অজিতবাবু এবং গঙ্গাসাগর মেলা

Written by SNS August 31, 2022 4:21 pm

রজত পাল

 গঙ্গাসাগর মেলা – মকর সংক্রান্তির পূন্য তিথি উপলক্ষ্যে আগত অগনিত মানুষের মাঝে হঠাৎ আলাপ হয়ে গেল অজিত মিত্র নামে এক অদ্ভূত্‌ মানুষের সাথে, যার সম্পর্কে আমি আজও অনিশ্চিত যে তিনি পাগল না দার্শনিক।

“তীর্থস্থান ও যৌনতা”, এই ছিল তার সাথে আলোচনার বিষয়। অবধারিতভাবে বহু আলোচিত বিষয় হিসাবে এসে গেল খাজুরাহোর মত মন্দিরগাত্রে উৎকীর্ণ নানা মৈথুন মূর্তির প্রসঙ্গ। শেষ দুশো বছর দেশে বিদেশের নানা পন্ডিত মানুষ এ বিষয়ে নানা মতামত দিয়েছেন। ভারতীয় যোগ বিষয়ের আলোচনার প্রসঙ্গ টেনে মিল খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে ভারতীয় শিব লিঙ্গে প্রাপ্ত লিঙ্গ ও যোনীর যৌথ সংযোগের মাধ্যমে স্থিত প্রতীক মূর্তির। এদেশীয় সাধক যোগীর ভাষায় বলা হয়েছে, যৌনতার মাত্রাকে অতিক্রম করে নাকি লাভ করতে হয় পরম প্রেমময় ঈশ্বরের আশীর্বাদ।

তীর্থস্থানে নানা উদ্দেশ্যে নানা মানুষের সমাগম ঘটে থাকে। কেউ আর্ত, কেউ বা জিজ্ঞাসু; কেউ বা সারাজীবন নানা ভোগের মাধ্যমে জীবনের উদ্দেশ্যকে অনুধাবন করতে গিয়ে অবশেষে ক্লান্ত এবং বিধ্বস্ত। এছাড়াও এসে পড়ে নানা স্বার্থান্বেষী মানুষ। কেউ ব্যবসায়ী, আসে তার পন্য বিক্রি করতে; কেউ আসে মেলা শেষে সে স্থানের অপ্রয়োজনীয় পন্যকে সস্তাদরে কিনে নিয়ে অন্যত্র সেগুলোকে নতুনভাবে বিক্রি করতে। আসে নানা পকেটমার চোর ছ্যাচোড়ের দল, যারা ভীড়ের মাঝে মিশে থাকে ভক্তের বেশে। আসে নানা লেখক চরত্রের মানুষ, যারা চায় জীবনের মাঝে থেকে জীবনের গল্পকে আহরণ করতে। আবার শুনেছি কেউ কেউ আসে বিগত মেলায় হারিয়ে যাওয়া আত্মীয় স্বজনের খোঁজে।

কেউ আসে সাধুসঙ্গের খোঁজে, কিছু সাধু আসে মালদার গৃহী ভক্তের খোঁজে। তবে অজিতবাবু কেন আসেন তা নিয়েই আজকের গল্প। উনি নাকি আসেন অগনিত মানুষের ভীড়ে মিশে গিয়ে নিজের সাথে নিজে কথা বলতে, আর প্রতিবার আরও ভালোভাবে নিজেকে চিনে নিয়ে বাড়ী ফিরে যাবার স্বপ্ন নিয়ে।

