• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

হাসিনার মৃত্যুদণ্ডে বাংলাদেশ দুর্নীতিমুক্ত এবং মানবতার পক্ষে হবে কি?

সিংহাসনচ্যূত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফাঁসির সাজা ঘোষণা হয়েছে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের বিচারে। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের শাস্তি এই মৃত্যুদন্ড।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

নরেন্দ্রনাথ কুলে

বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হাসিনার বিচারে ফাঁসির রায় আগেই হয়েছে । এখন আবার অন্যান্য দুর্নীতি মামলায় তাঁর সর্বমোট একুশ বছরের কারাদণ্ডের রায় দিয়েছে সে দেশের মহামান্য আদালত। এই সাজা হাসিনার অপরাধকে মান্যতা দিতে পারে, কিন্তু তাতে বাংলাদেশে কি সুস্থ সামাজিক পরিবেশ গড়ার পরিবেশ আছে কি? এমনকি কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান তাঁর পূর্বতন অরাজনৈতিক জীবন থেকে বর্তমান রাজনৈতিক জীবন পর্যন্ত সে ব্যাপারে তিনি কতটা তার নিদর্শন রাখতে পেরেছেন? হাসিনার শাস্তি হলেই এ প্রশ্ন শেষ হয়ে যাবে না ।

Advertisement

সিংহাসনচ্যূত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফাঁসির সাজা ঘোষণা হয়েছে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের বিচারে। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের শাস্তি এই মৃত্যুদন্ড। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হলে অপরাধীর প্রতি মানবতার দায় থাকে না। এই রায় তাই বলছে। হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশে মানবতার নিদর্শন কেয়ারটেকার সরকার দেখাতে পেরেছে তা কি নিশ্চিত করে বলা যায়? হিংসাশ্রয়ী ধ্বংসলীলা একের পর এক ঘটেছে। যদিও এর দায় সেই হাসিনার ওপর চাপিয়ে দিতে সময় নেয়নি কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান ইউনুস। মানবতার জন্য কথা বলা মানেই কাজ হয়ে যায়, তা নয়।

Advertisement

এই দেশের প্রতিষ্ঠাতাকে খুন হতে হয় তাঁর সামরিক বাহিনীর হাতে আর তার পঞ্চাশ বছর পর তাঁরই উত্তরসূরী মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হন। এ দেশের গণতন্ত্র পঞ্চাশ বছরে বারে বারে বিপথে চলেছে। আজও তার শেষ নেই। হাসিনা সরকারকে উৎখাত করে ফ্যাসিবাদকে তাড়িয়ে দিতে আন্দোলন সফল হয়েছে বলে দাবি করে। হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী বাংলাদেশে হাসিনাকে হঠিয়ে ফ্যাসিবাদকে সরিয়ে দিতে পেরেছে তা কি পরিষ্কার হয় তাদের কেয়ারটেকার সরকারের কর্মকাণ্ডে। সেই কর্মকাণ্ড মানবতার পক্ষে কথা বলেছে যত, কাজ তার ভুক্তভোগী মানুষ ও সমাজ জানে। তারা ফ্যাসিবাদকে সরিয়ে দিতে আওয়ামী লীগকে পর্যন্ত নিষিদ্ধ করেছে, হাসিনার ফাঁসির সাজা রায় দিয়েছে। এতেই ফ্যাসিবাদ তাড়িয়ে দিতে পারবে বলে হয়তো তারা মনে করছে। আসলে হাসিনা সরকারের পতন আর আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করে তাদের পরবর্তী কর্মকাণ্ড সুস্থ সমাজ গড়ে তুলতে কি চেয়েছে? ইসলামপন্থীরা জাতীয় সঙ্গীত পাল্টে ফেলার ডাক দিয়ে রবীন্দ্রনাথের চর্চা সম্পর্কে প্রশ্ন তুললে সরকার যখন নিশ্চুপ থাকতে পারে তখন সেই সরকার ফ্যাসিবাদ তাড়িয়ে দিতে-যে চায় এ তার লক্ষণ হতে পারে না। বিশ্বে প্রথম ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের স্বাক্ষরকারী রবীন্দ্রনাথ। সেই রবীন্দ্রনাথ তাদের কাছে কাম্য নয়। বর্তমান সরকারের সামরিক পরিবেশে যে সমস্ত ইসলামপন্থী সংগঠন অতি সক্রিয় হয়েছে, এমনকি যারা এই সরকারের সাথে আছে, তারা কি সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশের পরিপূরক? পুরোপুরি মানবতার পক্ষে? একটি দেশ ভেঙে দু’টুকরো হল— ভারত, পাকিস্তান। আবার পাকিস্তান ভেঙে আরো একটি হল। বাংলাদেশ তার সেই কনিষ্ঠতম দেশ। পাকিস্তানে ইসলামপন্থীর উগ্রতায় বারে বারে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা গেছে। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। গণতন্ত্রের সঙ্গে মিলিটারি আর মৌলবাদ একপ্রকার লুকোচুরি খেলতে খেলতে পাকিস্তান শান্তিকামী হয়ে উঠেছে তা বলা যায় না। এ পথে বাংলাদেশও হোঁচট খেয়েছে। কিন্তু বর্তমান অবস্থার রাজনৈতিক অঙ্ক সরল পথে হতে পারে তা একদমই নয়।

