বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থা বর্তমানে এক গভীর সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করছে। এটি এক বৃহত্তর মেধা ও নৈতিক অবক্ষয়ের প্রতিচ্ছবি। বাংলার প্রাচীন ‘মেধা-ঐতিহ্য’ আজ প্রশ্নবিদ্ধ, যার শিকড় সুদূরপ্রসারী এবং একটি উদ্দেশ্যহীন শিক্ষাদর্শে পরিণত হয়েছে। ব্রিটিশ শাসন আমাদের মেধাকে নিস্তেজ করে দিচ্ছে বলে শ্রী অরবিন্দ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় লিখেছিলেন। আজ শতাধিক বছর পর আমাকে লিখতে বাধ্য হতে হচ্ছে যে আমরা নিজেরাই আমাদের নিজেদের মেধার ঐতিহ্যর অপমৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে শিক্ষা ও সংস্কৃতি বাঙালি জাতির শক্তিশালী মেরুদন্ড হিসেবে ব্রিটিশ শাসনের মত পরাক্রমী শাসন ব্যবস্থা বিরুদ্ধে নিজেদেরকে তুলে ধরতে সামর্থ্য হয়েছিল। আজ তা প্রায় ভঙ্গুর। আজ আমাদের শিক্ষা নিজেদেরকে আত্মনির্ভর, আত্মনতি , জাতীয় চেতনা ও জাতীয় মূল্যবোধের দিকে নিয়ে যাচ্ছে না, যা শ্রী অরবিন্দ জাতীয় শিক্ষার চারটি স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত করিয়েছিলেন।
২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট পশ্চিমবঙ্গের ২০১৬ সালের স্কুল সার্ভিস কমিশনের (SSC) মাধ্যমে করা প্রায় ২৬,০০০ এর বেশি শিক্ষক নিয়োগকে অবৈধ ঘোষণা করা, এই অবক্ষয়ের উপর সিলমোহর প্রদান করেছে। এটি বিচারব্যবস্থার ইতিহাসে এক নজিরবিহীন রায়। আদালতের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, মেধা তালিকা লঙ্ঘন, ওএমআর স্ক্রিপ্ট পরিবর্তন এবং অযোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগ—সবই সংঘটিত হয়েছে রাজনৈতিক প্রভাব এবং আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে। তদন্তকারী সংস্থা CBI-এর মতে, এই নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে ঘুষের রেট চার্টও নাকি স্থির ছিল। একাধিক রাজনৈতিক নেতা এবং প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী ইতিমধ্যেই এই মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন ও গ্রেফতারও হয়েছেন।
একসময় ‘শিক্ষকতা’ ছিল বাঙালি সমাজ গঠনের মূল কাঠামো। কিন্তু কয়েক দশক ধরে দুর্নীতির মাধ্যমে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হয়ে অনেকে আজ শিক্ষাদানের বদলে, পরীক্ষায় মার্কস পাইয়ে দেওয়া, সাইকেল বা বৃত্তি বিতরণের মাধ্যমে ছাত্রদের ‘খুশি’ রাখতেই ব্যস্ত। এতে একদিকে যেমন শিক্ষার গুণগত মান ক্ষুণ্ন হচ্ছে, অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে গড়ে উঠছে সহজ পথের মানসিকতা।
UNESCO-এর ২০২১সালের Global Education Monitoring (GEM) রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে শিক্ষার গুণগত মানে ব্যাপক ফারাক দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গে বিদ্যালয় স্তরে পাঠদানের সময়, শ্রেণিকক্ষ উপস্থিতি ও ফলাফলে নিম্নগামী প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। ASER report (Pratham Foundation) অনুযায়ী পশ্চিমবাংলায় সরকারি স্কুলে পঠনরত দ্বিতীয় শ্রেণীর শিশুর সংখ্যা ২০১৮ সালে ছিল ৩৬.৬% তা কমে গিয়ে ২০২১ সালে হয়েছে ২৭.৭%। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-এর ছায়াও নেই বাংলায়।