• facebook
  • twitter
Tuesday, 15 July, 2025

‘ডিপসিক’কে নিয়ে এতো হৈ চৈ কেন?

এনভিডিয়ার মতো দৈত্যকে ধরাশায়ী করে দিয়ে ডিপসিক এমন শিরোনামে। কম খরচে ও কম জটিল প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিপসিক পৃথিবীর সমস্ত নামী দামী এআই চিপ প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলোকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। এতোদিন এআই গবেষণার জন্য যে সব উন্নতমনের চিপ ব্যবহার করা হচ্ছিল তাদের মূল্য আকাশ ছোঁয়া। ফলে এআই গবেষণার জন্য খুব বড় ধরনের বরাদ্দের দরকার হচ্ছিল।

প্রতীকী চিত্র

অসীম সুর চৌধুরী

গত ২৭ জানুয়ারি (২০২৫) আমেরিকার শেয়ার বাজারের একটা বড় ঘটনা সারা বিশ্বের নজর কেড়েছিল। শেয়ারের নিরিখে শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান কোম্পানী হচ্ছে ‘এনভিডিয়া’। ঐ দিন এনভিডিয়ার শেয়ারে ব্যাপক ধ্বস নামে। মাত্র একদিনেই ওই কোম্পানির শেয়ার মূল্য ৬০ হাজার কোটি ডলারের নীচে নেমে যায়। তাদের মোট বাজার মূল্য ৩.৫ লক্ষ কোটি ডলারের সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে ২.৯ লক্ষ কোটি ডলারে এসে থামে। এর ফলে মার্কিন শেয়ার বাজারের ফাস্ট বয় এনভিডিয়া তার প্রথম স্থান থেকে পিছলিয়ে তৃতীয় স্থানে নেমে যায়। আমেরিকার শেয়ার বাজারের ইতিহাসে এর আগে একদিনে কোনও কোম্পানির শেয়ার দর এত নীচে নামেনি। কিন্তু পৃথিবীর বৃহত্তম কোম্পানির শেয়ারের এতটা পতন হল কেন? বিশেষজ্ঞদের মতে এর পেছনে এক এবং একমাত্র কারণ চিনা এআই কোম্পানি ‘ডিপসিক’ এর উত্থান। কিন্তু এনভিডিয়ার শেয়ার পতনের সাথে ডিপসিক এর কি সম্পর্ক? এআই-এর কোন ব্যাপারগুলোতে এরা যুক্ত? এগুলো জানার আগে গোড়া থেকে ব্যাপারটা একটু আলোচনা করা যাক।

কম্পিউটারকে দিয়ে মানুষের বুদ্ধিমত্তার কাজগুলো যে প্রযুক্তির সাহায্যে আয়ত্ত করানো হয় তার নামই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স, সংক্ষেপে এআই (AI)। এই পদ্ধতিতে মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তাশক্তিকে কম্পিউটার দ্বারা অনুকরণ করার চেষ্টা করানো হয়। এই ক্ষেত্রে ‘মেসিন লানিং’ ও ‘ডিপলানিং’ এর মতো বিশেষ ধরনের ভাষাগুলো কম্পিউটারকে মানুষের মতো ভাবতে সাহায্য করে। মেসিন তখন বুদ্ধিমত্তা দেখায়। এআই-মানুষের যুক্তি, সমস্যা ও পরিকল্পনাগুলো উপলব্ধি করে তার সমাধান বাতলাতে পারে।

কয়েক দশক ধরেই আমরা ধাপে ধাপে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্তরণ দেখতে পাচ্ছি। যেমন গুগল ম্যাপের সাহায্য নিয়ে কোনও অজানা ঠিকানা খুঁজে পাওয়া অথবা ই-কমার্স সংস্থার টুল এ্যাসিসট্যান্ট আপনার কাছে সমস্যা জানতে চাওয়া, এসবই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নিদর্শন। এছাড়া এআই-এর কেরামতি দাবার বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে হারিয়ে দিয়েছে, ড্রাইভার ছাড়া গাড়ি চালিয়েছে, রোগীর পুরনো ইতিহাস ঘেঁটে বর্তমানের রোগ সারিয়েছে। এইভাবে আমাদের প্রতিদিনের জীবনে এআই প্রভাব বিস্তার করে চলেছে।

সাম্প্রতিককালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রয়োগ হচ্ছে ‘চ্যাট- জিপিটি’। ২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর উদ্বোধন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই চ্যাট জিপিটি সারা পৃথিবীতে বেশ হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে। আমেরিকার সংস্থা ‘ওপেন এআই’ এর তৈরি এই অ্যাপ আগমনের মাত্র দু’মাসের মধ্যেই ১০ কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল।

চ্যাট জিপিটি হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটা ‘চ্যাটবট’ অর্থাৎ আলাপচারিতা করার মাধ্যমে। এখানে আমাদের নানারকম প্রশ্নের জবাব নিয়ে সে হাজির। আমরা যেভাবে যে ফরম্যাটে চাইব, সে সেই ভাবেই উত্তর দেবে। বিশাল তথ্যভাণ্ডার রয়েছে এর কাছে। গুগুল বা এজ এর মতো সার্চ ইