দেবাশিস দাস
জগন্নাথ সর্দার, চন্দ্রমোহন কিস্কু, শ্রীনাথ মুর্মু, লক্ষ্মীকান্ত বাউরি, প্রাণকৃষ্ণ মাহাত এঁদের মধ্যে অনেক অমিল থাকলেও সবচেয়ে বড় মিল, এঁরা একসময় জড়িয়ে পড়েছিলেন মাওবাদী কার্যকলাপে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন তাঁরা। জঙ্গলমহলের নিতান্ত দিন আনা দিন খাওয়া পরিবারের এই মানুষগুলোর কাছে সরকারের কোনও মূল্য ছিল না। সেই তাঁরাই রাজ্য সরকারের ডাকে সাড়া দিয়ে বন্দুক, বুলেট ভুলে ব্যালটের উপরে আস্থা রাখলেন। একদিন যাঁরা দেশকে টুকরো টুকরো করে দেওয়ার স্বপ্ন দেখতেন, তাঁরাই এখন অন্যান্য পুলিশকর্মীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছেন। এর চেয়ে ভালো খবর আর কী হতে পারে? এবার এক নজরে দেখে নেওয়া যাক তাঁদের অতীত।
Advertisement
জগন্নাথ সর্দারের বাড়ি বেলপাহাড়ি থানার শিয়াড়বিঁধা গ্রামে। ১৯৯৫ সালে প্রথমবার তাঁকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তিনমাস জেলে থাকার পর তিনি ছাড়া পান। পরে ২০০৬ সালে ফের তাঁকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এবার প্রায় দেড় বছর জেলে থাকার পর ছাড়া পান। ২০২১ সালে পুলিশের হোমগার্ডে চাকরিতে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি বেলপাহাড়ি থানায় কর্মরত।
Advertisement
চন্দ্রমোহন কিস্কুর বাড়ি বেলপাহাড়ি থানার বুড়িঝোড় গ্রামে। ২০০৯ সালে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিল। প্রায় তিন মাস পর ছাড়া পেয়েছিলেন। রাজ্য সরকারের পুনর্বাসন প্রকল্পে তিনিও ২০২১ সালে হোমগার্ডের চাকরি পেয়ে বর্তমানে বেলপাহাড়ি থানায় কর্মরত।
শ্রীনাথ মুর্মুর বাড়ি শিলদার ধুলিয়াপুর গ্রামে। ২০০৯ সালে তাঁকেও গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। ২০১৪ সালে ছাড়া পান শ্রীনাথ। ২০২১ সালে হোমগার্ডে চাকরি পান। বর্তমানে তিনি অন্য পুলিশকর্মীদের সঙ্গে বেলপাহাড়িতে নিরাপত্তার দায়িত্ব সামলাচ্ছেন।
লক্ষ্মীকান্ত বাউরির বাড়ি বেলপাহাড়ির চাকাডোবা গ্রামে। তিনি ২০০৮-০৯ সালে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন পুলিশের হাতে। প্রায় ৪ মাস জেলে থাকার পর ছাড়া পেয়েছিলেন। ২০২১ সালে হোমগার্ডে চাকরি পেয়েছেন। আজ বেলপাহাড়ি থানায় কর্মরত।
প্রাণকৃষ্ণ মাহাতের বাড়ি শিলদার মেছুয়া গ্রামে। ২০০৮-০৯ সালে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল তাঁকে। প্রয়ি তিনমাস জেলে থাকার পর ছাড়া পান। বর্তমানে পুলিশের হোমগার্ডের কাজ করছেন বেলপাহাড়ি থানায়।
মঙ্গল মুড়ার বাড়ি বেলপাহাড়ির বিদ্রি গ্রামে। ২০০৯-১০ সালে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিল। প্রায় এক বছরের বেশি সময় জেলে থাকার পর ছাড়া পেয়েছেন। পরে ২০১৮ সালে পুলিশের চাকুরিতে যোগদান। এখন ঝাড়গ্রামে কর্মরত রয়েছেন।
শুধু ঝাড়গ্রাম জেলায় আত্মসমর্পণকারী ৭৭০ জন মাওবাদী চাকরি পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৩৩০ জন মাও হামলায় নিহতদের পরিবারের লোকজনও রয়েছেন।
এদিকে ২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর দিনটিকে কখনও ভুলবে না পুরুলিয়ার বাগমুণ্ডি বিধানসভা এলাকার ঝালদা ১ নম্বর ব্লকের দঁড়দা গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত বাগবিন্দা গ্রাম। ওই দিন সন্ধ্যায় মাওবাদীরা ফরওয়ার্ড ব্লকের সাত কর্মীকে গুলি করে হত্যা করেছিল। বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে গ্রামের অদূরে একটি মাঠে ঝালদা দঁড়দা গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান চপলা গড়াত, তপন সিং সর্দার, কিঙ্কর সিং, গোপেশ্বর মাহাত, গোবর্ধন সিং, অর্জুন সিং মুড়া এবং অনন্ত মাহতকে হত্যা করে মাওবাদীরা। আজ পুরুলিয়ার এই গ্রামেও উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় লাগোয়া এই গ্রাম মাওবাদীদের হত্যালীলার ভয়াবহ স্মৃতি ভুলে যায়নি। হাড়হিম করা এই ঘটনায় নাড়িয়ে দিয়েছিল সমাজকে। মাওবাদীদের আনাগোনা আজ আর নেই। এলাকা রীতিমতো শান্ত। যে অনুন্নয়নকে হাতিয়ার করে মাওবাদীরা নিজেদের ভিত শক্ত করেছিল, তারা এখন কর্পূরের মতো উবে গিয়েছে। যদিও দুঃসহ স্মৃতি আজও ভুলতে পারেননি বিয়োগব্যথায় ভারাক্রান্ত পরিজনেরা।
শুধু নিরীহ মানুষই নন, বহু পুলিশকর্মীও প্রাণ হারিয়েছেন মাওবাদীদের আক্রমণে। এর মধ্যে রয়েছেন পুরুলিয়ার বান্দোয়ান থানার ওসি নীলমাধব দাস, বাঁকুড়ার সারেঙ্গা থানার ওসি রবিলোচন মিত্র, বারিকুল থানার ওসি প্রবাল সেনগুপ্তের মতো দক্ষ আধিকারিকরা। শুধুমাত্র বাঁকুড়া জেলাতেই সাতজন পুলিশকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। ২০১০ সালে শিলদার ইএফআর ক্যাম্পে মাও-হামলায় মৃত্যু হয় দুপুরে খাওয়া সেরে বিশ্রামরত ২৪ জওয়ানের। যাঁদের স্মৃতিতে বসানো ২৪টি মেহগনি গাছ আজও সাক্ষ্য দেয় তাঁদের আত্মত্যাগের।
জঙ্গি কার্যকলাপে দশকের পর দশক রক্তাক্ত কাশ্মীর। কিন্তু কলকাতা শহর থেকে মাত্র ১৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কাঁকড়াঝোড় বনবাংলো ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে উড়িয়ে দিয়েছিল মাওবাদীরা। শান্ত স্নিগ্ধ কাঁকড়াঝোরের প্রাকৃতিক পরিবেশ ভ্রমণপিপাসু মানুষের কাছে অন্যতম দ্রষ্টব্য। শুধু কাকড়াঝোরই নয়, জঙ্গলমহলের বেলপাহাড়ি, ভুলাভেদা, চাকাডোবা, শিলদা, বান্দোয়ান, বারিকুলের মতো বিস্তীর্ণ এলাকা পরিণত হয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্রে।
পুলিশ ও সিআরপিএফের টহল এবং মাওবাদী নিধনে তাদের অভিযান আগে কখনও দেখেনি জঙ্গলমহল। সব মিলিয়ে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল জঙ্গলমহলে। বুলেটের দাপাদাপি এবং বারুদের গন্ধে জঙ্গলমহলের স্বাধীনতা উধাও হতে বসেছিল। সেই বদলে যাওয়া সময়ের হাত ধরে সংকটে পড়তে হয়েছিল স্বাধীনতাকেও। একটা সময় পাহাড়ে ঘেরা আমলাশোলের মতো জায়গায় স্বাধীনতা দিবসের দিন পতাকা উত্তোলন করাটা রীতিমতো চ্যালেঞ্জের ছিল। পুলিশ এবং সিআরপিএফ-এর নিরাপত্তার ঘেরাটোপে জঙ্গলমহলের বিভিন্ন জায়গায় পতাকা উত্তোলন হত। এখন সেসব অতীত। কারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে অনুন্নয়নকে হাতিয়ার করে নতুন স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখানো মাওবাদীরা ক্রমশ কোণঠাসা, জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সে কারণে শান্ত জঙ্গলমহলে স্বাধীনতার পতাকা তোলাটা আগের থেকে অনেক বেশি সহজ।
নিজেদের ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলি দিয়ে মাও-স্কোয়াডে নাম লিখিয়েছিলেন অনেকে। জঙ্গলমহলে মাটির বাড়িতে যাঁদের আলপনা দেওয়ার কথা ছিল, তাঁদের হাতেও উঠে এসেছিল একে-৪৭, ইনসাসের মতো অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। জঙ্গল থেকে মাথায় করে কাঠ আনার বদলে রাতের অন্ধকারে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে নতুন স্বাধীনতার সূর্যোদয়ের স্বপ্ন দেখা সেই তরুণ-তরুণীরাই রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল নিজেদের মতো করে। কিন্তু সেই বিপ্লব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
Advertisement



