নিশীথ সিংহ রায়
আজকে আমরা যে কলেজটিকে পাঠককুলকে পরিচিত করাবো তার বর্তমান অধ্যক্ষ ডঃ কনা মণি মুখার্জী কলেজটি সম্বন্ধে যা বলেছেন তা তুলে ধরে তারপর আমরা কলেজের ইতিবৃত্ত বলব। তাঁর কথা ‘কলেজটি কলকাতা শহরের শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র ‘শিক্ষার অঙ্গনে’ অবস্থিত। এই শিক্ষা কেন্দ্রটি খুব অল্প সময়ের মধ্যে শিক্ষার অঙ্গনে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচ্য হয়ে উঠেছে। এটির একটি আধুনিক এবং সময়োপযোগী শিক্ষাকেন্দ্র হয়ে ওঠার সদিচ্ছা এবং আগ্রহ আছে যা একজন শিক্ষার্থীকে সহযোগিতামূলক শিক্ষার সকল দিকের পূর্ণ সুবিধা গ্রহণ করতে সক্ষম করে। যার মধ্যে রয়েছে সৃজনশীল চিন্তাভাবনা, দক্ষতা এবং সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছতে সাহায্য করে। কলেজটি শিক্ষাগত জ্ঞান এবং দক্ষতা ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি শিক্ষাবিদ এবং সমাজের মধ্যে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে সমাজের একটি শক্ত ভিত্তি স্থাপন করে’। যে কলেজটির অধ্যক্ষ কলেজ সম্বন্ধে এরকম ইতিবাচক কথা বলতে পারেন সেটি পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতার শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র কলেজ স্ট্রিটে অবস্থিত। কলেজ স্কোয়ারের দক্ষিণে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত। যা কলেজটি থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে অবস্থিত। আর কলেজ স্কোয়ারের আর একদিকে অর্থাৎ পশ্চিম দিকে অবস্থিত বিশ্ব খ্যাত হিন্দু স্কুল ও সংস্কৃত কলেজ। আর সেই কলেজ স্কোয়ারেরই পর্ব দিকে অবস্থিত ‘চিত্তরঞ্জন কলেজ’। যা বয়সে নবীন হলেও গরীমায় কারুর থেকে কম যায় না। ১৯৬৭ সালের ২৩শে আগষ্ট ৮এ বেনিয়াটোলা লেনে ব্রাম্ভ সমাজের অধীনে গড়ে ওঠে ‘চিত্তরঞ্জন কলেজ’। চিত্তরঞ্জন কলেজ স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে গঠিত। কলেজের লক্ষ্য এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রদান করা যার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী বিবেকবান, মানসিক ও শারীরিক ভাবে সক্ষম এবং নিজের ক্ষমতায় নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। সেক্ষেত্রে কলেজ শিক্ষাদান ছাড়াও নৈতিকতা, সমাজের সর্বশ্রেণীর অর্থাৎ লিঙ্গ, বর্ণ, ধর্ম ভেদে মানুষের সেবা করা বা সমচোখে দেখা এগুলির ক্ষেত্রে জোর দেয়।
চিত্তরঞ্জন কলেজে স্নাতক স্তরে অনেকগুলি বিষয় পড়ানো হয়। এখানে চার বছরের কলা ও বানিজ্য বিভাগে অনার্স পড়ানো হয়। যেখানে পড়ানো হয় বাংলা, ইংরেজি, এডুকেশন, হিন্দী, রাষ্ট্র বিজ্ঞান দর্শন ও বানিজ্য। এছাড়াও এই বিষয়গুলিতে তিন বছরের মাল্টিমিডিয়া কোর্স করানো হয়। চিত্তরঞ্জন কলেজের খ্যাতি কমার্স বা বানিজ্য বিভাগের জন্য। যাঁরা বানিজ্য বিভাগে পড়তে আগ্রহী তাঁদের প্রথম পছন্দ যে কটি কলেজের প্রতি থাকে তার মধ্যে অন্যতম এই কলেজটি। এই কলেজের বানিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা বিশ্ব ব্যাপী সমাদৃত হন। বর্তমানে কলেজে পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী আছে।
এই কলেজটি যা এখনও শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণে উৎকর্ষের প্রতিশ্রুতি দিয়ে গঠিত এবং এর গৌরবময় শিক্ষার ঐতিহ্য পালন করে আসছে। কলেজটিকে মূল যে আদর্শ সামনে রেখে গঠন করা হয়েছে তা হলো জ্ঞান কেবল একটি তথ্য নয়, এটি এক ধরনের প্রজ্ঞা। যা একটি আলোয়ার। ছাত্রছাত্রীদের মনকে আলোকিত করে এবং জ্ঞানের নতুন দিগন্ত অন্বেষণে উদ্বুদ্ধ করে। এই ডিজিটাল যুগে ছাত্রছাত্রীদের সামগ্রিক জ্ঞান, নৈতিক অভ্যাস ও মূল্যবোধে দীক্ষিত করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যাতে তারা পরিপক্ব চিন্তাশক্তির অধিকারী হয়। সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ববোধ, প্রকৃতির প্রতি সহানুভূতি, ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি গর্ব এবং নিজেদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলার উপর জোর দেয় চিত্তরঞ্জন কলেজ। যাতে তারা ভালো মানুষ ও দেশের গর্বিত নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। এই কলেজে অভিজ্ঞ এবং কলেজ সার্ভিস কমিশনের গাইড মেনে যাঁরা শিক্ষকতা করছেন তাঁরা শিক্ষার্থীদের শুধুমাত্র লেখাপড়া করিয়া ক্ষান্ত হন না। তাঁরা যাতে সমাজে মানুষের মত মানুষ হিসেবে দাঁড়াতে পারেন সে ব্যাপারে সর্বদা সচেষ্ট। এ কলেজে গ্রন্থাগারিক, অশিক্ষক কর্মচারী ও ছাত্রছাত্রীদের এক বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ আছে। বছরের বিভিন্ন সময়ে শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের মেন্টরিং করার চেষ্টা করেন। পাশাপাশি, বিভিন্ন বিভাগ তাদের নিজস্ব উদ্যোগে বিশেষ বক্তৃতা ও কর্মশালা, সেমিনার, ওয়েবিনার এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকেন। বিশ্ব যখন ধীরে ধীরে কোভিড-১৯ মহামারির ক্ষত থেকে সেরে উঠেছে, তখন এই কলেজ শিক্ষা ও শিক্ষণকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সম্প্রসারিত করেছে। গত দুইটি শিক্ষাবর্ষে চিত্তরঞ্জন কলেজ সফলভাবে শ্রেণিকক্ষ ভিত্তিক শিক্ষার পাশাপাশি ডিজিটাল শিক্ষাপদ্ধতিকে সংযুক্ত করেছে। অনলাইনে শিক্ষাদানের সাথে অফলাইন শ্রেণিকক্ষের সমন্বয় ঘটিয়েছে এবং প্রায় সমস্ত প্রশাসনিক কাজ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। শ্রেণিকক্ষে পাঠদান, ধারাবাহিক মূল্যায়ন, প্রকল্প ও সেমিস্টার পরীক্ষা সম্পর্কিত তথ্য নিয়মিতভাবে কলেজের ওয়েবসাইটে লোড করা হয়। প্রতিটি ব্যাচের জন্য প্রতিটি বিভাগ একটি নির্দিষ্ট ইলেকট্রনিক প্ল্যাটফর্ম বজায় রাখে, যাতে কোনো ছাত্রছাত্রী প্রয়োজনীয় তথ্য থেকে বঞ্চিত না হয়। কলেজের উন্নতির ব্যাপারে গ্রন্থাগারিক দীপজ্যোতি করের অবদান অনস্বীকার্য। কলেজের আপগ্রেডের সাথে সাথে গ্রন্থাগারটিকে তিনি শুধু আপগ্রেডই করাননি ২৬২৯০ বই, বিভিন্ন রেফারেন্স ও গাইড বইয়ের সম্ভারে এটিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ব্যতিক্রমী গ্রন্থাগার হিসেবেও পরিগণিত করেছেন যা ন্যাকের উচ্চ মূল্যায়ন পেতে সাহায্য করেছে।
গুণগত শিক্ষার পাশাপাশি, কলেজ বিভিন্ন কো-কারিকুলার কার্যকলাপ আয়োজন করে, যা বিভিন্ন সেল ও কাউন্সিলের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। যাতে সৃজনশীল ও সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার বিকাশ ঘটে। সকল ছাত্রছাত্রীকে উৎসাহিত করা হয় যেন তারা পড়াশোনার পাশাপাশি এইসব কার্যকলাপেও অংশগ্রহণ করে। মন ও দেহের সামগ্রিক বিকাশই সুস্থ বিকাশের লক্ষণ। ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, আবেগজনিত ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে মনোযোগ দিয়ে লালন করা হয়। কলেজ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে উপকৃত হবে, শ্রেণিকক্ষ ভিত্তিক শিক্ষার পাশাপাশি নতুন ডিজিটাল প্রযুক্তি থেকেও শিক্ষা অর্জন করবে এবং কলেজের গৌরবময় অতীত থেকে প্রেরণা গ্রহণ করে দায়িত্বশীল নাগরিক ও ভবিষ্যতের একাডেমিক হিসেবে গড়ে উঠবে। কলেজের এতকিছুর ভালর মধ্যেও কিছু অসুবিধা কলেজ তার জন্মলগ্ন থেকেই বয়ে চলেছে। যেমন যথেষ্ট শ্রেণিকক্ষ, ব্যায়ামাগার এবং আউটডোর অথবা ইনডোর কোন খেলারই উপযুক্ত জায়গা নেই। যদিও এই সমস্যাগুলো মাথায় নিয়েই কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কারণ এই কলেজটি যেখানে প্রতিষ্ঠিত সেটি কলকাতার বহু পুরানো জায়গা আর তার প্রসারিত হওয়ার কোনো সুমোগ নেই। তাই মধ্য কলকাতার প্রাণকেন্দ্র এই অঞ্চলে এসমস্ত সুবিধা দেওয়া সত্যিই অকল্পনীয় ব্যাপার। যাইহোক যা নেই তা নিয়ে আক্ষেপ না করে কলেজ তার মূল লক্ষ্য অর্থাৎ কলেজের প্রতিটি শিক্ষার্থী যাতে জীবনে আরও সাফল্য অর্জন করে এবং কলেজের সাথে সাথে নিজেকেও এক উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে তার জন্য সর্বদাই কাজ করে যাচ্ছে।