ড. পার্থ কর্মকার, শিক্ষাবিদ
সরকার পোষিত বা সাহায্যপ্রাপ্ত উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধানদের বর্তমানে অস্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক চাপের মধ্যে কাজ করতে হয়। সঙ্গে থাকে অতিসীমাবদ্ধ লোকবল। আর ব্যক্তিগত সময় ও ক্ষেত্রগুলোকে বলি দিতে হয় প্রায়শই।
Advertisement
কাজের চাপ ও পরিধি যেমন বিগত দশক থেকে গুণোত্তরীয় হারে (GP) বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনই বেঁধে দেওয়া সময়সীমার মধ্যে লক্ষ্যপূরণের জন্য নির্দিষ্ট কাজ করতে হচ্ছে। কখনও আবার ‘রেডি-টু-মুভ’ শর্ত ও অবস্থার মধ্যে কাজ করতে হয়। আবার একই সঙ্গে একাধিক কাজও করা বিরল ঘটনা নয়। আর এই জন্যই তাঁদের অসম্ভব অতিরিক্ত মানসিক চাপ আর ধকল নিতে হচ্ছে।
Advertisement
একদিকে নানান শিক্ষাগত আর হরেক কিসিমের সরাসরি শিক্ষা বহির্ভূত কাজ তো আছেই, তার উপর তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর নানান তথ্য সংরক্ষণ ও সেগুলি বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল—এখন তাঁদের কর্মপরিধির কেন্দ্রবিন্দু। সময়মত ত্রুটিমুক্ত এই কাজগুচ্ছের নিরন্তর চর্চা আর রূপায়ণ সত্যিই রীতিমত চ্যালেঞ্জ। তাঁদের কার্যত প্রতিদিন সর্বদা সতর্ক সামিল থাকতে হয়—তা সেটা অফলাইন হোক বা অনলাইন, বিদ্যালয় চত্বরের মধ্যে হোক অথবা বাইরে। ফলে তাঁদের দায়িত্বকে কোনো বাঁধাধরা সময়ের নিগড়ে সীমাবদ্ধ করা শক্ত। অতএবং আন্দাজ করতে অসুবিধা হয় না, বিদ্যালয়কে স্বাভাবিক গতিশীল রাখতে প্রধানদের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ও মুখ্য। দেখা যাচ্ছে যে, বর্তমানে বিদ্যালয়ের পরিবেশ একাধারে গতিশীল, আধুনিক ও জটিল সেজন্য প্রধানদের কাছে চ্যালেঞ্জটাও স্বভাবতই বহুমখী।
এজন্যই বিদ্যালয় প্রধানদের হতে হবে ‘বস’ নয়, একজন নেতা বা লিডার। এই লিডার হতে গেলে তাঁর বিশ্বস্ত সঙ্গী হল অতিরিক্ত ধৈর্য্য, নিরপেক্ষতা, উদ্ভাবনী ক্ষমতা, প্রচলিত ছকভাঙ্গার সৎসাহস, সময়ের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া আর প্রয়োজনে ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা ৷
LEADERSHIP শব্দটির দশটি অক্ষর বিদ্যালয় প্রধানরা তাই এইভাবে সাজিয়ে নিতে পারেন-
L = LISTENING, E = EMPATHY,
A= ATTITUDE, D = DREAMS,
E = EFFECTIVENESS,
R=RIGHTEOUSNESS,
S = SENSE OF PURPOSE,
H=HONESTY, I= INNOVATION,
P=PURITY.
