আহমেদাবাদে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনায় প্রায় ২৪১ জনের মৃত্যু হয়েছে। সরকারের তরফে তদন্তও শুরু হয়েছে। আহমেদাবাদে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার তদন্ত করছে এয়ারক্রাফট অ্যাক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো (এএআইবি)। তবে এখনও স্পষ্ট নয়, কীভাবে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটল। ভয়াবহ এই বিমান দুর্ঘটনায় বিমানের ককপিটে ঠিক কী হয়েছিল, সেই বিষয়ে যাবতীয় রহস্যভরা ২টি ব্ল্যাক বক্সের একটি এবার উদ্ধার করা হয়েছে, সংবাদমাধ্যম সূত্রে এমনটাই খবর। আহমেদাবাদের মেঘানিনগরে চিকিৎসকদের যে হস্টেলে বিমানটি ভেঙে পড়েছিল, শুক্রবার তার ছাদ থেকে উদ্ধার হয়েছে সেই ব্ল্যাকবক্স। কেন্দ্রীয় অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রকের একটি সূত্র এমনটাই বলছে। আরেকটি ব্ল্যাক বক্সের খোঁজে এখনও তল্লাশি চলছে। এই দুটি ব্ল্যাক বাক্স খতিয়ে দেখলেই দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ জানা যাবে। যদিও উদ্ধার হওয়া ব্ল্যাক বক্সটির রিপোর্ট পেতে এখনও কিছুটা সময় লাগবে।
প্রসঙ্গত, ব্ল্যাক বক্স নামক এই ডিভাইসের ভিতরেই লুকিয়ে রয়েছে দুর্ঘটনার যাবতীয় তথ্য। দুর্ঘটনার আগে ঠিক কী কী হয়েছিল, সেই যাবতীয় অডিও, এই যন্ত্রের ভিতরে রেকর্ড হয়ে রয়েছে। এটি ককপিটের যাবতীয় অডিও রেকর্ড করে রাখে। সেই সঙ্গে বিমানের যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জমা করে রাখে। আর এর উপর ভিত্তি করেই ফরেন্সিক টিম দুর্ঘটনার কারণের উৎস খুঁজে পায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পাইলটের ভুল কিংবা অন্য কারও দ্বারা ভুল নাকি যান্ত্রিক ত্রুটি, কোনটা দায়ী? সব বলে দেবে এই ব্ল্যাক বক্স। অর্থাৎ এই ডিভাইসের কাজই হল দুর্ঘটনার কবলে পড়া বিমানের যাবতীয় রহস্য উন্মোচন করা।
অত্যন্ত সুরক্ষিত এই ডিভাইসটির নাম ব্ল্যাকবক্স হলেও এই যন্ত্রের রং গাঢ় কমলা। বিমান ধ্বংস হয়ে গেলেও এটি নষ্ট হয় না। জলে পড়লে, আগুনে পুড়ে গেলেও বছরের পর বছর অক্ষত থাকে। এর মধ্যে বিমানের গতি, উচ্চতা, ইঞ্জিন কী ভাবে কাজ করছে, সেই সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য রেকর্ড করা থাকে। ককপিটে কী কথাবার্তা চলছে, এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলের সঙ্গে পাইলটের কী কথা হয়েছে, তা-ও রেকর্ড করা থাকে এই ব্ল্যাকবক্সে। তথ্য অক্ষত রাখতে এই ব্ল্যাকবক্সটি তৈরি করা হয় স্টিল ও টাইটেনিয়াম দিয়ে। এই যন্ত্রের দু’টি অংশ থাকে— এক, ডিজিটাল ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডার (ডিএফডিআর)। দুই, ককপিট ভয়েস রেকর্ডার (সিভিআর)। বিমানের প্রযুক্তিগত তথ্য ধরে রাখে ডিএফডিআর। ককপিটের সব কথোপকথন ধরে রাখা থাকে সিভিআরে। বিপদের সময় পাইলট কার সঙ্গে কী কথা বললেন, সবই রেকর্ড থাকে সিভিআরে। পরে তা থেকেই জানা যায়, দুর্ঘটনার মুহূর্তে ঠিক কী ঘটেছিল।