গঙ্গা নদীর মোহনাতে ‘সাগর’ নামে এক দ্বীপ, যে দ্বীপের ১০-১৫ কিমি জুড়ে ব্যাপ্ত সমুদ্রতট। এরই মাঝামাঝি এক স্থানে অবস্থিত আজকের কপিলমুনির মন্দির। বর্তমানের ভৌগলিক বিচারে মন্দিরটি ঠিক গঙ্গা যেখানে সমুদ্রে এসে মিশেছে, সেখানে নয়, প্রায় ৫০০ মিটার ভেতরে। হয়ত পৌরাণিক কালে গঙ্গা-সমুদ্রের মিলন স্থলেই মন্দিরটি ছিল, হয়ত সমুদ্র পিছিয়ে গিয়েছে। বর্তমানে প্রশাসন সমুদ্র থেকে মন্দির পর্যন্ত যাবার রাস্তাটি পাকা করে দিয়েছে। এই পথটির দুপাশেই সমুদ্রতট উত্তর-দক্ষিণ উভয়দিকেই কয়েক কিমি বিস্তৃত, যাদের শেষ সীমানা আমি এবারে পাঁচ দিন টানা থেকে এবং রোজ সকাল বিকাল দুঘন্টা করে হেঁটেও শেষ করতে পারিনি। প্রশাসনের দ্বারস্ত হলে সঠিক উত্তর হয়ত জানা যেত, কিন্তু অত নিখুঁত হিসাব নেবার তাগিদ অনুভব করিনি।

মন্দিরের কাছের সমুদ্রতটে ২-৩শ মিটার জায়গা জুড়ে অঞ্চলে মকর সংক্রান্তিতে আগত হাজার হাজার মানুষ পূণ্যস্নানে ব্যস্ত দিবারাত্র। তার দুপাশের সমুদ্রতট যে টুরিষ্টদের কাছে বকখালি বা নিউ দীঘার চেয়ে কম আকর্ষনীয় নয় – তা নিয়ে প্রায় কারোরই মাথাব্যথা নাই।

প্রথম দিকে যখন একা একা হাটতে হাটতে তীর্থযাত্রীদের থেকে অনেক দূরে বীচ ধরে হেটে চলে এসেছি, চারিদিকে মানুষজন আর দেখা যাচ্ছে না, তখনই নজর এল শহুরে মধ্যবিত্ত ছাপ মারা চেহাড়ার একজন মানুষ উস্কোখুস্কো চুলে উদাসীন দ্রৃষ্টিতে আকাশের দিকে চেয়ে দু হাঁটুতে ভাঁজ করা হাত রেখে বসে আছেন সমুদ্রতটের বালুতে।

পাশে বসলাম, আলাপ করলাম, জানলাম কলকাতার কাছেই থাকেন। তথাকথিত ভালোই যে চাকরী করেন তা কথাবার্তায় বেড়িয়ে এলো অজান্তে। তবে এখানে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করছেন অতি সাধারনভাবে কয়েকটা দিন কাটাতে। মনে হল চাইছেন তার সারাবছরের কর্মব্যস্ততার থেকে কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে নিজের সাথে একান্তে ছুটি কাটাতে।

দুজন পুরুষ মানুষ অন্তরঙ্গভাবে একান্তে কথাবার্তা বলতে পারলে অবধারিতভাবেই এসে পরে নারী প্রসঙ্গ। এক্ষেত্রেও কোনও ব্যতিক্রম হল না। কথায় কথায় জানালেন, ‘জানেন, এই মধ্যবয়সে এসে দুই নারীকে নিয়ে এক বিষম বিপদে পড়েছি। এক নারী যার প্রেমে আমি পাগল, যার জন্য আমি আমার ঘর-সংসার চাকরী-বাকরী সবই ছাড়তে পারি। তবে সে আমাকে বলে শুধু বন্ধু হয়ে থাকতে। আমি তার সঙ্গ পাই, তবে একেবারেই নিজের করে পাই না। এক প্রচন্ড অতৃপ্তি কুড়ে কুড়ে খায় আমাকে দিবারাত্র। আর অপরদিকে আছে দ্বিতীয় এক নারী – যার ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পূর্ন উল্টো । সে আমার জন্য সব কিছু ত্যাগ করতে রাজি যে কোন মুহুর্তে। কিন্তু আমি তার সঙ্গ কখনও কখনও পছন্দ করলেও তাকে সর্বক্ষণের সঙ্গী করতে আগ্রহী নই। বলুন তো এই দুই নারীর মধ্যে আমার কাছে কে বেশী মূল্যবান? কার কাছে আমার নিজিকে, বাকী জীবনকে সমর্পন করা উচিত? প্রথমজন যাকে সারাজীবন সম্পূর্নভাবে পাবো কিনা জানিনা, নাকি দ্বিতীয়জন যাকে চাইলেই সবসময় পাবো, কিন্তু তৃপ্ত হব কিনা জানিনা?

বছর ৪৫ এর অজিতবাবুর কথায় যারপরনাই অবাক হলাম। নারী নিয়ে সাধারনভাবে কথা হচ্ছিল। এতো একেবারে নিজের জীবন নিয়ে প্রশ্ন। দেখে তো বিবাহিতই মনে হচ্ছে। সন্তানাদি থাকাই উচিত্‌। এর মাঝে আবার আরো দুজন নারী। গোপনে জমাট ঈর্ষা আমাকে ঠেলে দিল অজিতবাবুকে এক চরিত্রহীণ, লম্পট হিসাবে চিহ্নিত করতে।

ঠোঁঠের কোনে এক হালকা তাচ্ছিল্লের হাসি হেসে বিশ্ব সাহিত্যের নানা লেখা থেকে কোট করে প্রায় প্রমাণ করে দিলাম, মরীচিকার পেছনে না ছুটে অনুগত প্রেম তথা প্রেমিকাকে সাগ্রহে গ্রহণ করা উচিত্‌। হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলা মোটেই কাজের কথা নয়। প্রকৃত প্রেম এই দুনিয়ায় প্রায় বিরল। তাই প্রায় ঘোষণা করলাম, ‘সমর্পিতা নারীকে গ্রহণ করুন, তবে প্রথমার বন্ধুত্বটাকেও অবহেলা করবেন না’।

কেমন একটা করুন মুখ করে অজিতবাবু প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা ভাই, এমনটা কি হতে পারে, বন্ধুত্ব বজায় রাখতে রাখতে কোন একদিন প্রথমার প্রেমকে আমি লাভ করতে পারি?’।

আমি এতক্ষণে বেশ মজা পেয়ে গেছি। বেশ বিজ্ঞের মতন বললাম, ‘হ্যাঁ, পৃথিবীতে সবই সম্ভব’। অজিতবাবুর চোখের কোনে একটু যেন আলো দেখতে পেলাম। খুব আস্তে করে বললেন, ‘আশায় আশায় আছি ভাই’।

বুঝলাম ভদ্রলোক বেশ ভালোই ফেঁসেছেন । কথা বিশেষ বাড়ালাম না। দুজনে চেয়ে রইলাম সমুদ্রের দিকে। জল কখনও এগিয়ে এসে পেছিয়ে যেতে থাকল, যেমনটা পৃথিবীর সব সমুদ্রের তীরে হয়ে থাকে আর কি। আমি বিড়ি ধরালাম। অজিতবাবু ধরালেন দামী সিগারেট। পোষাক-আষাকে অজ্ঞাতবাসে থাকলেও সিগারেটের ব্রান্ডটা তার সামাজিক অবস্থানটাকে একবার জানান দিয়ে গেল। প্রথম সিগারেট শেষ হবার আগেই দ্বিতীয়টাকে ধরালেন। আমার দিকে তাকালেন, চোখ আগের মতন নিস্তেজ নয়। বুঝলাম কিছু বলবেন। বললেন –

‘ছাত্রাবস্থায় বাড়ী থেকে পালিয়েছিলাম ঈশ্বরের সন্ধানে। ইচ্ছে ছিল বিবেকানন্দ হব। নানা ঘাটে জল খেয়ে ফিরে এলাম তিন বছর বাদে। আবার পড়াশোনা, ক্যারিয়ার, বন্ধু-বান্ধবের সাথে গান-বাজনা, সিনেমা, মদ-সিগারেট – একদম নরমাল জীবন। তারপর পরপর ভালো চাকরী এবং বিয়ে। কিন্তু ভাই ২৫ বছর ধরে নরমাল জীবন কাটানোর পরেও নিশির ডাকের মতন বারে বারে ফিরে আসে ঈশ্বরের হাতছানি। তিনি আমাকে ছাড়েনও না আবার ধরাও দেন না। আমার সুখে-দুঃখে, আপদে-বিপদে তিনি বন্ধুর মতন পাশে থাকেন। তবে আমার প্রেমে তিনি ধরা দেন না। তবে কলেজ জীবন থেকে নানা সুখে দুঃখে মদ আমাকে সঙ্গ দিয়েছে। তার সঙ্গ আমার কখনও ভালো লাগলেও তাকে নিয়ে সারা জীবন কাটানো আমার পক্ষে অসম্ভব। এই দুই হল আমার দুই প্রেম। এখন ভাই, আপনার দেওয়া উত্তরটা কি একই থাকল?’।

আমাকে হতভম্ভ করে দিয়ে অজিতবাবু উঠে দাড়ালেন, তৃতীয় সিগারেটটা ধরিয়ে হাঁটা দিলেন ধীর পদক্ষেপে। বিকালে কথা শুরু করেছিলাম। শীতের বিকাল শেষ হয়ে কখন যে ঝুপ করে রাত নেমে এসেছে খেয়াল করিনি। খেয়াল হল আজ অমাবষ্যা। চারিদিকে ছড়ানো এক জমাট নিকষ কালো রাতের গাম্ভীর্যের পূর্বাভাস। আমিও এক গভীর ভাবনায় ডুবে গেলাম। ঈশ্বর আর সুরাকে দুই পৃথক নারীর দুই পৃথকধর্মী ভালোবাসার রূপকের মাধ্যমে বর্ণনার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। অজিতবাবু মনের কথা বললেন, নাকি আমার কথাবার্তায় একটু চালিয়াতির গন্ধ পেয়ে এক অসাধারন চাল চেলে চলে গেলেন, সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারলাম না। বেশ একটা ছোট গল্পের ‘শেষ হয়ে হইল না শেষ’ গোছের ব্যাপার হল। আমি বোকা বনে গেলেও কোথায় যেন একটা মজা পেয়ে গেলাম।

গল্পটা এখানেই শেষ হওয়া উচিত্‌ ছিল। কিন্তু হল না। পরদিন একই সময় একই জায়গায় গিয়ে আমি বসে রইলাম যদি ভদ্রলোকের আর একবার দেখা পাই। তিনি এলেন। গত দিনের থেকে একটু দেরী করে এলেন। হাসলেন, বললেন, ‘শ্যামবাবু, উত্তরটা কিন্তু পেলাম না’।

কালকের ঔদ্ধত্য আজ আর আমার ছিল না। নরম গলায় বললাম, ‘আপনার বক্তব্য পেশ করার স্টাইলটি মশাই অসাধারন। একদমই বুঝতে পারিনি গল্পটা এদিকে মোড় নেবে। লড়াই যদি দুই রক্ত মাংসের নারীর মধ্যে হয় তবে আমার উত্তরটা একই থাকবে। তবে ঈশ্বর আর সুরার মধ্যে লড়াই হলে আমার মত সাধারন মানুষ আর কি বলতে পারে বলুন। আপনি ওমর খৈয়াম পড়ে দেখতে পারেন’।

আমার কথার মাঝে বলা কৌতুকের অংশটা অজিতবাবু ভালোভাবেই নিলেন। হাসলেন। বললেন, ‘আমার প্রেমিকার সংখ্যা আরও আছে মশাই। আজ আরও দুজনের কথা বলব। এরা হল তৃতীয়া এবং চতুর্থী। যাদের ছাড়া আমার জীবন অচল। একজন শান্ত ধীর-স্থির, লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে। কোন চাহিদা নেই আমার কাছে। নিজে থেকে আমার কাছে আসেও না। কেবল ডাকলে তবেই তাকে পাওয়া যায়। যখনই আসে পরম বন্ধুর মতই ব্যবহার করে, গভীর মমত্বে থাকে হৃদয় জুড়ে। তবে না ডাকলে সে আসে না। আর অপরজনও আমার অন্তরঙ্গ প্রেয়সী, থাকে আমার অন্তর ভরে। তবে তার আসা যাওয়া আমার নিয়ন্ত্রনাধীন নয়। সে আসে ধুমকেতুর মতন, ঝড়ের মতন। যতক্ষণ থাকে মাতোয়ারা করে রাখে হাসি-কান্নার দোলদোলায়। সে আমাকে ভালোবাসে তার নিজের শর্তে। আমি তার প্রেমে পাগল হলেও আজও তাকে আমার ঠিক বশে আনতে পারি নি’।

একটানা এতগুলো কথা বলে একটু দম নিলেন অজিতবাবু। তারপর সরাসরি প্রশ্ন করলেন ‘ বলুন তো এরা কারা?’

যাক আজকে আর দার্শনিক প্রশ্ন নয়। একেবারে সরাসরি। আজ হেয়ালি ঘেরা চমক নেই। ওনার সাথে খেলতে সরাসরি আমন্ত্রন জানাচ্ছেন উনি। এখন আমার নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন যে আমি এ খেলায় পারদর্শী কিনা। নানা কথা এদিক সেদিক ভাবার পরে বললাম, ‘মনে হয় আপনি সিনেমা দেখার কথা বলছেন, তাই না?’। মিটিমিটি হেসে অজিতবাবু বললেন, ‘অনেকটা কাছাকাছি এসেছেন। তৃতীয়া হল ‘বই’, যে আমাকে নিঃশর্তে প্রেম বিলিয়ে গেছে শৈশব থেকে। চতুর্থা হল আমার ‘গান’, যার প্রথাগত শিক্ষা আমার নেই। গান আমার আসে সময়ে সময়ে। যখন আসে আমায় জড়িয়ে ধরে দুহাত দিয়ে, মাতাল করে দেয়। তবে এমন বহু সময় এসেছে যখন ডাকলেও সে আসেনি, বা যদিবা এসেছে ভালোবাসেনি মন খুলে। আবার সে তার মতন সময়ে এসেছে তার পূর্ন প্রেম নিয়ে। তবে আমার এই দুই প্রেমিকাকে নিয়ে আমি বেশ আনন্দে আছি মশাই। দিব্বি কেটে গেল অনেকগুলি বছর। দুজনের পরস্পরে ঝগড়া-বিবাদ নেই, আবার ভাব-ভালোবাসাও নেই। তবে দুজনে কখনই একসাথে থাকে না। এরা বিভিন্ন সময়ে প্রেম দিয়ে আমাকে পরিপূর্ন করে রেখেছে’।

অজিতবাবু সিগারেট ধরিয়ে হাটা দিলে পরে ভাবতে বসি। না, উনি ঠিক মস্করা করছেন না। বলছেন জীবন দর্শনের কথা, তবে একটু মজার ঢঙে। স্টাইলটা নতুন, তবে এখন বেশ অনুমান করা যাচ্ছে চমকগুলো। এবার মকর সংক্রান্তি পরেছে চতুর্থীতে। তবে আজ প্রতিপদের চাঁদ সবে উকি দিচ্ছে। আমার মনেও যেন এক নতুন আলোর সংকেত দিয়ে গেলেন তিনি।

