ভারতের কৃষিবাজার দখল এবং মার্কিন অস্ত্র বিক্রি করাই আমেরিকার সদ্য ঘোষিত শুল্ক নীতির মূল লক্ষ্য। যতই নরেন্দ্র মোদী এ ব্যাপরে নীরব থাকুন না কেন, খোদ মার্কিন বাণিজ্য সচিব হাউয়ার্ড লুটনিক এই কথা বলে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিলেন। কেন্দ্রের বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গোয়েলের সঙ্গে প্রায় সপ্তাহ খানেক দরে আমেরিকার বাণিজ্য সচিব লুটানিকের আলোচনা হয় মার্কিন শুল্ক নীতি নিয়ে। সেই আলোচনার মাঝেই একটি বৈদ্যুতিন চ্যানেলে প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে লুটানিক ভারতে আমেরিকার বাণিজ্য লক্ষ্যের কথা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন। তাঁর সাফ কথা, আমেরিকার জন্য ভারতের কৃষিবাজার অবাধ করে দিতে হবে। এছাড়া যুদ্ধাস্ত্র অন্য কোনও দেশে নয়, কিনতে হবে আমেরিকা থেকেই। আমেরিকার কাছে ভারতের কৃষিবাজার অবাধ করে দেওয়ার বিষয়ে নীরব আছেন মোদী।
বিরোধী দল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ট্রাম্পের সঙ্গে মোদী সরকারের শুল্ক বাণিজ্য রফা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। দলের মুখপাত্র জয়রাম রমেশ বলেছেন, ট্রাম্প ভারতকে শুল্ক নীতি নিয়ে সরাসরি অপমান করছে, হুমকি দিচ্ছে। কিন্তু ‘বন্ধু’ ট্রাম্প নিয়ে মুখে কুলুপ মোদীর। ট্রাম্প ও মোদীর বাণিজ্য চুক্তি প্রকৃতপক্ষে দেশের কৃষক ও ছোট শিল্পের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে বাজার অবাধ ও উন্মুক্ত করতেই। ট্রাম্প তেকে তাঁর বাণিজ্যসচিব সবাই বলে বেড়াচ্ছেন, ভারত তাদের দাবি মেনে নিয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত মাসে মোদী-ট্রাম্প বৈঠকে ভারতের শুল্ক হার নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল। বৈঠক শেষে ট্রাম্প মোদীর সঙ্গে যেথৈ সাংবাদিক সম্মেলনে ভারতের শুল্ক হার বেশি এবং তা কমানো উচিত বলে মন্তব্য করেন। মার্কিন কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনেও ট্রাম্প ভারতের নাম করে ফের বিপুল হারে শুল্ক চাপানো হয়েছে বলে জানান। ভারত সহ যেসব দেশে বেশি শুল্ক চাপানো হয়েছে, তাদের উপর পাল্টা শুল্ক চাপানোর হুমকি দেন ট্রাম্প। এরপরই মার্কিন শুল্ক নীতি নিয়ে আলোচনা করতে তড়িঘড়ি সেদেশে ছুটে যান ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী পীযুষ গোয়েল। মার্কিন বাণিজ্যসচিব হডিয়ার্ড লুটানিকের সঙ্গে মন্ত্রী গোয়েলের আলোচনার মাঝেই ট্রাম্প জানিয়ে দেন, ভারত তাদের শুল্ক কমিয়ে নিতে সম্মত হয়েছে। ভারত নিয়ে ট্রাম্পের এই ধরনের অপমানজনক মন্তব্যের কোনও জবাব দেয়নি মোদী সরকার।
মার্কিন বাণিজ্য সচিব লুটনিক ভারতীয় একটি চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ভারতের শুল্ক নীতি নিয়ে অভিযোগের সুরে বলেছেন, ভারতে বিপুল হারে শুল্ক চাপানো আছে বিভিন্ন মার্কিন পণ্যের ওপরে। সময় এসেছে, কোনও বিশেষ ক্ষেত্র নয়, সবেতেই শুল্ক কমানো উচিত। প্রশ্ন ছিল, ভারতে কৃষিপণ্যে শুল্ক কমানো রাজনৈতিক কারণে খুব সংবেদনশীল বিষয়। কারণ, দেশের বহু মানুষের জীবিকা নির্ভর করছে কৃষির ওপর। এই প্রশ্নের জবাবে লুটনিকের সাফ কথা, ভারতের কৃষিবাজার অবাধ করে খুলে দিতেই হবে। এই বাজার এভাবে বন্ধ করে রাখা উচিত কাজ হবে না। এখানে কৃষিবাজার শুল্ক প্রাচীরে বন্ধ রাখা ঠিক নয়। এখন ভারতকেই ঠিক রাখতে হবে, কীভাবে, কী মাপে তা অবাধ করা যায়। বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। কৃষিবাজার অবাধ করার মধ্য দিয়ে ভারত-মার্কিন বাণিজ্য সম্পর্কের উন্নতি ঘটবে। প্রসঙ্গত, বিশ্বে বাণিজ্য সংগঠনে (ডব্লুটিও) ভারত দেশের কৃষকদের স্বার্থরক্ষায় কৃষিবাজার অবাধ করার বিরুদ্ধে মত দিয়েছিল। এখন সেই বাজার আমেরিকার চাপে অবাধ করার পথে চলেছে মোদী সরকার। এটাই বিরোধীদের অভিযোগ।
শুধু কৃষিবাজারে অবাধ প্রবেশ করার অধিকার নয়, আমেরিকা এবার দেশে প্রতিরক্ষার যুদ্ধাস্ত্র বাজারে একচেটিয়া দখল যে চায়, তাও স্পষ্ট করেছে। ভারত দীর্ঘদিন ধরে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সরঞ্জাম ও যুদ্ধাস্ত্র রাশিয়া থেকে বেশি কিনে থাকে। এখন সময় এসেছে রাশিয়া থেকে তা কেনা পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। তা কিনতে হবে আমেরিকা থেকে। ২০২৫ সাল থেকে আমেরিকা ভারতের সঙ্গে বড় রকমের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বিক্রি শুরু করেছে। এফ-৩৫ ফাইটার জেট বিমান ভারত কিনছে আমেরিকা থেকে। মোদী আমেরিকা থেকে ২০ বিলিয়ন ডলারের যুদ্ধাস্ত্র কেনার চুক্তি করেছে। ২০০৮ সালের পর মোদী সরকার থেকে আমেরিকার যুদ্ধাস্ত্রের এত বড় বরাত মিলেছে বলে জানিয়েছেন লুটনিক।
চাপে রয়েছেন মোদী। তবু আমেরিকার বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন না। শুধু শুল্ক নীতিই নয়, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেও মার্কিন চাপ বাড়ছে। দেশটাকে ধীরে ধীরে বিকিয়ে দিচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী। বিরোধী কণ্ঠও তেমনভাবে সোচ্চার নয়। এটাই বড় বিপদ।