• facebook
  • twitter
Sunday, 27 July, 2025

প্রাথমিক শিক্ষক থেকে ডাব্লুবিসিএসে দ্বিতীয় প্রিয়তোষ

এবারের ডাব্লুবিসিএসের দ্বিতীয় স্থানাধিকারী, প্রিয়তোষ পিপলাই সঙ্গে কথা বললেন অভিজ্ঞ পেশা-পরামর্শক এবং ভারতীয় নিরীক্ষা ও হিসাব দপ্তরের আধিকারিক অনিন্দ্য কিশোর।

স্বভাবে অত্যন্ত নম্র ও ভদ্র, এবং আন্তরিকতায় সম্পৃক্ত, প্রিয়তোষ পিপলাইয়ের সঙ্গে আলাপচারিতা সবেমাত্র শুরু করেছি। প্রথমেই, সে চমকে দিল একটা রোমাঞ্চকর তথ্য দিয়ে।

একবিংশ শতাব্দী থেকে হঠাৎই পঞ্চদশ শতাব্দীতে ফিরে তাকাতে হল। প্রিয়তোষ জানাল, মনসামঙ্গল কাব্যের আদিকবি কানাহরি দত্ত হলেও, এই কাব্যগ্রন্থের অন্যতম রচয়িতা ছিলেন কবি ‘বিপ্রদাস পিপলাই’। সে মনে করে, “বিপ্রদাস পিপলাইয়েরই হয়তো তাঁরা বংশধর”!

টিম শিক্ষার-অঙ্গন থেকে তোমাকে জানাই অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। এমন নজরকারা সাফল্যে, তোমার প্রাথমিক অনুভূতি?

টিম শিক্ষার-অঙ্গনকেও জানাই আমার আন্তরিক ধন্যবাদ। সত্যি বলতে কী, এতটা আশা করিনি। অত্যন্ত আনন্দিত। ভগবানের আশীর্বাদ এবং সমস্ত গুরুজন, বিশেষ করে মায়ের জন্যই সম্ভব হয়েছে আমার আজকের এই সাফল্য। মা-ই হলেন আমার সাফল্যের প্রেরণা। তাঁর আত্মত্যাগের নমুনা, বলে শেষ করা যাবে না।

তুমি প্রস্তুতি শুরু করেছিলে কবে থেকে?

প্রস্তুতি শুরু করেছিলাম ২০২০ সালের লকডাউনের সময় থেকে। লকডাউন নিশ্চিত ভাবে, সারা দেশ ও আমাদের রাজ্যের মানুষের কাছে অভিশাপ হিসেবে নেমে এসেছিল। কিন্তু, আমার ক্ষেত্রে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিল। ওই সময়ে একটি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করতাম। অনেক আগেই ভেবে রেখেছিলাম ডাব্লুবিসিএস পরীক্ষায় বসব। লকডাউনে সারাদিন বাড়ি থাকাটা — এই পরীক্ষা-প্রস্তুতির সুবর্ণ-সুযোগ এনে দিল আমার কাছে। প্রায় সাড়ে চার বছরের ধারাবাহিক প্রচেষ্টার পর, এই সাফল্য অর্জন করেছি। রাজ্যে সার্বিকভাবে দ্বিতীয় হলেও, এক্সিকিউটিভ ক্যাডারে প্রথম হয়েছি।

তোমার পড়াশোনা ও পরিবার নিয়ে যদি কিছু বলো—

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাস করি সরিষার রামকৃষ্ণ মিশন শিক্ষামন্দির থেকে। উভয় পরীক্ষাতেই নম্বর ৮০ শতাংশের উপরে ছিল। খুব ছোট পরিবার আমাদের। মা ও দিদার সঙ্গে, বর্তমানে ডায়মন্ড হারবার পুরসভা অঞ্চলে থাকি। যদিও আমার ছোটবেলা কেটেছে নদিয়ার ধুবুলিয়াতে। আপনার নিশ্চয়ই মনে থাকবে ২০০০ সালে এক ভয়ঙ্কর বন্যা হয়েছিল বাংলায়। তখন বয়স সবে মাত্র পাঁচ। সেই বন্যাতে নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে বাবা মারা যান। আর্থিক অবস্থা মোটেই ভাল ছিল না আমাদের। তখন, সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন আমার মা। উনি সব থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন আমার পড়াশোনাতে। খাওয়া-দাওয়া বা জামাকাপড় যাই হোক না কেন; যৎসামান্য উপার্জিত অর্থ থেকেও প্রায় পুরোটাই তিনি খরচ করতেন আমার পড়াশোনাতে।

এটাই কি তোমার প্রথম চাকরি?