 পরদিন দেখলাম আমার আগেই এসে গেছেন। বুঝলাম গল্প বলার নেশায় মেতেছেন। অবশ্য আমারও নেহাত্‌ মন্দ লাগছে না। ভাবি ওনার গুরুত্বপূর্ন অফিস উনি কিভাবে চালান। লোকজন ওনাকে মান্যগন্য করেন, নাকি পাগল ভাবে। অবশ্য এমনটা হওয়াও সম্ভব, ওখানে উনি এক অন্য মানুষ। এখন বাড়ী থেকে এতো দূরে এসে, কর্মহীন দিনের শেষে হয়তো ওনাকে অন্যরকম পাগলামিতে উৎসাহিত করেছে।

‘বসুন শ্যামবাবু। আজও আছে আমার দুই প্রেয়সীর কথা। আমার পঞ্চমী আর ষষ্ঠী। প্রথমজন আমার জীবনে এলো আমার শৈশব কেটে যখন যৈবনে আমি প্রবেশ করলাম। আমার গোঁফ-দাড়ি গজাল, শরীরে এলো হরমোনের পরিবর্তন। যখন বিশ্বজগত্‌কে এক নতুন চোখ দিয়ে দেখতে শুরু করেছি, সে নারী এলো তার নিষিদ্ধ মাদকতা নিয়ে। গোপনে তার সাথে দেখা সাক্ষাত্‌। লুকিয়ে লুকিয়ে তার উষ্ণ চুম্বনের আনন্দ আমার সারা শরীরে এক মাদকতা এনে দিত। বয়স বাড়লেও তার প্রতি প্রেম রয়ে গেল। সে কখনই বলেনি চিরকাল শুধু তার হয়েই থাকতে হবে। আমার জন্য সে তার জীবন যৌবন এতোগুলো বছর ধরে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করে বিলিয়ে দিল। আজ এতো বছর পরে তার সে রূপ নেই, নেই তার আকর্ষক শক্তি। আজ আর তাকে আমি আগের মতন ভালোবাসি না – কিন্তু তার এতোদিনকার সঙ্গ ত্যাগ করতেও বড় মায়া লাগে। শ্যামবাবু, আগে এটার উত্তর দিন, পরেরটির কথা পরে জানাচ্ছি’।

গত কয়েকদিনের অভিজ্ঞতায় আমি অনেক চালাক হয়ে গেছি। তাই আজ আর উত্তর দেবার চেষ্টা করলাম না। একটু সময় অপেক্ষা করে অজিতবাবু বললেন, ‘ সিগারেট, মশাই। সেই কৈশোরে তাকে ভালোবেসেছিলাম। আজ তার প্রেমে সেই আবেশ নেই। আমি তাকে পরিত্যাগ করতে চাই, কিন্তু মায়াকাতর হয়ে পড়ি সেকথা ভাবলে’।

বললাম, ‘ গল্পটা ভালোই ফেঁদেছেন।তবে আমার কেমন যেন সন্দেহ হয়, আপনার দ্বিতীয় এবং পঞ্চম প্রেমিকা, অর্থাত্‌ মদ আর সিগারেটের প্রেমে কি আপনি সত্যিই পড়েছিলেন, নাকি দুজনেই আপনার হালকা প্রেমের ছোয়া?’।

হাসলেন অজিতবাবু। হয়তো আমাকে সমর্থন করলেন, ঠিক বুঝলাম না। বললাম, ‘ তবে আপনি আপনার গভীর প্রেমগুলির সাথে যে আপনার হালকা প্রেমগুলোকে এক আসনে বসিয়ে সমান মর্যাদা দিলেন, এই ভাবনাটা আমার অসাধারন লেগেছে। আপনাকে এর জন্য সাধুবাদ জানাই। যাহোক এবার আপনার ষষ্ঠ নায়িকার সাথে আলাপ করা যাক’।

‘ষষ্ঠ প্রেমিকার কথা আমি আর প্রশ্ন-উত্তরের ছকে ফেলব না। সরাসরি বলি, এ হল আমার জীবন-যৌবন-চাকরী-সংসার। আমার দৈনন্দিন জীবন, তার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, সুখ-দুঃখ। এতোগুলো বছর এর সাথে অতিবাহিত করে এখন আমি নিশ্চিত নই, একে আমি ভালোবাসি কিনা? কখনও কি ভালোবেসেছিলাম তাকে? আমার জীবনকে? ঠিক জানিনা শ্যামবাবু’।