প্রসঙ্গত বহু যুগ ধরে গোয়েন্দা বিভাগ বা তদন্তকারীদের কাছে যেকোনও মৃত্যু বা খুনের রহস্য উন্মোচনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র খুবই প্রচলিত। সেটি হল, ‘খুনের রহস্য লুকিয়ে রয়েছে মৃত বা আক্রান্তের জীবন কাহিনীর মধ্যে’। বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার বিমান দুর্ঘটনার পিছনেও সেই তত্ত্ব অনেকটাই গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য শুরু থেকে এই বিমানের ইতিহাস ঘেটে দেখা খুবই প্রয়োজন।
জানা গিয়েছে, বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার হল বোয়িং কমার্শিয়াল এয়ারপ্লেন কোম্পানির তৈরি করা দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট মাঝারি আকারের একটা বিমান। বিমানটি যাত্রীদের চাহিদা পূরণের স্বার্থে ৩টি শ্রেণীতে ২৪২ থেকে সর্বোচ্চ ৩৩৫ জন যাত্রী পরিবহনে সক্ষম। ড্রিমলাইনার বিমানটি হালকা যৌগিক পদার্থ দিয়ে তৈরি হওয়ায় এয়ারলাইন শিল্পে আজ পর্যন্ত সবচেয়ে জ্বালানি সাশ্রয়ী হিসেবে পরিচিত। কারণ বোয়িং ৭৮৭ কে ৭৬৭-এর চেয়ে প্রায় ২০% জ্বালানি সাশ্রয়ী হিসেবে ডিজাইন করা হয়।
এছাড়াও আধুনিক কিছু বৈশিষ্ট্য, যেমন– ইলেক্টিক্যাল ফ্লাইট সিস্টেম, চার প্যানেল বিশিষ্ট উইন্ডশিল্ড, শব্দ নিরোধি শেভরন ইত্যাদি বিমানটিকে অন্য বিমানের চেয়ে অনেকটাই স্বতন্ত্র করে তুলেছে। ড্রিমলাইনারের উড়ান প্রক্রিয়া বোয়িং ৭৭৭ এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাবে তৈরি করায় বোয়িং ৭৭৭ এ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পাইলটরা নতুন কোনও প্রশিক্ষণ ছাড়াই এটি ওড়াতে করতে পারে। এই বিমানের যা যা বৈশিষ্ট্য আছে, তা হল – বোয়িং ৭৮৭-৮ এর দুটি ইঞ্জিন থাকে। এই বিমানটি রোলস রয়েস পিএলসি-র ট্রেন্ট ১০০০ অথবা জিই এরোস্পেস-এর জিএনএক্স ইঞ্জিন দ্বারা চালিত।
বিমানটির বাইরের উচ্চতা: ৫৮ ফুট, উইং স্প্যান:১৯৭ ফুট ৪ ইঞ্চি, দৈর্ঘ্য:১৮৬ ফুট ১ ইঞ্চি, ভেতরে – অভ্যন্তরীণ লাগেজ: ৪৮২৬ ঘনফুট, অপারেটিং ওজন সর্বোচ্চ টি/ও ওজন: ৫০২৫০০ পাউন্ড, খালি ওজন:২৬৪৫০০ পাউন্ড, জ্বালানি ধারণ ক্ষমতা:২২৩৩৭৮ পাউন্ড, সর্বোচ্চ পেলোড:৯০৫০০ পাউন্ড, ইঞ্জিন: ২ ইঞ্জিন, এমএফজি:রোলস রয়েস ইঞ্জিন, মডেল: ট্রেন্ট ১০০০, সর্বোচ্চ গতি: ৯৫৪ নটস, সাধারণ ক্রুজ: ৪৮৭ নটস, সর্বোচ্চ পরিসীমা: ৭৩০৫ এনএম
পরিষেবার সর্বোচ্চ সীমা: ৪৩১০০ ফুটবোয়িং ৭৮৭ ২০১১ সালের মার্চ মাসে ফেডারেল এভিয়েশন এডমিনেস্ট্রেশন ও ইউরোপিয়ান এভিয়েশন সেফটি এজেন্সির অনুমোদন পায় এবং ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম বিমান হস্তান্তর করা হয়। ২০১১ সালের অক্টোবরে অল নিপ্পন এয়ারওয়েজ সর্বপ্রথম এই বিমান দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে যাত্রী পরিবহন শুরু করে। এর পর থেকে বোয়িং কোম্পানি বিভিন্ন এয়ারলাইন্স থেকে প্রায় ১০৭১ টি বিমান সরবরাহ করার অর্ডার পায়।
ব্যাটারি জনিত বিভিন্ন সমস্যার কারণে ইউরোপ, আমেরিকা সহ বিভিন্ন দেশের এভিয়েশন সেফটি এজেন্সিগুলো বেশ কিছুদিনের জন্য অপারেশন থেকে সরিয়ে রাখে। বোয়িংয়ের নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও ব্যাটারির নকশা পুনর্মূল্যায়ন ও এভিয়েশন সেফটি এজেন্সির অনুমোদনের পর ২০১৩ সালের মে মাসের দিকে বিমানটি পুনরায় যাত্রী পরিবহন শুরু করে।