সৈয়দ হাসমত জালাল
গতকালই আমাদের সংবাদপত্রের হেডলাইনে ‘পহেলগামে জঙ্গিহানা, নিহত অন্তত ২৮’ শীর্ষক সংবাদটি বসানোর পর রাতে বাড়ি ফিরে সারারাত প্রায় ঘুমোতে পারিনি। রবীন্দ্রনাথের বহুল প্রচারিত দুটি পঙ্ক্তি মাথার মধ্যে ঘুরছিল– ‘ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে/ অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে।’
পাক জঙ্গি গোষ্ঠী লস্কর-এ-তৈবার সহযোগী সংগঠন দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ) পহেলগামে হামলার দায় স্বীকার করে নিয়েছে। পহেলগামের বৈসরন উপত্যকায় এই জঙ্গি সংগঠনের হামলায় ২৭জন পর্যটক এবং একজন স্থানীয় টাট্টু চালক নিহত হয়েছেন। এই সংগঠনের পেছনে যে পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই রয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এই জঙ্গি নাশকতা সাম্প্রতিককালের ইতিহাসে নজিরবিহীন। এই ঘটনাকে নিন্দা করার জন্যে কোনও ভাষাই যথেষ্ট নয়।
সাম্প্রতিককালে জম্মু ও কাশ্মীরে যথেষ্টই স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছিল। আর তাই সেখানে বাইরের রাজ্য থেকে পর্যটকরাও নিশ্চিন্তে বেড়াতে গিয়েছেন। কাশ্মীরের স্থানীয় অর্থনীতি নির্ভর করে মূলত এই পর্যটনের উপরেই। এই জঙ্গি হামলায় মৃতদের পরিবারের পরই আতঙ্কিত ও ক্ষতিগ্রস্ত সেখানকার স্থানীয় মানুষেরা। বহু বছর ধরেই তাঁরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছিলেন না। আর তাই সাম্প্রতিক স্বাভাবিক পরিস্থিতি তাঁদের আশ্বস্ত করে তুলেছিল।
ইদানিং ভারত বিরোধিতার জিগির তাই সেভাবে শোনা যাচ্ছিল না। পাকিস্তানি জঙ্গিদের পক্ষে এটা মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। তাই আকস্মিক পর্যটকদের উপর হামলা চালিয়ে এবং ২৮জন মানুষকে হত্যা করে তারা আবার আতঙ্কের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে চেয়েছে। এই হামলার সময় তারা শুধুমাত্র অমুসলিমদেরই বেছে বেছে হত্যা করেছে। এর ফলে বিশেষভাবে সাম্প্রদায়িক হিংসা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর পরিস্থিতি তৈরি করার উদ্দেশ্যও ছিল এই ইসলামিক টেররিস্ট গোষ্ঠীর। শুধুমাত্র অন্য ধর্মের মানুষ হওয়ার কারণে যেভাবে এতগুলি মানুষকে প্রাণ হারাতে হল, তা কোনোভাবেই বরদাস্ত করা যায় না।
তবে সাধারণ কাশ্মীরবাসীরা যে এই সন্ত্রাসকে সমর্থন করেন না, তার বড় উদাহরণ এই জঙ্গি হামলায় নিহত সইদ আদিল হুসেন শাহ। পর্যটকদের উপর যখন গুলি চালাচ্ছিল জঙ্গিরা, তখন একজন জঙ্গির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁর বন্দুক ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন আদিল। কিন্তু পেরে ওঠেননি। ওই ইসলামিক জঙ্গিদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় সইদ আদিল হুসেন শাহের শরীর। এখানেই সংকীর্ণ ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে প্রকৃতই মানুষ হিসেবে মানবধর্মের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করে গেলেন তিনি।
এই হামলার প্রতিবাদে সমস্ত দোকানপাট বন্ধ রেখে দলে দলে পথে নেমেছেন স্থানীয় কাশ্মীরিরা। তাঁরা নিজেরা ইসলাম ধর্মাবলম্বী হলেও ইসলামের নামে অন্য ধর্মের মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা সমর্থন করছেন না। আসলে কাশ্মীরে শান্তি ফিরে আসাটা পাকিস্তানি জঙ্গিদের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই এই দানবীয় হামলা।
এই হামলার বিরুদ্ধে সরব হয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলছেন নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতি। যাঁরা কাশ্মীর বেড়াতে গিয়েছেন তাঁরা জানেন, প্রবল নিরাপত্তার বেষ্টনীতে ঘেরা থাকে কাশ্মীরের পথঘাট। তাহলে এরকম ঘটনা ঘটে যাওয়ার পেছনে কি ইন্টেলিজেন্সের ব্যর্থতা প্রকট হয়ে ওঠে না? নাকি কেন্দ্র শাসিত এলাকা জারি করে সরকার আত্মসন্তুষ্টিতে ভুগছে? এই সঙ্গে উল্লেখ করা দরকার, যাঁরা মনে করছেন কেন্দ্রীয় সরকার কোনও রাজনৈতিক লাভের উদ্দেশ্যে এরকম ঘটনা ঘটার সুযোগ করে দিয়েছে, আমি তাঁদের সঙ্গে একমত নই। তবে নিরাপত্তার ব্যাপারে যে আরও সতর্কতার অবকাশ রয়ে গেছে, সে ব্যাপারে বলতে দ্বিধা নেই। এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অবস্থার কথাও উল্লেখ করা প্রয়োজন। সেখানে যেভাবে ইসলামি মৌলবাদীরা শাসন কায়েম করেছে, তা নিয়েও ভারতের যথেষ্ট সতর্ক থাকার প্রয়োজন রয়েছে।
আসলে ধর্মকে যেভাবে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার প্রবণতা বেড়েছে, তা সব দেশেই সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষের কাছে খুবই আশঙ্কার বিষয়। সাধারণ মানুষ অহেতুক বিভাজন চান না, তাঁরা খেয়ে-পরে শান্তিতে জীবনযাপন করতেই চান। কিন্তু তাঁদের খাওয়া-পরার সমস্যা থেকে মনোযোগ অন্যদিকে ঘোরাতেই রাজনৈতিক দলগুলির এই প্রবণতা। পাকিস্তান ধর্মকে এভাবেই ব্যবহার করছে। ভারতের রাজনীতিতেও এই প্রবণতা বাড়ছে। সাধারণ মানুষকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতেই হবে এবং বর্জন করতে হবে সব ধরনের ধর্মান্ধতাকে।
পশ্চিমবঙ্গে চিরকালই এক উদার সাংস্কৃতিক পরিবেশ বিদ্যমান। কিন্তু এখানেও ধর্মীয় মৌলবাদ যেভাবে মাথাচাড়া দিচ্ছে, তাও কম আশঙ্কার নয়। রাজনৈতিক দলগুলিকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। সচেতন হতে হবে শিক্ষিত সমাজকে, যাতে এই ইসলামিক জঙ্গিবাদের পাল্টা কোনও ধর্মান্ধ সহিংসতা যেন আমাদের দেশকে গ্রাস না করে। আমি কাজী নজরুল ইসলামের সুরেই বলতে চাই– ‘মূর্খরা সব শোনো/ মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।’