অনেকক্ষণ দুজনে চুপ করে রইলাম। অজিতবাবু আলোচনাটা এমন এক জায়গায় এনে শেষ করলেন যে আমার মন ভারাক্রান্ত হয়ে রইল। অনেক পড়ে ধরা গলায় বললাম, ‘আপনার গল্প তো শেষ হয়ে গেল, অজিতবাবু। আর কি আমাদের দেখা হবে?’।

‘কাল আছি। পড়শু সকালে সংক্রান্তিতে স্নান করে চলে যাব। তবে কাল দেখা হবে’। গম্ভীরভাবে কথাগুলো বলে সিগারেট ধরিয়ে হাঁটা দিলেন অজিতবাবু অন্যান্য দিনের মতো।

পরদিন সকাল থেকেই ভাবছিলাম অজিতবাবুর প্লটটা নিয়ে একটা গল্প লিখলে কেমন হয়। কোথাও ছাপা হোক বা না হোক এই প্লটটা লিখে রাখা উচিত্‌।

দেখা হল যথাসময়েই। হালকা হাসি দিয়ে বললেন, ‘আজকে একটা অন্যরকম গল্প শোনাবো মশাই’। খানিক চুপ থেকে শুরু করলেন। ‘আসলে আমি হলাম রাজার ব্যাটা রাজা। শৈশবে আমি যুবরাজ। বংশের নিয়ম মেনে আমার বিয়ে হয়ে গেল আমার আজকের পাটরানীর সাথে। আমার জ্ঞান হবার পর থেকেই সে আমার খেলার সাথী, আমার বন্ধু, আমার প্রেমিকা, আমার সবকিছু। রাজপুত্র বা রাজাদের তো কেবলমাত্র একটি রানী থাকে না। আমি যুবরাজ থাকতে থাকতেই আমার বিয়ে হয়ে গেল উত্তর আর পশ্চিম দেশের দুই রাজকন্যার সাথে। আমার পাটরানী এ ঘটনাকে কিভাবে দেখেছিল জানিনা। আমি তাকে কখনও জিজ্ঞাসা করিনি, তার প্রেমিকের ভাগ সে অন্যকে কিভাবে দিয়েছিল। কারন তখন আমি নতুন নতুন রানীর প্রেমে মত্ত। হয়তো বা সে নীরবে নির্জনে অশ্রুপাত করে থাকতে পারে। তবে লোকে দেখল সে আলাদা আলাদাভাবে অপর দুই রানীর সাথেই ভাব করে নিল।

‘আমি বোধ হয় দুঃশ্চরিত্র। কারণ এই তিন রানী থাকা সত্বেও আমি আরও দুজনের প্রেমে পড়লাম। তার মধ্যে এক নারী আমার এক রানীর সহচরী। তার সাথে খুনসুটি করি, বিশ্রম্ভালাপ করি। রানীর সহচরী তথা দাসীদের বোধ হয় আলাদা করে বিয়ে হয় না। তাই সে নারী আমার হাতে নিজেকে সমর্পন করে নিঃশর্তে, কোনওদিন সে আমাকে সম্পূর্নভাবে পাবেনা এ কথা জেনেই।

