• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

ইউনূসের হাঁড়িভাঙা আমের কূটনীতি

সীমন্তে অনুপ্রবেশ সমস্যা দিন দিন বাড়ছে। প্রচুর বাংলাদেশি নাগরিক সীমান্তের অরক্ষিত অঞ্চল দিয়ে ভারতে তথা পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করছে।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

নারায়ণ দাস

বেশ কিছুদিন আগে বাংলাদেশের দিনাজপুরের এক হাজার কেজি হাঁড়িভাঙা আম ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে সম্প্রতি পাঠিয়ে তদারকি সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস প্রমাণ করতে চাইলেন ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে এখনও অবনতি ঘটেনি। এই আম কূটনীতি তার প্রমাণ। এই হাঁড়িভাঙা আম কত মিষ্টি আমরা জানি না, তবে বাংলাদেশে কিন্তু ভারত বিদ্বেষ এবং নানা অপপ্রচার চলছেই। এই আম কূটনীতি চলে আসছে বহুদিন থেকে। এর আগে বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এবং বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত শেখ হাসিনাও ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে এই হাড়িভাঙা আম পাঠানোর নজির রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও মুর্শিদাবাদ এবং মালদার ল্যাংড়া, হিমসাগর এবং আম্রপালি আম প্রধানমন্ত্রীকে আগে পাঠিয়েছেন।

Advertisement

তবে অন্তর্বর্তী প্রধান সৌহার্দ্যের নজির হিসেবে আম পাঠালেন বটে, কিন্তু শেখ হাসিনার আমলে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্প্রীতি ও বন্ধুত্বের যে নিবিড় বন্ধন ছিল এখন আর তা নেই। স্বীকার না করলেও ইউনূস ভালো করেই জানেন, নানা কারণে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সুসম্পর্কের যে বন্ধন ছিল তাতে ফাটল ধরেছে এবং আম কূটনীতিতে তা মেরামত করা যাবে না। তবুও হাঁড়িভাঙা আম প্রধানমন্ত্রীকে পাঠিয়ে তিনি সৌজন্য প্রকাশ করেন।

Advertisement

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সেই আগের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটেছে। এখনও পুরোদমে ভারতের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে এবং এক শ্রেণির ছাত্র, মৌলবাদী এবং পাকিস্তানপন্থীরা ভারতের বিরুদ্ধে নানা উস্কানিমূলক কথা এবং আলোচনা চালাচ্ছে। তার চাইতেও বড় কথা বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষদের বিশেষ করে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার অব্যাহত আছে। তদারকি সরকারের প্রধান সংখ্যালঘুদের ওপর এই পীড়ন বন্ধ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। কারণ, তিনি এখন কট্টর মৌলবাদী এবং এক শ্রেণির ছাত্রদের হাতের পুতুল। তাঁরা যেভাবে ইউনূস সাহেবকে চলতে বলছেন, সেই ভাবেই তিনি চলছেন। ইউনূস সম্প্রতি ঘোষণা করেছিলেন বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু তাঁর ঘোষণার মধ্যেই এই সময়ে নির্বাচন না হওয়ার বীজ লুকিয়ে আছে। গত ৫ আগস্ট গণ অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, তার সংস্কারের কাজ এখনও শেষ হয়নি। বাংলাদেশ এখন প্রায় দুর্ভিক্ষের কবলে চলে এসেছে। কারণ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের আকাল এবং যা এখনও পাওয়া যায় তার মূল্য আকাশছোঁয়া— সাধারণ নাগরিকদের নাগালের বাইরে। ব্যবসাবাণিজ্য মন্দা, কর্মসংস্থানের চরম অভাব। ছোট ছোট মিল, কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। হাজার হাজার কর্মী এখন পথে বসেছেন। বস্ত্র তৈরির কারখানাগুলিও এখন নানা অসুবিধের মধ্যে পড়ে ধুঁকছে।

এর মধ্যে আবার বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন করার জন্য দাবি জানিয়েছে। বিএনপিকে সমর্থন করেছে তার দেশের জামায়েত ইসলামি। আওয়ামী লীগ ও তার ছাত্র সংগঠন ছাত্র লীগ এখন নিষিদ্ধ। সুতরাং তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হচ্ছে না। যদিও এই নিয়ে বিএনপির মধ্যে মতভেদ রয়েছে— এই দলের একাংশ বলছে আওয়ামী লীগের মধ্যেও অনেক ভালো লোক রয়েছেন, তাঁদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেওয়া হোক— তবে আওয়ামী লীগের প্রতীকে নয়। এই অবস্থায় তদারকি সরকারের প্রধান এখন রীতিমতো কোণঠাসা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ চায়, বাংলাদেশের নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলকেই অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হোক। সুতরাং এই বিষয়টি নিয়েও কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। এই পরিস্থিতিতে যদি শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হয়, তাহলে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা। কিন্তু ইউনূস এপ্রিলের আগে নির্বাচন সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দিয়েছেন। বিএনপি দেশে ফেব্রুয়ারি মাসেই নির্বাচন চায়— তার দাবিতে তারা পথে নামতেও প্রস্তুত। বিএনপি চায় নির্বাচন হলে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে।

