ষেত্রে বঞ্চিত হয়েছে। এছাড়াও দিল্লি পুলিশ কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে এবং দিল্লির উপ-রাজ্যপাল কেন্দ্রেরই প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করেছেন। উপ-রাজ্যপালের সঙ্গে আপের বিরোধ এক সময় বারবার সংবাদের শিরোনামে এসেছে। এই সংঘাত সাধারণ মানুষ নিশ্চয়ই চায় না। তাই প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া কাজ করেছে এবারের নির্বাচনে। দিল্লিবাসীরা এই অবস্থার পরিবর্তন চেয়েছে। আর কংগ্রেসের ভূমিকার কথাও এখানে উল্লেখ করতে হয়। আপ এবং কংগ্রেস একই ‘ইন্ডিয়া’ জোটের শরিক হয়েও তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে যেভাবে তোপ দেগেছে, তাতে লাভবান হয়েছে বিজেপিই। অনেকগুলি আসনেই স্বল্প ব্যবধানে জিতেছেন বিজেপির প্রার্থী। সেই আসনগুলিতে আপ ও কংগ্রেসের ভোট এক হলে তা বিজেপির প্রার্থীকে ছাপিয়ে যেত। কংগ্রেস ও আপের সংঘাতে ক্ষতি হলো তাদেরই। আর কংগ্রেস নিজের নাক কেটে আপের যাত্রাভঙ্গ করায় শেষ হাসি হাসলো বিজেপিই।