এর আগে প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকতা করতাম। ২০১৪ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করি। ২০১৫ সালের টেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রাথমিক শিক্ষক পদে কাজে যোগ দিই। তখন থেকেই রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পরীক্ষা — ডাব্লুবিসিএস সফল হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। তবে, প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়াটাই জীবনে সবথেকে বড় সাফল্য ছিল সেই সময়। ওই নিয়োগ প্রাপ্তির ফলেই, আমাদের আর্থিক অবস্থা খানিকটা ভাল হয়। পরবর্তী পড়াশোনা চালিয়ে নিয়ে যেতে সুবিধা হয়েছিল খুব । এরই ফাঁকে, গণিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর হয়ে যাই নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এরপর ২০২১ সালে ডব্লিউবিসিএস পরীক্ষায় প্রথমবার বসি। সেই বার অবশ্য ‘এ’ বা ‘বি’ কোনও গ্রুপেই নির্বাচিত হইনি। পেয়েছিলাম গ্রুপ সি-র ‘অ্যাসিস্ট্যান্ট কমার্শিয়াল ট্যাক্স অফিসার’ হিসেবে নিয়োগপত্র। বর্তমানে সেই পদেই বেলেঘাটায় কর্মরত।

তোমার এই দৃষ্টান্তকারী সাফল্যের পিছনে মোটিভেশন কী ছিল?

মোটিভেশনের ক্ষেত্রে সব সময় আমার মায়ের ভূমিকাই ছিল সবচেয়ে বড় । সঙ্গে, আরও একটা কথা বলতে চাই। আমাদের রামকৃষ্ণ মিশনের মূলমন্ত্র হল, “আত্মনো মক্ষর্থম, জগৎ হিতায় চ”। অর্থাৎ, নিজের মুক্তির জন্য এবং জগতের কল্যাণের জন্য। তাই সব থেকে বেশি মানুষের সেবা, যে-কাজে করা যায়; তেমনই একটা কর্মক্ষেত্র খুঁজে নিতে চেয়েছিলাম। সেই সুযোগ আমাকে দিতে পারে — সিভিল সার্ভিস। এমনটাই মনে হয়েছিল আমার। তাই ডাব্লুবিসিএস পরীক্ষাকেই পাখির চোখ করেছিলাম। এটি এমন একটি সার্ভিস, যেখানে বহু সাধারণ মানুষের জীবনে ইমপ্যাক্ট ফেলার সুযোগ রয়েছে।

শেষ ধাপ, ইন্টারভিউয়ের জন্য কি আলাদা কোনও প্রস্তুতি নিয়ে ছিলে?

ইন্টারভিউয়ে বসাটা অত্যন্ত সিরিয়াস ভাবে নিয়ে ছিলাম। তার জন্য আলাদা প্রস্তুতিও শুরু করি। ইন্টারভিউয়ের প্রস্তুতি বেশ একটু ট্রিকি। সাধারণ জ্ঞান বা নিজের বিষয়, সেগুলিও পড়া যেমন জরুরি; ঠিক তেমনই আরও বিশেষ কিছু জ্ঞান প্রয়োজন ইন্টারভিউ ক্র্যাক করতে হলে। যেমন যে পরীক্ষার্থী যে জেলায় থাকেন, সেই জেলা বা তার অন্তর্গত সাব-ডিভিশন বা ব্লকের ভৌগোলিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক তথ্যগুলি জানা অত্যন্ত জরুরি। যেমন জেলা বা ব্লকের জনসংখ্যা, তফসিলি জাতি বা জনজাতিদের জনসংখ্যার শতাংশ, লিঙ্গ-অনুপাত, শিশুমৃত্যুর হার, ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত জ্ঞান বা তথ্য পরীক্ষার্থীদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে এবার।

