• facebook
  • twitter
Thursday, 18 December, 2025

কণ্ঠস্বর রোধে হত্যা

গাজায় গণহত্যা শুরুর পর থেকে বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র কিংবা ড্রোন হামলায় এবং গুলিবিদ্ধ হয়ে অন্তত ২৩০ জন সংবাদকর্মী নিহত হয়েছেন।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

সত্যকে সামনে নিয়ে আসাই সাংবাদিকদের কাজ। আর এই সত্যকেই অনেকে গোপন রাখতে চান নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। প্যালেস্তাইনের গাজা শহরে মার্কিন মদতপুষ্ট ইজরায়েলের গণহত্যা চাপা দেওয়ার জন্য এবার কণ্ঠরোধের চেষ্টা। ড্রোন হামলা চালিয়ে প্যালেস্তাইনে কর্মরত সাত সাংবাদিককে হত্যা করেছে ইজরায়েল। এ খতম করার উদ্দেশ্য খুবই স্পষ্ট। গাজায় আগামী কয়েক দিন যা ঘটতে চলেছে, তা যেন কোনওভাবে বাইরে না প্রকাশ হয়। ফলে যাঁদের মাধ্যমে শহরের বীভৎস পরিস্থিতির বিষয়ে গোটা দুনিয়ার মানুষ জানতে পারছেন, আগে তাঁদের শেষ করতে হবে।

দুনিয়ার মহাশক্তিধরেরা যে সত্য ধামাচাপা দিতে মরিয়া, প্রাণের বাজি ধরে বারবার তা তুলে ধরে এককথায় ‘শহিদ’ হলেন এই সাংবাদিকরা। আমেরিকা, ব্রিটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের স্বঘোষিত পাহারাদারদের আশ্রয়ে লালিত-পালিত ইজরায়েল গত দেড় বছর ধরে গাজায় যে গণহত্যা চালাচ্ছে, গোটা বিশ্বকে তা জানানোই ছিল সাংবাদিকদের অপরাধ। গাজায় আলশিফা হাসপাতালের বাইরে এক মাঝারি আয়তনের তাঁবুতেই থাকতেন এই সাংবাদিকরা। সুনির্দিষ্ট ড্রোন হামলায় তাঁবুটি উড়িয়ে দিয়ে ওই সাত সাংবাদিককে হত্যা করেছে ইজরায়েল।

Advertisement

নিহতদের মধ্যে ছিলেন সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার অতি পরিচিত সাংবাদিক আনস আলি শারিফ। তাঁর সঙ্গেই নিহত হন আল জাজিজার সংবাদ প্রতিবেদক মহম্মদ কারিকাহ ও চিত্র সাংবাদিক ইব্রাহিম জাহের, মোয়ামেন আলিওয়া ও মহম্মদ নৌফল। মহম্মদ আল খালাদি নামের এক স্থানীয় সাংবাদিকেরও এই ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে। এঁদের সবারই বয়স ২৫ থেকে ৪০-এর মধ্যে। এই হামলায় আরও তিন সাংবাদিক আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে সংবাদ কর্মী সংগঠন ‘রিপোর্টার্স উইথআউট বর্ডার্স’। এই ঘটনায় নিন্দার ঝড় উঠেছে গোটা বিশ্বজুড়ে। তীব্র নিন্দা জানিয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে শুরু করে একাধিক দেশের সরকার।
প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকেই জানিয়েছেন, হামলার গতিপ্রকৃতিতেই স্পষ্ট, কোনও দুর্ঘটনা নয়, বরং ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করেই এই ‘খতম’ অভিযান চালানো হয়েছে। নির্বিচারে বোমা, গুলি, ক্ষেপণাস্ত্র কিংবা ত্রাণ শিবিরে খাবার সরবরাহ আটকে গাজার অধিবাসীদের ‘ভাতে মারার’ যে জঘন্য কৌশল ইজরায়েল নিয়েছে, সেই ব্যাপারে এই সাত সাংবাদিক প্রতিনিয়ত দায়িত্বের সঙ্গে গোটা দুনিয়াকে খবর দিচ্ছিলেন। বেশ কয়েকদিন ধরেই ইজরায়েলি সেনার তরফে তাঁদের হুমকি দেওয়া হচ্ছিল বলে দাবি করেছে আল জাজিরা।

Advertisement

গাজায় গণহত্যা শুরুর পর থেকে বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র কিংবা ড্রোন হামলায় এবং গুলিবিদ্ধ হয়ে অন্তত ২৩০ জন সংবাদকর্মী নিহত হয়েছেন। এর সিংহভাগই প্যালিস্তিনীয়। ইজরায়েলি সেনার দাবি, এই সমস্ত সাংবাদিক নাকি হামাসের হয়ে কাজ করছিল। একাধিক বার তাঁদের কাজ বন্ধ করার হুমকি দেওয়া হয়, অথবা পত্রপাঠ গাজা ছাড়তে বলা হয়।

রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেজের প্রেস সহায়ক স্তেপান দুজারিক এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন। ইরানের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র ইসমাইল বাঘেই বলেছেন, ‘প্রেস ব্যাজ দেখেও যে ইজরায়েলের গণহত্যাকারীরা রেয়াত করে না, তা আবারও প্রমাণ হলো। ঠান্ডা মাথায় এই সাংবাদিকদের হত্যা করা হয়েছে।’ কাতারের প্রধানমন্ত্রীও এই ঘটনার নিন্দায় সরব হয়েছেন। ‘কমিটি ফর প্রোটেকশান অব জার্নালিস্টস’ এক বিবৃতিতে বলেছে, ইজরায়েল যেভাবে কোনও প্রমাণ ছাড়াই সাংবাদিকদের সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দিয়ে হত্যা করেছে, তা মুক্ত সাংবাদিকতার উপর আক্রমণ। যাঁদের নির্দেশে এই সমস্ত হত্যা সংঘটিত হয়েছে, তাঁদের পত্রপাঠ দোষী সাব্যস্ত করতে হবে।’ রিপোর্টার্স উইথআউট বর্ডার্স’ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘সাংবাদিকদের সন্ত্রাসবাদী তকমা দেওয়া ইজরায়েলের পুরানো অভ্যাস। এই ঘটনার প্রতিবাদে শুধু নিন্দা নয়, রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।’

গত ২২ মাস ধরে হামাস-ইজরায়েল যুদ্ধ চলছে গাজায়। অন্তত ২৩০ জন সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন এই যুদ্ধে। এই প্রথম কোনও সাংবাদিককে হত্যার দায় নিল ইজরায়েল। মানবাধিকার পর্যবেক্ষকদের মতে, সংবাদমাধ্যমের উপর এই ধরনের লাগাতার হামলা আগে কখনও দেখেনি বিশ্ব। এই হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক আইন ভঙ্গ করা ছাড়া আর কিছুই নয়।

Advertisement