প্রস্রাবের মাধ্যমে আমাদের শরীর থেকে আপনা আপনিই অপসারিত হয়ে যায় দেহের মধ্যে সঞ্চিত থাকা হরেক বর্জ্য পদার্থ এবং বিষাক্ত উপাদান। একজন সুস্থ মানুষ সারাদিনে সাত থেকে আটবার প্রস্রাব করেন। যদি সেই নিয়ম ঠিকভাবে পালিত না হয়, তাহলে তা কিন্তু একটু ভাববার বিষয়ই হয়ে ওঠে।
অনেকে ইচ্ছে করেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত জল খেয়ে ফেলেন। তাঁরা ধরে নেন সেই কারণেই তাঁদের অতিরিক্ত প্রস্রাবের বেগ। কিন্তু এই চিন্তাভাবনার মধ্যে ভুলও থাকতে পারে। তাই সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন তাঁদেরও।
প্রস্রাবের সমস্যা দেখা দিলে প্রথমেই মনে আসে কিডনির কথা। তারপর আসে প্রস্টেট গ্রন্থির কথা। প্রস্টেটের প্রসঙ্গ অবশ্য খাটে কেবলমাত্র পুরুষদের ক্ষেত্রেই। আর কিডনির ব্যাপার হলে ভাবতে হবে নারী-পুরুষ সকলেরই কথা। তবে প্রস্রাবের সমস্যা মানেই কিডনি, সবসময় সেটা ভাবা মোটেই উচিত হবে না।
সাবধান হতে হবে নিজেকেই। রাসায়নিক দ্রব্য মিশ্রিত থাকে যে-সমস্ত খাদ্যে, তা এড়িয়ে চলতে হবে সবার আগে। কারণ সেই ধরনের খাবার দীর্ঘদিন খেলে কিডনির উপর চাপ পড়বে এবং দেখা দেবে প্রস্রাবের সমস্যা। বর্জন করতে হবে ধূমপানের অভ্যাস এবং মদ্যপান।
কিডনিতে পাথর হলেও দেখা দিতে পারে প্রস্রাবের সমস্যা। শরীরের মধ্যে অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম তৈরি হলে এবং তা ঠিকভাবে দেহ থেকে নির্গত হতে না পারলে, হতে পারে জটিলতা। আবার শরীর থেকে অতিরিক্ত ইউরিক অ্যাসিড বেরিয়ে যাওয়ার প্রবনতা থাকলেও কিডনিতে পাথর হয়।
এবার আসা যাক প্রস্টেট গ্রন্থির কথায়। এটা এমনই একটা গ্ল্যান্ড যাকে পুরুষ শরীরের অতি আবশ্যিক এক অঙ্গ হিসেবে ভাবা যেতে পারে। তাকে আবার পুরুষ মানুষের প্রজননতন্ত্রের বিশেষ এক অংশ হিসেবেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। মূত্রথলির ঠিক নিচে, মূত্রনালীকে ঘিরেই তার অবস্থিতি। আর বিশেষ এক ধরনের ফ্লুইড সৃষ্টিই হল তার প্রধান কাজ। পাশাপাশি পুরুষ মানুষের শুক্রাণুকেও বয়ে বেড়াতে হয় প্রস্টেটকেই।
পুরুষদের প্রস্টেটের গোলযোগ সত্যিই এক গুরুতর সমস্যা। আর তাতে কেউ আক্রান্ত হলে ভীষণভাবেই বেড়ে যায় প্রস্রাবের সমস্যাও। একটা সময় সেটা জীবনকে যেন অতিষ্ট করে তোলে। টেস্টোস্টেরন হরমোনের তারতম্যের কারণেই ঘটে থাকে এই ধরনের সমস্যা। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেখা দিতে পারে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সঙ্কেত।
পঞ্চাশ পার হলেই সতর্ক থাকতে হবে সব পুরুষদেরই। তখনই ওই হরমোনের তারতম্য ঘটে এবং অজান্তেই বেড়ে যায় প্রস্টেট। এতে স্বাভাবিক প্রস্রাবের ক্ষেত্রে নানান বাধার সৃষ্টি হয়। প্রস্রাবের গতিও কমে যায়। অনেক সময় সবটা প্রস্রাব দেহ থেকে নির্গতও হয় না। তেমন ঘটনা ঘটলে বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতেই হবে। এর ফলে হার্নিয়া বা অর্শ রোগ হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়।