এমনকি নিজের-নিজের শহর, গ্রাম কিংবা পুরসভা থেকেও প্রশ্ন করেছেন তাঁরা। ইন্টারভিউ বোর্ডের সদস্যরা দেখতে চান, তুমি যে অঞ্চলে থাকো; সেই অঞ্চল সম্পর্কে কতটা পরিচিত। তবেই তো তুমি যেখানে নিয়োজিত হবে, সেই অঞ্চল সম্পর্কে প্রশাসনিক কাজ দায়িত্বের সঙ্গে পরিচালনা এবং সম্পাদন করতে পারবে। এমনকি নিজের জেলার নদনদী, ভূপ্রকৃতি বা কোনও বিশেষ ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য থেকেও প্রশ্ন এসেছে এবার। যদি সেই জেলায় কোনও বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব থাকেন (ঐতিহাসিকভাবে বা বর্তমান সময়ের) তাঁদের সম্পর্কেও জেনে যাওয়া জরুরি।

ইন্টারভিউয়ের প্রস্তুতি ঠিক কোন সময় থেকে নেওয়া উচিত?

মনে করি, ডাব্লুবিসিএসের মতন পরীক্ষায় ইন্টারভিউইয়ের প্রস্তুতি প্রথম থেকেই নেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে নিজের বেশ কিছু গুণ বা যোগ্যতা, প্রথম থেকে অর্জন করে নিতে পারলে ভাল। যেমন, সাবলীল ভাবে কথা বলা; যুক্তিসহকারে নিজের বক্তব্যকে তুলে ধরা; কথা ও তথ্যের মধ্যে স্বচ্ছতা-রাখা, ইত্যাদি। যাঁরা ইন্টারভিউ নেন, তাঁরা তোমার কাছে এই গুণগুলি যাচাই করবেন। প্রস্তুতি অনেকটা দীর্ঘমেয়াদী হলে, ইন্টারভিউয়ে সফল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক গুণ বেড়ে যায়। মনে করি, ইন্টারভিউয়ের জন্য যে কোনও প্রার্থীর কমিউনিকেশন স্কিল, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, আদর্শ-ব্যক্তিত্বের প্রকাশ, অনুশীলনের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠতর উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যায়। তাই ইন্টারভিউয়ের অনুশীলন, প্রিলি ও মেনস্‌ পরীক্ষার পাশাপাশি নিয়ে ছিলাম।

তুমি কী ভাবে প্রস্তুত করে ছিলে নিজেকে?

যাঁরা এই সার্ভিসে অলরেডি আছেন, তাঁদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতাম। তাঁদের পরামর্শ নিতাম। কলকাতার দুই-একটি প্রতিষ্ঠানে ‘মক-ইন্টারভিউ’ও দিয়েছি। বলতে দ্বিধা নেই, এই ধরনের মক-ইন্টারভিউ অনেকটাই সাহায্য করেছে আমাকে।

প্রথমবারে সফলতা আসেনি। দ্বিতীয়বারে সাফল্য — সর্বোচ্চ। প্রথমবার সফল না হওয়ার পিছনে, কী কারণ থাকতে পারে ?

গ্রুপ এ বা গ্রুপ বি-তে সফল হতে গেলে ঐচ্ছিক বা অপশনাল সাবজেক্টকেও মন দিয়ে পড়তে হবে। প্রথমবার এই অপশনালকে বেশি গুরুত্ব দিইনি। তাই, অপশনালে ভাল স্কোর হয়নি আমার। যে সমস্ত পরীক্ষার্থী, গ্রুপ এ ও গ্রুপ বি-কে পাখির চোখ করেছো, তাদের প্রতি আমার পরামর্শ। অপশনাল বা ঐচ্ছিক বিষয়কে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে পড়াশোনা কোরো।

দ্বিতীয়বারে প্রস্তুতিতে, অপশনালকে কী ভাবে আয়ত্তে আনলে?

সাধারণভাবে পরীক্ষার্থীরা অপশনাল বা ঐচ্ছিক বিষয়ে একটা বড় ভুল করে থাকে। অধিকাংশ পরীক্ষার্থী মনে করে, অপশনালে একটি নোট বা বই পড়ে লিখে দিতে পারলেই হল। এই কৌশল কাজে আসতে পারে, অতি সামান্য কিছু প্রশ্নে। প্রশ্নকর্তারা এমন প্রশ্ন করেন, যেখানে তোমার উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে নিজস্বতা থাকবে। তোমার উত্তরের মধ্যে উদ্ভাবনমূলক উপস্থাপনা থাকবে। কোনও একটি জটিল বক্তব্যকে ডায়াগ্রাম, চার্ট, টেবিল বা ছবির মাধ্যমে সংক্ষেপে বোঝানোর ক্ষমতা আয়ত্ত করতে হয় অপশনাল বিষয়ের জন্য।

প্রিলি ও মেনস্‌-এর পরীক্ষার প্রস্তুতি কী ভাবে নিয়েছিলে এবং কোন পরীক্ষার জন্য কতটা সময় বা গুরুত্ব দিয়ে ছিলে?