‘অপর নারীর দেখা পাই মৃগয়া করতে গিয়ে জঙ্গলে। বছরে যখন শরৎ বা বসন্তে আমি মৃগয়ায় যাই, তার সাথে মিলিত হই গোপনে। কতটা গোপনে অবশ্য জানিনা। কারন মাঝে মধ্যে মনে হয় বাকি সকলেই সবকিছু জানে। তবে রাজার বিরুদ্ধে রাজার সামনে কথা বলবে কে? আর কেঊ জানুক বা না জানুক পাটরানীর অজানা নয় কিছুই। সে তো শুধু আমার পাটরানী নয়, সে আমার সমগ্র রাজ্যের মহারানী। তাকে তার মত করে রাজ্যের ভালোমন্দের খবর রাখতে হয়। সে তার রাজাকে শৈশব থেকেই এতোটা ভালোবেসেছে যে আমার সমস্ত আনন্দ-মর্জিকে সে প্রশ্রয় দেয়। আমার মন বুঝেই সে কোনও রাতে বলে, রাজা আজ তুমি মেজ বা সেজ রানীর ঘরে যাও। অথবা বলে, রাজা অনেকদিন তুমি মৃগয়াতে যাওনি দেখছি।

‘কিন্তু একমাত্র সেই বোধহয় জানে আমি আমার এতো প্রেমিকার কাউকেই আমার সমগ্র মন-প্রাণ সমর্পন করিনি। সেই কবে এ রাজ্যের প্রধান পুরোহিতের একমাত্র পুজারিনী কন্যাকে সেই কৈশোরে দেখে মজেছিলাম। আজও আমি মন্দিরে যাই তাকে একটিবার দর্শন করবার জন্য। এই হল একমাত্র নারী যে রাজার প্রেমে ধরা দেয় না। আমার পাটরানী নিত্যনতুন উপাচার সহকারে আমাকে নিয়ে যে মন্দিরে যান তা কি পরোক্ষে এই নারীকে রাজার বশে আনার জন্য? ধন্য পাটরানী, ধন্য তোমার সর্বত্যাগী প্রেম। পুরোহিত-দুহিতার প্রতি আমার নিবেদিত প্রেম কোনওদিন পূর্নতা পাবে কিনা তা আমি বলতে পারব না শ্যামবাবু, তবে এ গল্পে আমার পাটরানী যে আমার অন্তরাত্মা তা বোধ হয় বুঝতে পেরেছেন’।

অনেকটা লম্বা কথা বলে থামলেন অজিতবাবু। বললাম, ‘যদিও আপনি অন্য গল্প বলার নামে এটি পেশ করলেন, তবু বুঝলাম আসলে এটি আগের গল্পগুলোর এক নতুন মোড়ক। মৃগয়ারমনী আর রানীর সহচরী যে মদ আর সিগারেট তা বুঝলাম। আর উত্তর-পশ্চিমের দুই রাজকন্যা হল বই আর গান।

‘আপনার পাটরানী, যা কিনা আপনার অন্তরাত্মা তার মাঝেই লুকিয়ে আছে আপনার আগে বলা ষষ্ঠ প্রেয়সীর কথা, যা কিনা আপনার জীবন সংসার, যাকে আজ আর আপনি ভালোবাসেন কিনা নিশ্চিত নন। আর পুরোহিত-দুহিতার প্রতি আপনার প্রেম হল আপনার প্রথম প্রেম। সেটি আপনার ঈশ্বরানুরাগ। আজ এই পূন্য ক্ষেত্রে দাড়িয়ে একথাই শুধু বলতে পারি, ঈশ্বরের প্রেম শুধু তার অনুগ্রহেই পাওয়া যায়। তার প্রেম প্রার্থনা করুন করজোড়ে ভিক্ষুকের মতন’।

খানিক চুপ করে থেকে বললাম, ‘চললাম অজিতবাবু। আপনাকে ভুলব না। প্রার্থনা করি পরম প্রেমময় আপনার মনোবাসনা পূর্ন করুক’।

 আজ সূর্যাস্ত হয়ে গিয়েছে। সমুদ্রে চন্দ্রালোক এক অসামান্য মায়াবী বাতাবরনের ছোঁয়া দিয়েছে। সমুদ্রসৈকতে একাকী অজিতবাবুকে তার প্রথম প্রেমে মগ্ন অবস্থায় রেখে আমি চললাম আমার ব্যস্তমুখর জীবনের দিকে।