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ (NEP 2020) একটি সুসংহত ভারতকেন্দ্রিক শিক্ষার কথা বলেছে—যেখানে চিন্তা, বিশ্লেষণ, নৈতিকতা, সংস্কৃতি ও দক্ষতার সমন্বয় ঘটবে। কিন্তু বাংলায় তা কার্যত অপ্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে। যেমন, এখনও শিক্ষার মাধ্যমে চিন্তন ক্ষমতা ও সমস্যা সমাধান দক্ষতা গড়ে তোলার কোন বাস্তব কর্মপন্থা নেই। বরং বই ছাড়া, রিল বানানো, গেম খেলা, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং করা, পরীক্ষায় পাশ করানো এবং রাজনৈতিক অনুগত, শিক্ষক নিয়োগই হয়ে উঠেছে নতুন নিয়মনিষ্ঠা।
একজন মারাঠি লেখকের উক্তি যথার্থ:
“ভাবতে অবাক লাগে, যে এই বাংলা থেকেই এক সময়ে রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, জগদীশ বসু, বিদ্যাসাগর, শ্রী অরবিন্দের মতো মনীষী জন্মেছিলেন। আর আজ সেই বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা দুর্নীতিতে ডুবে।”
এই মন্তব্য শুধু আবেগ নয়, বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। বাংলার মেধা একসময় বিশ্বদরবারে নোবেল (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অমর্ত্য সেন), র্যামন ম্যাগসেসে, ভারতরত্নের মতো সম্মানে সম্মানিত হয়েছে। অথচ আজকের প্রজন্মের সামনে নেই কোনো অনুপ্রেরণা, নেই আদর্শ। তাদের “মাছ” দিতে শেখানো হচ্ছে’—এতে ভোট পাওয়া যায়; কিন্তু মাছ ধরতে শেখানো হচ্ছে না—তাতে আত্মনির্ভরতা, আত্মউন্নতি করা যায়, যাতে বাঙালি জাতির চেতনা ও মূল্যবোধ জাগ্রত হয়। এ এক চিন্তাহীন আনুগত্যের শিক্ষাব্যবস্থা। এখানে প্রশ্ন উঠছে—এই ব্যবস্থায় গড়ে ওঠা শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আমলা হলে কী হবে? অযোগ্য ডাক্তার ভুল চিকিৎসায় প্রাণ নেবে। অর্ধশিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ার বানাবে ভঙ্গুর ব্রিজ। অযোগ্য আমলা সমাজের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করবে। কলকাতার মাঝেরহাট ব্রিজ ভেঙে পড়ার ঘটনায় সরকারি নির্মাণের অযোগ্যতা নিয়ে জনরোষ তৈরি হয়েছিল। আজ সেই অযোগ্যতার বীজ বপন হচ্ছে বিদ্যালয়ের বেঞ্চেই। তাছাড়া, শিক্ষার্থীদের বোঝাতে হবে—শিক্ষা মানে “সুবিধা পাওয়া” নয়, বরং নিজেকে গড়ে তোলার অবিরাম প্রক্রিয়া। একজন শিক্ষক যেন শুধু তথ্যদাতা না হন, তিনি হোন চিন্তা-উদ্দীপক, একজন পথপ্রদর্শক। সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায় একটি দৃষ্টান্তমূলক সিদ্ধান্ত। এটি শুধু একটি আইনগত পদক্ষেপ নয়, এটি একটি সামাজিক জাগরণের সুযোগ।
বাংলা একদিন ছিল মেধা ও মননের দেশ। সেই ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করতে হলে, দুর্নীতিমুক্ত নিয়োগ, গুণগত শিক্ষক প্রশিক্ষণ, এবং নীতিনিষ্ঠ প্রশাসন—এই তিনটি স্তম্ভে দাঁড় করাতে হবে শিক্ষাকে। ছাত্রদের বুঝতে দিতে হবে—শিক্ষা কোনো পাইয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া নয়, এটি আত্মশক্তির উৎস। এটির চারটি স্তম্ভ হচ্ছে আত্মনির্ভরতা, আত্মন্নতি, চেতনার বিকাশ, মূল্যবোধের বিকাশ। এই স্তম্ভ গুলোই বাঙালি জাতিকে আবার ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করবে যাতে মেধা আর মনের পুনরুদ্ধার হয়।
সূত্র:
Supreme court order in SSC scam (2025)
ASER report 2021 (Pratham Foundation)
UNESCO – Global Education Monitoring Report (2021)