এদিকে পাকিস্তান চায় বাংলাদেশে যত তাড়াতাড়ি নির্বাচন হয়, ততই ভালো। নির্বাচন নিয়ে পাকিস্তানের নেতারা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে কথাবার্তা চালাচ্ছেন। এদিকে বাংলাদেশে নানাভাবে সাহায্য করছে ইসলামাবাদকে। ইতিমধ্যেই পণ্যবাহী জাহাজ করাচি থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে এসে ঢুকেছে। তাতে খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্রও রয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। গণ অভ্যুত্থান এবং ইউনূসের ক্ষমতায় আসার পর বেশ কয়েকটি জাহাজ বিভিন্ন পণ্যদ্রব্য নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে। পাকিস্তান বাংলাদেশকে সবরকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বাংলাদেশের এখন বড় বন্ধু তুরস্ক, চিন ও পাকিস্তান। মাঝে মাঝেই আলাপ আলোচনার জন্য তারা মিলিত হচ্ছে। চিন বাংলাদেশে একটি আধুনিক মানের হাসপাতাল নির্মাণ করছে, যাতে বাংলাদেশের জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীদের ভারতে এসে চিকিৎসা করাতে না হয়। ভারত চিনের এই কার্যকলাপ নিয়ে বেশ অস্বস্তিতে রয়েছে। দিল্লির সাউথ ব্লক চিনের কার্যকলাপের ওপর নজর রাখছে।
এদিকে বাংলাদেশের বিশিষ্ট নাগরিক, কবি, সাহিত্যিকরা দেশের আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেছেন, দেশে যে অরাজকতা চলছে, তার প্রেক্ষিতে নির্বাচন সম্ভব নয়। সম্প্রতি ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জে যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটল, তা অত্যন্ত উৎকণ্ঠা এবং উদ্বেগের। বাংলাদেশের একটি নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির পদযাত্রা নিয়ে গোলমালের সৃষ্টি।

গোপালগঞ্জ বাংলাদেশের জনক শেখ মুজিবুর রহমানের জেলা। গোপালগঞ্জে নাগরিক পার্টির কর্মীদের সঙ্গে স্থানীয় লোকদের বচসা বাধে। দুই দলের সংঘর্ষে চরমে পৌঁছলে পুলিশ মারমুখী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে গুলি চালায়। তাতে চারজন নিহত হন। অনেকেই আহত হন। এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অনেকেই। কার্ফু জারিও করতে হয়। এখনও সেখানকার অবস্থা স্বাভাবিক হয়নি। নাগরিক পার্টির কর্মীদের সঙ্গে যাদের সংঘর্ষ বাধে তারা বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত। কয়েক মাস আগে একদল উন্মুক্ত জনতা টুঙ্গিপাড়ায় শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি ভাঙার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু স্থানীয় জনসাধারণের বাধার জন্য তা তারা পারেনি। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা যাঁরা এখন দেশজুড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, তাঁরা গোপালগঞ্জের মানুষের প্রতিবাদের জন্য এবং অন্যত্রও আওয়ামী লীগের কর্মীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে গর্বিত। আসলে বাংলাদেশ এখন কোন পথে চলছে, তা এই মুহূর্তে বলা কঠিন। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠন স্বাভাবিক ভাবে চলছে না। ছাত্ররা দ্বিধাবিভক্ত। তদারকি সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের ইচ্ছে নয় এখন বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন হোক। কারণ দেশ যে অবস্থার মধ্যে দিয়ে চলেছে, তার প্রেক্ষিতে নির্বাচন সম্ভব নয়। যদিও বাংলাদেশ সেনা কর্তৃপক্ষও চায় বাংলাদেশে নির্বাচন হওয়া আশু প্রয়োজন। নির্বাচনের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা হওয়া জরুরি। নির্বাচনের জন্য চাপ আসছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী দলের কাছ থেকেও। কিন্তু যেসব ছাত্র সংগঠন তদারকি সরকারের প্রধানকে সমর্থন করে তারাও বাংলাদ্শে আশু নির্বাচন চায়। এই অবস্থায় তদারকি সরকার কী করবে, তা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত।

এদিকে সীমন্তে অনুপ্রবেশ সমস্যা দিন দিন বাড়ছে। প্রচুর বাংলাদেশি নাগরিক সীমান্তের অরক্ষিত অঞ্চল দিয়ে ভারতে তথা পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করছে। বিএসএফ অনেককেই ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার অভিযোগ এনেছে, বিএসএফের নজরদারি শিথিল হওয়ার কারণেই অনুপ্রবেশকারীরা তাদের ফাঁকি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত জেলাগুলিতে ঢুকে পড়ছে। পুলিশ তাদের চিহ্নিত করতে পারছে না। আবার বিধানসভার নির্বাচন খুব কাছে। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা ভোটার তালিকায় নাম তুলছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাহায্যে। ফলে স্বচ্ছ ভোটার তালিকা তৈরি হওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

Advertisement