প্রতিষ্ঠান চালাতে প্রধান অবশ্যই কড়া হবেন কিন্তু রূঢ় বা অনমনীয় হবেন না। সহজ সম্পর্ক গড়ে তুলতে যোগাযোগ বাড়াতে হবে—যত সম্পর্ক গভীর হবে Leadership ততই শক্তিশালী হবে। একজন প্রকৃত Leader তাঁর সহকর্মীদের মধ্য থেকেও আরও Leader তৈরি করবেন। এবার Leadership বিষয়টা নিয়ে একটু বিশদে আসা যাক। বর্তমান সময়ে বিদ্যালয়ে বৃদ্ধিজনিত উন্নতি (Improvement) একমাত্র চাহিদা নয়, বিকাশমূলক উন্নতি (Develop- ment) হল সামাগ্রিক চাহিদা, আর এই চাহিদা পূর্ণ করতে বিদ্যালয় প্রধানকে শুধু সাধারণ Leader হলে হবে না, রূপান্তরমূলক (Transformational) Leader হতে হবে।
এই ধরণের Leadership থাকলে সাধারণ বিদ্যালয়ের চাহিদা অনুযায়ী প্রধানগণ তাঁদের লিডারশিপের গুণমান, নতুন বিশ্বাস আর পেশাগত উপযুক্ততাকে সঙ্গী করে সঠিক অভিমুখ নির্বাচন করে বিকাশমূলক পদ্ধতিসমূহের মাধ্যমে একটি সাধারণ বিদ্যালয়কে অসাধারণ বিদ্যালয়ে পরিণত করেন। মনে রাখতে হবে, আজকের ডিজিটাল জ্ঞানের সমাজে শিক্ষার লক্ষ্য জটিল, শিক্ষা পদ্ধতি চ্যালেঞ্জিং, শিক্ষা সংক্রান্ত কর্মভার কঠিন, প্রত্যাশা বিচিত্র, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর প্রবেশ ব্যাপক বিস্তৃত। বিদ্যালয়ের দায়বদ্ধতা পূর্বের তুলনায় তাই অনেক বেশি। তাই এই নতুন ব্যবস্থার সঙ্গে তাল মেলাতে পরিচালন ব্যবস্থাকেও বদল ঘটাতে ও সময়োপোযোগী করে নিতে হবে। তাই এখন শুধু দৈনন্দিন বিদ্যা রক্ষণাবেক্ষণ আর কাজ চালানোই যথেষ্ট নয়—সার্থক, কার্যকরী ও ফলপ্রদ কার্যবিধি বলবৎ করতে হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কাজে লাগাতে হবে উন্নত তথ্য প্রযুক্তির প্রয়োগ, পরিচালনগত কৌশল পরিবর্তন, অংশগ্রহণমূলক পরিচালনার মত ক্ষেত্রগুলিতে।
এখন শিক্ষা পরিচালন যদি একটি সম্মত নীতিসমূহ সম্পন্ন করার প্রয়োজনে নির্বাহী কাজ হয়, তবে লিডারশিপ হল অন্যের কার্যপ্রণালী একটি প্রত্যাশিত পথে প্রভাবিত করার ক্ষমতা যেখানে একজন লিডার অন্যের লক্ষ্য, মোটিভেশন আর কর্মপদ্ধতিকে নির্দিষ্ট আকারে গড়ে নেন। তাই স্বভাবতই কার্যকরী পরিচালন ব্যবস্থাপনার সঙ্গে মানানসই লিডারশিপ মডেলও অনুসরণ আর চর্চার মধ্যে আনতে হবে।
এর মধ্যে এখন বিশ্বব্যাপী আলোচিত ও চর্চিত বিদ্যালয়ের পরিচালনার কলেজিয়াল (Collegial) মডেল—যেটি আলোচনা, স্বীকৃতি, ঐক্যমত ও ক্ষমতার বন্টনের মাধ্যমে চলে। আর এই মডেলের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ লিডারশিপ হল রূপান্তরমূলক (transformational) লিডারশিপ। এই লিডারশিপ এমনই কার্যকরী যেখানে লিডার (বিদ্যালয় প্রধান) আর অনুসরণকারীদের (সহকর্মীবৃন্দ) উদ্দেশ্য একটি বিন্দুতে মিলিত হয়। তাই তখন যে-কোনো কাজ সহকর্মীরা আর বিদ্যালয়ের প্রধানের কাজ ভাববেন না—তাঁদের সকলের কাজ ভাববেন। আবার এটি অন্যভাবে প্রচলিত লিডারশিপ স্টাইল Direct, Coach, Support আর Delegate-এর মধ্যে চতুর্থটির সাথে সঙ্গতিসম্পন্ন।
শত চাপ ও কাজের বোঝার মধ্যেও বিদ্যালয় প্রধানকে কাজের মধ্যে আনন্দের সন্ধান করতে হবে আর সহকর্মীদের মধ্যে সেই আনন্দ বিতরণও করতে হবে। যাতে সবার কাছে বিদ্যালয় দ্বিতীয় গৃহ হয়ে (Second Home) হয়ে উঠতে পারে। অর্থাৎ কাজগুচ্ছকে ‘কঠিন’ বরং সহকর্মীগণ যাতে আরও ‘বুদ্ধিদীপ্ত’ (Smarter) ভাবে সম্পন্ন করতে পারেন। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় শ্রেণিকক্ষগুলি ‘Visit’ করার মানসিকতা বদল করে ‘Assist’ করার মনোভাব নিয়ে যাওয়া অথবা এক শিক্ষককে অপর শিক্ষকের ক্লাস দেখতে যাওয়ার ক্ষেত্রে উৎসাহিত করা ইত্যাদি।
একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সমগ্র কর্মীবাহিনীর মধ্যে সকলের মধ্যে একটি মডেল ইচ্ছাশক্তি, দক্ষতা ও কর্মপ্রেরণা আশা করা বৃথা। কার মধ্যে কোন কাজ করার প্রবণতা ও ইচ্ছাশক্তি লুকিয়ে আছে সেটি খুঁজে বার করতে হবে। এরজন্য পূর্বে থেকে মনে গেঁথে রাখা ধারণা ও সমাধানের পথ এড়িয়ে কাজে নামতে হবে।
প্রথম ধাপে নিজের প্রতিষ্ঠান ও কর্মীবাহিনীর একটি সার্ভে করা দরকার। প্রতিষ্ঠানটিব চারটি মূল বিষয় খুঁজে বার করতে হবে—এদের SWOT আখ্যা দেওয়া যায়। এখানে ‘S’ হল প্রতিষ্ঠানটির Strength বা শক্তি। ‘W’ হল Wealmess বা দুর্বলতা। ‘O’ হচ্ছে Opportunity বা সুযোগ আর ‘T’ হচ্ছে Threat বা মূর্তিমান বিপদ। এগুলি ব্যক্তি, বস্তু বা বিষয়কেন্দ্রিক হতে পারে।
এরপর বিদ্যালয়ের কর্মীবাহিনীদের দক্ষতা ও প্রবণতাভিত্তিক শ্রেণিবিভাগ করে নিতে হবে। এর উপযোগিতা অনেকটা লেখচিত্র বা Graph Paper-এর কার্যকারিতার সঙ্গে অনেকটা মিল আছে। Graph-এর প্রথম quadrant (++)-এ ফেলবেন তাঁদের যাঁরা দক্ষ ও একই সাথে ইচ্ছুক। দ্বিতীয় quadrant (+ –)-এ পড়বেন দক্ষ কিন্তূ অনিচ্ছুক ব্যক্তিগণ। তৃতীয় quadrant (~+) এবং চতুর্থ quadrant (~~) যথাক্রমে তুলনামূলক অদক্ষ কিন্তু ইচ্ছুক আর অদক্ষ ও অনিচ্ছুক সহকর্মীদের জন্য।
এই সমীক্ষার পর সমীক্ষার ফল ব্যাখ্যা করতে হবে এবং সংক্ষিপ্তসারে আনতে হবে। এবার সমীক্ষা অনুযায়ী দায়িত্ব বন্টনের পালা। বর্তমানে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প রূপায়ণের ক্ষেত্রে নোডাল ব্যক্তি-র ভূমিকা তো কার্যকর আছেই। এছাড়া বিভিন্ন কাজের জন্য এক একটি গ্রুপভিত্তিক বিভাজন করতে পারা