শুভদীপ চৌধুরী (প্রধান শিক্ষক)
আমাদের অধিকাংশের বিদ্যালয় জীবন ছিল বাংলা মাধ্যমে, এই শিক্ষা গ্রহণ আমাদের প্রজন্মকে কিন্তু পরবর্তীতে নিজস্ব পেশার ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধাতে ফেলতে পারেনি। বিভিন্ন সরকারি বা বেসরকারি ক্ষেত্রে যোগযোগের মাধ্যম হিসাবে সাবলীল ভাবেই বাংলা বা অন্য ভাষার প্রয়োগ আমরা করেছি ও করছি | ২০০০ সাল বা তার পরবর্তীতে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আচমকা আকর্ষণ বৃদ্ধি পায় ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে, মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধের সমান এই আপ্ত বাক্য থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণী বিস্মৃত হয়। ইংরেজি মাধ্যমের চাকচিক্য কালের নিয়মে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। ইংরেজি মাধ্যমে সন্তান কে না পড়ালে নিজের সামাজিক মর্যাদার বিচ্যুতি ঘটবে এই ধারণাও তৈরী হয়। গতানুগতিক পাঠক্রম, পঠনপাঠন পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি ২০০০ সাল থেকে ২০১৩ অবধি রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি ও সরকার পোষিত বাংলা মাধ্যমের বিদ্যালয়গুলি। কোনো রকম দ্বিধা না রেখেই স্বীকার করতে হয় যে সেই সময়ের বিদ্যালয় প্রধান দের চাহিদা অনুযায়ী নিজেকে বা নিজেদের বিদ্যালয়ের পঠনপাঠন পদ্ধতি, বিদ্যালয়ের পরিবেশ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সদর্থক ভূমিকা ছিল অত্যন্ত নেতিবাচক। ফলাফল স্বরূপ বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়গুলি শহর বা শহরতলিতে ছাত্র-ছাত্রী অপ্রতুলতায় ধুঁকতে শুরু করে।
২০১৩ ও তাঁর পরবর্তী সময় তে অধিকাংশ বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়তে বিদ্যালয় প্রধানরা অবসর গ্রহণ করতে থাকেন ও তাঁদের স্থান পূরণ করেন আধুনিক চিন্তা ভাবনার একঝাঁক নতুন বিদ্যালয় প্রধান। তাঁরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে অনুধাবন করেন সেই কারণগুলি যার জন্য বাংলা মাধ্যম থেকে মুখ ফেরাচ্ছেন অধিকাংশ বাঙালি অভিভাবক। বিদ্যালয়গুলির পঠনপাঠন পরিবেশ ও পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন ঘটে | ডিজিটাল বা স্মার্ট ক্লাসরুম, অত্যানুধিক লাইব্রেরি বা ডিজিটাল লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি, অডিওভিসুয়াল লার্নিং পদ্ধতি, পিয়ার লার্নিং, লার্নিং উইথ ফান পদ্ধতি, স্পোকেন ইংলিশ ক্লাস ইত্যাদি বদলে দিতে শুরু করে বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়গুলির মান। ধীরে ধীরে তাঁর অতি পুরোনো কৌলিন্য ফিরে পেতে শুরু করেছে বর্তমানে শহর ও শহরতলীর বিদ্যালয়গুলি। এক্ষেত্রে সরকারি বিভিন্ন শিক্ষা উন্নয়ন মূলক প্রকল্পগুলি অনুঘটকের কাজ করে। কন্যাশ্রী, সবুজসাথী, মিডডে মিল, শিক্ষাশ্রী, স্মার্ট ফোন প্রদান ইত্যাদি ক্ষেত্রে বৃহত্তর ভূমিকা নিয়ে সদর্থক করে তোলেন বিদ্যালয় প্রধানগণ তাঁর সুযোগ্য সহকর্মীদের সাহায্যে। যেকোনো দল বা গোষ্ঠীর এর নিরন্তর দক্ষতা নির্ভর করে সেই দলের অধিনায়কের ভূমিকার উপর, ঠিক তেমনি বিদ্যালয় শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ করে বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়গুলি যেখানে প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি সেখানে বারংবার অভিভাবক সভা করে, অভিভাবকদের সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রেখে বিদ্যালয় প্রধানরা সেই কাজ অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সাথে করছেন। আমি আশাবাদী ভীষণভাবে যে আগামী এক দশকের মধ্যে বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়গুলি ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের চেয়ে পঠনপাঠন মানের ক্ষেত্রে কয়েক যোজন আগে অবস্থান করবে। ভুলে গেলে চলবে না বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়তে ১২ বছর (প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী) পড়তে যে খরচ হয় সেই খরচ ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে ২/৩ মাসের খরচের সমান।
আসুন, আমরা সকল অভিভাবক রাজ্যের সমস্ত বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়গুলির প্রতি আস্থা রাখি ও বর্তমান বিদ্যালয় প্রধানদের এই নিরলস প্রচেষ্টার সাথে সামিল হই বাংলা ভাষার স্বার্থে, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে।