• facebook
  • twitter
Wednesday, 9 July, 2025

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় – আধুনিক যুগের ‘নালন্দা’

১৯৫৭ সালে পুরাতন সেনেট ভবন ভেঙে ফেলার পরের বছর ১৯৫৮ সালে ব্যারাকপুর ট্যাঙ্ক রোডে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের জন্য ভবন নির্মিত হয়।

ফাইল চিত্র

নিশীথ সিংহ রায়

নালন্দা, তক্ষশীলা, বিক্রমশীলা, ওদন্তপুরী, ভালভী প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয় তখন স্মৃতির অতলে। কালের নিয়মে তাদের উজ্জ্বল, গৌরবময় অধ্যায় তখন বিলোপ। তখন মধ্যযুগ। এ দিকে বিশ্বব্যাপী চলছে এক নৈরাজ্য। ধর্মীয় নৈরাজ্য। বিশেষত ইউরোপে। সেখানে রাজনীতি তখন ধর্মীয় ছত্রতলে। ঠিক সে সময় আর্বিভাব পোল্যান্ডের জ্যোতির্বিজ্ঞানী নিকোলাস কোপার্নিকাসের। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিক তখন। ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে গিয়ে কোপার্নিকাস তাঁর ‘ডি রিভোলিউশনিবাস’ বইয়ে নতুন তথ্য দিলেন যে, ‘সূর্য স্থির। পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে।’ এ ব্যাপারে সমগ্র ক্যাথলিক সমাজ তাঁর বিরুদ্ধে গেলেও তিনি যে জ্ঞানের আলোকশিখা জ্বেলে দিলেন বলা যায়, তাতে শুরু হল আধুনিক যুগ। এরই পরিণামে ইউরোপে বিশেষত যুক্তরাজ্যে এল শিক্ষার ঢেউ। তৈরি হতে লাগল একের পর এক বিশ্বখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে উঠে এল ‘অক্সফোর্ড’, ‘কেমব্রিজ’, ‘কিংস’, ‘ডারহাম’, ‘সেন্ট ডেভিড’, ‘লন্ডন’, ‘কুইন্স’, ‘বেডফোর্ড’, ‘কুইন্স’ (আয়ারল্যান্ড), ‘ক্যাথলিক’ বা ‘ম্যানচেস্টার’ বিশ্ববিদ্যালয়গুলি। এ কারণেই বলা হয়, পৃথিবীর বুকে আধুনিক জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে ইংল্যান্ড বা আয়ারল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালগুলি বিশেষ অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। আমেরিকায় তখন আধুনিক ‘হার্ভার্ড’ বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ববিখ্যাত। এ ছাড়াও ‘জনস হপকিন্স’, ‘ব্র্যাক’, ‘ডনফোর্ড’ প্রভৃতি একের পর বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে।

এ দিকে প্রাচ্যেও বিশেষত ভারতে এল শিক্ষার ঢেউ এবং বলা যায় তা বৃটিশদের জন্যই। একের পর এক বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে লাগল। এ ক্ষেত্রে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম সর্বাগ্রে উঠে আসবে। যে কোনও কারণেই হোক, বৃটিশরা ভারতে আধুনিক এবং ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজন অনুভব করে। শিক্ষা সচিব ফ্রেডরিক জন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ধাঁচে ভারতের কলকাতা, মুম্বাই ও চেন্নাই – এ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির সুপারিশ করে লন্ডনে সরকারের নিকট প্রস্তাব পাঠান। এরই ফলশ্রুতি স্বরূপ ১৮৫৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির প্রস্তাব পাশ হয় যা ‘উডের প্রস্তাবিত’ নামে পরিচিত। তারই পরিণতিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। ভারতে বৃটিশ বিরোধী প্রথম অভ্যুত্থান সিপাহি বিদ্রোহ ১৭৫৭ সালে ঘটেছিল, ঠিক তার একশ বছর পর ১৮৫৭ সালের ২৪শে জানুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। ১৬৭ বছর আগে ২৪শে জানুয়ারি শুরু হয় প্রাচ্য জগতে পাশ্চাত্য জগতের আধুনিক পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার পথচলা। ওই সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও বিশ্বে আরও অনেকগুলি বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছিল। যেমন ‘ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি’, ‘করোনা মহিলা কলেজ’ বা ‘ইলিয়ন স্টেট ইউনিভার্সিটি’ প্রভৃতি। যাইহোক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় একেবারে ইউরোপীয় ধাঁচে তৈরি হয়েছিল।