এ ক্ষেত্রে, আমার সিনিয়রদের দেওয়া পরামর্শ অনুযায়ী প্রস্তুতি নিয়ে ছিলাম। প্রিলি ও মেনস্‌ প্রস্তুতি একই সঙ্গে শুরু করি। বরং মেনসের প্রস্তুতিকেই প্রধান করে, পড়াশোনা চালিয়ে যাই। তাতে প্রিলির প্রস্তুতিও হয়ে গিয়েছিল একই সঙ্গে। তবে প্রিলির ক্ষেত্রে একটা বিষয়, বিশেষ করে উল্লেখ করব। পূর্ববর্তী বছরগুলির আসা প্রশ্নপত্রকে ভাল করে অধ্যয়ন করতে হবে। প্রশ্নগুলিকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে, কেমন মানের এবং কেমন ধরনের প্রশ্ন এসেছিল। বিগত কুড়ি বছরের ডাব্লুবিসিএস প্রিলির প্রশ্নপত্র পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে চর্চা করেছিলাম। প্রিলির প্রস্তুতিতে একটা কথা বেশ জনপ্রিয় — “ইতিহাস যার, প্রিলি তার”। ইতিহাস থেকে প্রায় ৫০টি প্রশ্ন আসে। তাই আগামী দিনের পরীক্ষার্থীদের কাছে আমার পরামর্শ, প্রিলির প্রস্তুতিতে সর্বাধিক গুরুত্ব ইতিহাসকেই দিও। অংক এবং ইংরেজিকেও গুরুত্ব দিতে ভুলো না। এই বিষয়গুলিও তোমাকে প্রিলিতে নম্বর পেতে সাহায্য করবে।

মেনস্‌-পরীক্ষার প্রস্তুতির ক্ষেত্রে রয়েছে, মোট ১৬০০ নম্বর। কম্পালসারি বাংলা ইংরেজিতে ২০০ করে রয়েছে ৪০০ নম্বর। চারটি জেনারেল স্টাডিজে রয়েছে মোট ৮০০ নম্বর। বাংলা এবং ইংরেজি বিষয়গুলির জন্য প্রতিদিন সংবাদপত্র পড়াকে নিজের অভ্যাসের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে সম্পাদকীয় পাতাটি মনোযোগ সহকারে পড়েছিলাম আমি। আমার মনে হয়, সম্পাদকীয়-পাতা বিশ্লেষণ করে পড়লে, শুধু ভাষাগত জ্ঞান নয়; চারপাশে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক বিষয়গুলি সম্পর্কেও উপযুক্ত জ্ঞান অর্জন করা যায়। ডাব্লুবিসিএস পরীক্ষায় লেখার ক্ষেত্রে ভারসাম্য রাখা অত্যন্ত জরুরি। বক্তব্যে ভারসাম্য কিংবা সামাজিক গুরুত্ব থাকবে, এমন মতামতই লেখা উচিত উত্তরপত্রে।

যারা এবার সফল হতে পারল না তাদের জন্য তোমার মেসেজ—

একটা কথাই বলব, নিজের উপর বিশ্বাস যেন হারিয়ে না যায়। নিজেই তো প্রথম বছর ডাব্লুবিসিএসের এ ও বি গ্রুপ ক্লিয়ার করতে পারিনি। কিন্তু, নিজে হাল ছাড়েনি। শেষ সুযোগ অব্দি নিজের একশো শতাংশ দেওয়ার মানসিকতা রাখতে হবে। তা হলে, সাফল্য আসবেই।

সবার শেষে, তোমাকে আবার শুভেচ্ছা জানাই

হ্যাঁ, আমিও শুভেচ্ছা জানাই আপনাকে এবং দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকার সংশ্লিষ্ট সকলকে।