একটি গণতান্ত্রিক সরকারহীন দেশে মানবতার কথা বলে প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধানের বিচারে ফাঁসির সাজায় মানবতার পরিমাণ কতটুকু তা পরিষ্কার করে দেয়। পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান জুলফিকার আলি ভুট্টোকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল ১৯৭৯ সালে। পঁয়তাল্লিশ বছর পর ভুট্টোর সেই সাজা ত্রুটিপূর্ণ ছিল বলে সে দেশের উচ্চতর আদালত জানিয়েছে গত বছর। আসলে রাষ্ট্রপ্রধানের এই মৃত্যুদন্ডের সাজা একপ্রকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধ ছাড়া আর কিছু হয় না এই আধুনিকোত্তর সময়ে। হাসিনার এই সাজার ক্ষেত্রে এই-সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলেই রাজনৈতিক মহল তাই বলছে। পাকিস্তানে ভুট্টোর বিচারের কথাই হয়তো স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। পরবর্তী সময়ে ভুট্টোর কন্যা বেনজির প্রথম মুসলিম নারী হিসেবে রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছেন। তাঁকেও আততায়ীর হাতে খুন হতে হয় ২০০৭ সালে। দেশের ট্রাইবুনালের বিচারে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসেনের ফাঁসি হয়েছিল ২০০৬ সালে। এ শতাব্দীর সবথেকে বিতর্কিত বিষয় এই ঘটনা। এ ঘটনার পিছনে বিশ্বের শক্তিশালী সুবিধাবাদী সাম্রাজ্যবাদী দেশ আমেরিকার কলকাঠি খেলা করেছিল। ফ্যাসীবাদী, একনায়কতন্ত্রের অবসানের নামে বিতর্কিত হত্যার কথা তুলে মানবতার কথা বলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পরিবর্তন এবং প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধানের মৃত্যুদন্ডে ফ্যাসিবাদ শেষ হয়ে গেছে বা যায়, মানবতার কাজ এগিয়ে চলে, এমনটি বলা যায় না।

আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট নাজিবুল্লাহ’র ফাঁসি হয় তালিবানের হাতে। তালিবান কি মানবতার পক্ষে? আফগানিস্তানের রাজনৈতিক ছবি কি সুস্থ? ফ্যাসিবাদের চেনা সামরিক ছবি থাকবেই এমন কোনও কথা নয়। সে ছবির রূপ সময়ের সঙ্গে অন্যরকম হয়ে যায়। অন্য পোশাকে সে আবির্ভূত হয়। তবে প্যালেস্টাইনের সঙ্গে ইজরায়েল যেভাবে সামরিক কায়দায় গণহত্যা চালাচ্ছে সে কি ফ্যাসিবাদের উল্টো পিঠ, মানবতার পক্ষে? বিশ্বজুড়ে চলমান গণতন্ত্র এই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধচারণে কতটা ভূমিকা নিতে পেরেছে? যে কোনও যুদ্ধ মানবতার পক্ষে? ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার আক্রমণ তথা যুদ্ধ কি মানবতার পক্ষে? একটি দেশ আরেকটি দেশে বর্বরতা চালালে মানবতার পক্ষে বলা যায় না, আবার ফ্যাসিবাদও বলা যাবে না। তাহলে মানবতা আর ফ্যাসিবাদ কি? মানবিকতা আর মানবতা এক নয়। আর ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে বিশিষ্ট
এক দার্শনিক ও চিন্তানায়ক বলছেন, ‘একদল লোক আছেন, যাঁরা প্রশাসনের উগ্র মূর্তিটাকেই ফ্যাসিবাদ বলেন, একনায়কত্বকেই ফ্যাসিবাদ বলেন। …একনায়কত্ব মিলিটারি একনায়কত্ব হয়, একনায়কত্ব আচমকা অভ্যুত্থানের দ্বারাও তৈরি হয়। তাছাড়া, অত্যাচার সমস্ত জনস্বার্থবিরোধী প্রশাসন ব্যবস্থাতেই হয়….। কিন্তু ফ্যাসিবাদ হচ্ছে একটি সর্বাত্মক প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থান। একদিকে সে মানুষের জ্ঞানবিদ্যাবুদ্ধিকে কারিগরীমুখী করে তোলে, অর্থাৎ দেশে একদল… শিক্ষিত কারিগর সৃষ্টি করে— যাঁরা মানবিক লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত, মানুষের প্রতি এবং সমাজের প্রতি যাঁদের কোনও দায়িত্ববোধ নেই,…পয়সার বিনিময়ে তাঁরা যা কিছু করতে পারেন এবং এইভাবে বিজ্ঞানের চর্চা ও বিদ্যাকে তাঁরা প্রবাহিত করে। অপরদিকে যত অধ্যাত্মবাদ, সেকেলে যত রকমের কুসংস্কার, যত যুক্তিহীন মানসিকতা এবং অন্ধতাকে গড়ে তোলে। ফ্যাসিবাদ হচ্ছে অধ্যাত্মবাদ, তমসাচ্ছন্ন ভাবনা-ধারণা এবং যুক্তিহীনতার সাথে কারিগরি বৈজ্ঞানিক বিদ্যার এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। এরকম ঘটনা যখন ঘটে তখন যুক্তিবাদী মন দেশে মারা যায়।’

বিশ্বজুড়ে আজকের রাজনৈতিক পরিবেশে এই উক্তির প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে রাজনৈতিক তর্ক চলতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান সম্পর্কে ধর্মীয় অন্ধত্বের উগ্রতা নিয়ে সন্দিহান হওয়ার অবকাশ নেই। এমনকি ভারতেও সেই উগ্রতার চেহারা ক্রমশ কর্কশ পথে হাঁটতে শুরু করেনি তা কি বলা যায়? যুক্তিবাদী মন দেশে দেশে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা একেবারেই নিশ্চিত করে বলা যায় কি? ফ্যাসিবাদ, একনায়কতন্ত্র বা মানবতার বিরুদ্ধে ফাঁসি বা মৃত্যুদন্ড কিংবা কারাদন্ডের সাজা দিলেই দেশে পরিবর্তিত শাসক মানবতার পক্ষে কাজ করবে, দেশ দুর্নীতিমুক্ত হবে, এমনকি দেশের মানুষ যুক্তিশীল হয়ে উঠবে বা গড়ে তুলতে সাহায্য করবে তা বাংলাদেশের বর্তমান পরিবেশ ও পরিস্থিতি বলে দিচ্ছে, এ কথা বলা যায় না ।

Advertisement