যায়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রশাসনিক কার্যে অংশগ্রহণ করানো যেতে পারে। যাঁরা অংশগ্রহণে অনাগ্রহী তাঁদের বিভিন্ন উপসমিতি গড়ে সেগুলির মূল দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। যেমন বিদ্যালয়ের চাহিদা অনুযায়ী স্টাফ কাউন্সিলের অধীনে বিভিন্ন উপসমিতি গড়া যেতে পারে—ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক, কর্মসূচি রূপায়ণ, ছাত্রকল্যাণ, পেশাগত নথি এবং সংরক্ষণ, বিদ্যালয় গৃহ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, ভ্রমণ, পত্রিকা ইত্যাদি। বিদ্যালয়ের প্রধানকে নির্দিষ্ট সময় অন্তর দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাজের মূল্যায়নের জন্য ব্যক্তিগত সমীক্ষা চালাতে হবে। নিজস্ব নোটস রাখতে হবে। সহকর্মীদের যে বিদ্যালয় প্রধান একান্তভাবে বিদ্যালয়ের নীতি-নির্ধারণের কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করাতে চাইছেন, সেটি তাঁদের আত্মস্থ করাতে হবে। এবার এরই মধ্যে বিদ্যা প্রধানকেও নিজের মধ্যে কিছু গতানুগতিকতা পরিহার করতে হবে—যেমন, নিজের ভাবনাচিন্তা সহকর্মীদের সাথে ভাগ করা তাঁদের পরিকল্পনার অংশীদার করে নেওয়া, তাঁদের মধ্যে ভালো কিছু লক্ষ্য করলে প্রকাশ্যে অনুমোদন করা, তাঁদের সঙ্গে যৌথভাবে পরিকল্পনার নেতৃত্বদানে সময় বের করা, প্রয়োজনে কোনো কাজে নিজের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে সাহায্যের জন্য ডেকে নেওয়া, আবার কখনও তাঁদের রক্ষাকর্তার ভূমিকা নেওয়া, সমস্যার সমাধানে অগ্রাধিকার চিহ্নিতকরণে তাঁদের ভূমিকা সুনিশ্চিত করা, তাঁদের উপর উচ্চপ্রত্যাশা রেখে নিরন্তর উৎসাহ প্রদান করা ইত্যাদি। এর ফলে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষামূলক চাহিদা আর সহকর্মীদের উন্নয়নমূলক চাহিদাগুলির গতিপ্রকৃতি সন্ধান করা সহজতর হবে।
আর যে পরিবর্তন বিদ্যালয় প্রধানদের অনুশীলন করতে হবে তা হল, গ্রহণক্ষম (Receptive) ব্যক্তিত্ব তৈরি করা, শোনার ধৈর্য্য বৃদ্ধি করা, সহকর্মীদের সাথে আলোচনা বৃদ্ধি করা, তাঁদের প্রশ্ন আহ্বান করা ও পরীক্ষানিরীক্ষায় উৎসাহ দেওয়া ইত্যাদি।
তবে এত কিছুর মধ্যেও বিদ্যালয় প্রধানকে তাঁর প্রয়োজনভিত্তিক আমলাতান্ত্রিক ও কূটনৈতিক প্রশাসনের মিশেল প্রয়োগের বিষয়টি ভুললে চলবে না।
আশা করা যায়, ট্রান্সফরমেশনাল লিডারশিপের উপরের প্রায়োগিক বিষয়গুলি ধারাবাহিক চর্চা পঠন পাঠন পদ্ধতিতে সহায়ক পরিবর্তনসহ সামগ্রিকভাবে বিদ্যার কর্মদক্ষতায় সুস্থায়ী উন্নয়নের পথ দেখাতে সক্ষম হবে। আর এতে বিদ্যালয় প্রধানগণ চাপমুক্ত হতে সক্ষম হবেন।
Advertisement



