দীর্ঘ চার দশক পর আবার ইতিহাস সৃষ্টি করল ভারত। সব প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে সফল উৎক্ষেপণ হল অ্যাক্সিয়ম-৪ এর। ইলন মাস্কের সংস্থা স্পেসএক্স-এর তৈরি ড্রাগন মহাকাশযানে চেপে বুধবার নাসার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রের উদ্দেশে রওনা হয়ে গিয়েছেন ভারতীয় নভোচর শুভাংশু শুক্লা-সহ চার মহাকাশচারী। দীর্ঘ ৪১ বছরের ব্যবধানে ফের মহাকাশের উদ্দেশে পাড়ি জমালেন আরেক ভারতীয়। পাড়ি দেওয়ার কিছু সময় পর মহাকাশযান যখন প্রতি সেকেন্ডে ৭.৫ কিলোমিটার বেগে পৃথিবীর চারিদিকে প্রদক্ষিণ করছে, সেই সময় পৃথিবীর উদ্দেশে প্রথম বার্তা পাঠান শুভাংশু। তিনি বলেন, ‘দারুণ সফর’।
প্রসঙ্গত, এই দিনটি অনেককেই মনে করিয়ে দিয়েছে রাকেশ শর্মার মহাকাশে পাড়ি দেওয়ার কথা। ১৯৮৪ সালের ৩ এপ্রিল প্রথম ভারতীয় হিসেবে মহাকাশে পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি।
ভারতীয় সময় ঠিক ১২টা বেজে ১ মিনিট। চার সদস্যকে নিয়ে মহাকাশের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয় মহাকাশযান অ্যাক্সিয়ম-৪। তাঁদের গন্তব্য আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন। তার আগেই বুধবার স্পেস এক্স-এর তরফে জানিয়ে দেওয়া হয় আবহাওয়া ৯০ শতাংশ অনুকূলে রয়েছে। এদিন কাউন্ট ডাউন শেষ হতেই দেখা যায় মহাকাশযান যাত্রারম্ভের পরিচিত ছবি। যাত্রা শুরু হতেই চারপাশ হাততালি ও হর্ষধ্বনিতে ভরে যায়। ফ্যালকন-৯ ড্রাগনকে অরবিটে পৌঁছে দিয়ে প্রথম স্টেজটি ফিরে আসে নির্ভুল ল্যান্ডিংয়ে। দ্বিতীয় ধাপ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ড্রাগন এগিয়ে যায় তার গন্তব্য আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের দিকে।
মহাকাশে পাড়ি দেওয়ার কিছু সময় পরই পৃথিবীতে বার্তা পাঠান শুভাংশু। তিনি বলেন, ‘সমস্ত দেশবাসীকে নমস্কার। দারুণ সফর। ৪১ বছর পর আবার ভারত মহাকাশে পা রেখেছে। এই মুহূর্তে আমরা সেকেন্ডে ৭.৫ কিলোমিটার বেগে পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরছি। আমার কাঁধে ভারতের ত্রিরঙা পতাকাই জানিয়ে দিচ্ছে যে আমি আপনাদের সঙ্গেই রয়েছি।’ দেশবাসীর উদ্দেশে শুভাংশু আরও জানিয়েছেন, এই অভিযানই শেষ নয়, এক নতুন অধ্যায়ের শুরু। কারণ, এই অভিযানই ভবিষ্যতে ভারতের গগনযান অভিযানের ভিত্তি স্থাপন করবে। শুভাংশু বলেন, ‘আমি চাই আগামীর এই অভিযানে ভারতের সব মানুষ অন্তর থেকে শামিল হবেন।’
শুভাংশুর এদিনের যাত্রা শুরুর পর শুভেচ্ছা জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তিনি বলেছেন, ‘শুভাংশু শুক্লাই প্রথম ভারতীয় মহাকাশচারী যিনি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে পা রাখবেন। তিনি নিজের কাঁধে ১৪০ কোটি ভারতীর আশা,,আকাঙ্ক্ষার ভার বহন করছেন।’
এর আগে সাত বার বাতিল হয়েছে এই অভিযান। প্রথমে ঠিক ছিল ২৫ মে অভিযান শুরু হবে। কিন্তু তা পিছিয়ে হয় ৮ জুন হয়। এরপরও বারবার পিছিয়ে গিয়েছে যাত্রার তারিখ। শেষবার দিন ধার্য হয়েছিল ২২ জুন। তাও পিছিয়ে যায়। অবশেষে বুধবার সব দিক থেকে সবুজ সঙ্কেত মেলার পর আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের উদ্দেশে পাড়ি দেয় মহাকাশযান ড্রাগন। অরল্যান্ডোর এক সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, বুধবার সকালে উৎক্ষেপণের ঘণ্টাখানেক আগেও আচমকা প্রযুক্তিগত ত্রুটি দেখা দিয়েছিল মহাকাশযানে। জানা গিয়েছে, কোনও কারণে আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য মহাকাশযানে আপলোড হচ্ছিল না। কিন্তু কিছুক্ষণের চেষ্টায় সেই ত্রুটি সংশোধন করে নেন বিজ্ঞানীরা। তারপর নির্ধারিত সময়ে কেনেডি স্পেস সেন্টারের ৩৯এ লঞ্চ কমপ্লেক্সে মহাকাশযানে গিয়ে ওঠেন শুভাংশু-সহ চার নভশ্চর।
উল্লেখ্য, বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে যাওয়ার জন্য তৈরি ভারতীয় বায়ুসেনার গ্রুপ ক্যাপ্টেন শুভাংশু শুক্লা। তাঁর সঙ্গী মহাশূন্যে দীর্ঘ সময় কাটানো বর্ষীয়ান নভোচর পেগি হুইটসন। এ ছাড়াও থাকছেন পোল্যান্ডের স্লায়োস উজনানস্কি-উইসনিউস্কি এবং হাঙ্গেরির টিবর কাপু। ১৪ দিন তাঁরা আইএসএসে থাকবেন, বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাবেন। নাসা এবং ইসরোর যৌথ উদ্যোগে দলটি এই কাজ করবে। শুভাংশু ভারতের নিজস্ব স্পেস মিশন ‘গগনযান’-এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন এই অভিযানের মাধ্যমে।
নাসার এই অভিযানের জন্য ইসরোর তরফ থেকে প্রাথমিক ভাবে বেছে নেওয়া হয়েছিল শুভাংশু শুক্ল এবং প্রশান্ত বালাকৃষ্ণন নায়ারকে। উত্তরপ্রদেশের লখনউয়ের ছেলে শুভাংশু ভারতীয় বায়ুসেনার গ্রুপ ক্যাপ্টেন। মূল মহাকাশচারী হিসাবে বেছে নেওয়া হয় ৩৯ বছরের শুভাংশুকেই। যাত্রা শুরুর আগে শুভাংশু বলেছেন, ‘আমি শুধু যন্ত্রপাতি নয়, সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি একশো কোটির স্বপ্ন। এই যাত্রা আমার কাছে শুধু পেশাগত নয়, এক বিশাল দায়িত্ব।’ তিনি এও বলেন, ‘আমার গল্প যদি অন্তত একজনের জীবন বদলে দেয়, সেটাই হবে আমার সবচেয়ে বড় সাফল্য।’