কালের নিয়মে বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্তিয়ারভুক্ত এলাকা কলকাতা এবং শহরতলির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও প্রতিষ্ঠাকালে এর বিস্তৃতি ছিল পূর্বে রেঙ্গুন থেকে পশ্চিমে লাহোর এবং উত্তরে পুরো ভারতবর্ষ ও দক্ষিণে শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হওয়ার ১২ বছর পর সুয়েজ খাল চালু হয়। আর এই সুয়েজ খালের পূর্ব থেকে জাপান পর্যন্ত এই বিশাল এলাকায় একমাত্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েই ইংরেজি সাহিত্য বা প্রাচ্যের দর্শনের সঙ্গে পাশ্চাত্যের দর্শন শাস্ত্রও পড়ানো হত। যেটা ছিল খুবই গর্বের বিষয়। বর্তমানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন ১৫১টি স্নাতক শ্রেণীর কলেজ ও ১৬টি বিভিন্ন প্রকারের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ‘অ্যাডভান্সমেন্ট অফ লার্নিং’ এই নীতিবাক্যের ভিত্তিতেই বিশ্ববিদ্যালয়টি গড়ে ওঠে। এরই থেকে বোঝা যায়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল আধুনিক শিক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম আচার্য ও উপাচার্য ছিলেন যথাক্রমে তৎকালীন ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং ও সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার উইলিয়াম কোলভিল। বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করতে জায়গা এবং বিল্ডিং তো প্রয়োজন – তা আসবে কোত্থেকে? ভাল কাজকে কোনও প্রতিবন্ধকতাই কোনও দিন আটকাতে পারেনি। তাই এ সম্যসারও সুরাহা হল। জায়গা দান করলেন দ্বারভাঙার মহারাজ মহেশ্বর সিং বাহাদুর। তিনি বর্তমান কলেজ স্ট্রিটে অবস্থিত কলেজ স্কোয়ারের ঠিক উল্টো দিকে জমি দান করলেন।

আর বৃটিশ সরকার ১৮৬৬ সালে বিল্ডিং তৈরির জন্য ১,৭০,৫৬১ টাকা বরাদ্দ করে। ১৮৭৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নতুন ভবন তৈরি হয় যার নামকরণ হয় ‘সেনেট ভবন’। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৫৫ বছর পর অর্থাৎ ১৯১২ সালে সেই দ্বারভাঙার মহারাজ মহেশ্বর সিং বাহাদুরেরই দান করা ২,৫০,০০০ টাকায় বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তৈরি হয় ‘দ্বারভাঙা’ ভবন। ওই বছরই বৃটিশ সরকার সেনেট ভবনের ঠিক পাশেই তখনকার মাধববাবুর বাজার অধিগ্রহণ করে ৮,০০,০০০ টাকায়। বর্তমানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসের মোট জমির পরিমাণ ২.৭ একর। বিশ্ববিদ্যালয়ের আর একটি ভবন নির্মাণ শুরু হয় ১৯২৬ সালে। পরবর্তীকালে ওই ভবনের নাম হয় ‘আশুতোষ ভবন’। কারণ ‘বাংলার বাঘ’ হিসেবে পরিচিত আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে নয় বছর কর্মরত ছিলেন। এ দিকে তারকনাথ পালিত ও রাসবিহারী ঘোষ নামে দুই স্বনামধন্য আইনজীবী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে পঁচিশ লক্ষ টাকা দান করলে, সেই টাকায় আচার্য প্রফুল্ল সরকার রোডে ‘বিজ্ঞান ভবন’ তৈরি হয়। বর্তমানে এর নাম রাসবিহারী শিক্ষা প্রাঙ্গণ। অনেকে আবার ‘রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ’ বলেও একে ডাকেন।

১৯৪৭ দেশ স্বাধীনতা প্রাপ্তির দশ বছর পর ১৯৫৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসের পুরাতন সেনেট ভবন ভেঙে, ওখানে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে প্রাপ্ত এক কোটি টাকায় ‘শতবার্ষিকী’ ভবন ও হাজরা রোডে আইন বিভাগের জন্য নতুন ভবনের কাজ শুরু হয়। ১৯৬৮ সালে শতবার্ষিকী ভবন নির্মিত হলে এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার’, ‘আশুতোষ মিউজিয়াম অফ ইন্ডিয়ান’ আর্ট, ‘শতবার্ষিকী সভাঘর’ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যালয় স্থাপিত হয়। ২০১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তার কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ও চল্লিশটি বিভিন্ন বিভাগীয় গ্রন্থাগার সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেয়। এখানে সর্বমোট দশ লক্ষের ওপর বই ও দুই লক্ষেরও অধিক পত্র-পত্রিকা, পুঁথি ও কার্যবিবরণী রক্ষিত আছে।

১৯৫৭ সালে পুরাতন সেনেট ভবন ভেঙে ফেলার পরের বছর ১৯৫৮ সালে ব্যারাকপুর ট্যাঙ্ক রোডে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের জন্য ভবন নির্মিত হয়। এরপর আলিপুরে শহীদ ক্ষুদিরাম শিক্ষা প্রাঙ্গণ গড়ে ওঠে। গড়ে ওঠে হরিণঘাটা ক্যাম্পাস। বর্তমানে চৌদ্দটি ক্যাম্পাস নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গঠিত। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যেমন অনেক রাষ্ট্রনেতা, বিজ্ঞানী, শিল্পী, সাহিত্যিক, প্রকৌশলী বের হয়েছেন, তেমনই এখানের সঙ্গে যুক্ত পাঁচজন পৃথিবীর সবথেকে প্রেস্টিজিয়াস নোবেল পুরষ্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন। যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে যে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সর্বোচ্চ। এনারা হলেন রোনাল্ড রস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চন্দ্রশেখর বেঙ্কট রামন, অর্মত্য সেন ও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই আসুন, আমাদের গর্বের ঐতিহ্যবাহী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মলগ্নে আমরা তাকে যেন এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারি – সেই অঙ্গীকার করি।