ইউরেনারি ট্রাক্ট ইনফেকশন, সংক্ষেপে যাকে বলে ইউ টিআই- সেটাও হল প্রস্রাবের আর এক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। মূত্র নির্গমণের সময় ব্যথার উদ্রেক হয়। প্রস্রাবের বেগও আসে ঘন ঘন। প্রস্রাবের সঙ্গে নির্গত হতে পারে রক্তও। ই- কোলাই নামক এক ধরনের ব্যাক্টেরিয়ার আক্রমণে হতে পারে এই রোগ। একবার কেউ যদি এই রোগে আক্রান্ত হন, তাহলে তা হতে পারে বারবার।
ডায়াবেটিসের কারণেও যে প্রস্রাবের সমস্যা দেখা দেয়, তা নিশ্চয়ই কারও অজানা নয়। তবে প্রস্রাবের সমস্যা আসতে পারে মানসিক কারণে, অথবা আসতে পারে বার্ধক্য জনিত কারণেও। তখন আবার মূত্র থলির মধ্যে প্রদাহের সৃষ্টি হলেও হতে পারে। দেখা দিতে পারে অনেক নতুন নতুন সমস্যা। এই ক্ষেত্রে প্রস্রাবের পরীক্ষা করলেও তেমন কোনও ইনফেকশনের সন্ধান পাওয়া যায় না।
নানান শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি প্রস্রাবের সমস্যা দেখা দিতে পারে আবহাওয়ার তারতম্যের কারণেও। গ্রীষ্মের সময় অতিরিক্ত গরমের কারণে শরীরের মধ্যে জলের প্রয়োজন পড়ে একটু বেশিই। প্রস্রাবের রং হলদেটে হয়ে যায়। সঙ্গে থাকে জ্বালা, ব্যথা-সহ ইউরিন ইনফেকশন বা ডিহাইড্রেশনের মতো সমস্যা। ব্যাক্টেরিয়া যখন শরীরের মধ্যে বাসা বাঁধতে তৎপর হয়ে ওঠে, বাড়ে ইনফেকশনের মতো অনেক অবাঞ্ছিত ঘটনা।
প্রস্রাবের সমস্যার কথা বলতে গিয়ে মহিলাদের অসুবিধা নিয়েও কিছু আলোচনা প্রয়োজন। গর্ভবতী মহিলাদের জরায়ুর আকার ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে চাপ বাড়ে মূত্রাশয়ের উপর এবং আসে ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ। অনেক মহিলাই সেই ঘটনাকে অস্বাভাবিক বেগ বলে ভুল করে থাকেন। ফলে তখন অধিকাংশ মহিলাই জল খাওয়া কমিয়ে দিতে বাধ্য হন। কিন্তু সেটা করা একেবারেই উচিত নয়। জল খাওয়ার পরিমাণ তাঁদের বাড়াতেই হবে।
মূত্রনালীর সংক্রমণ আবার মহিলাদেরই বেশি হয়। কারণ তাঁদের মূত্রনালীর দৈর্ঘ্য পুরুষদের তুলনায় অনেক কম। আবার তাঁদের মূত্রদ্বার এবং যোনিপথ একেবারেই কাছাকাছি অবস্থিত। তাই ঋতুস্রাবের সময় জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
কিন্তু একটু সচেতন থাকলে রোগ অতি সহজে এড়িয়ে চলাও সম্ভব। আর সেই জন্য সাহায্য নেওয়া যেতে পারে সবুজ বনস্পতির। এই ব্যাপারে প্রথমেই মনে পড়ে আমলকীর কথা। এর মধ্যে এমনই অনেক উপক্ষারের সন্ধান পাওয়া গেছে যাতে আছে এই রোগ প্রতিরোধের অসীম ক্ষমতা। এক চামচ আমলকী চূর্ণ আধ চামচ আখের গুড়ের সঙ্গে মিশিয়ে দু’বেলা খেলে, অনেক সমস্যা দূর হবে। করমচা, ছোলা, ডহরকরঞ্জা, আদা, কুমড়োর বীজ, কাবাবচিনি, মেথি, রসুন, তিল বীজ-সহ আরও অনেক প্রাকৃতিক সম্পদের গুণ অনস্বীকার্য।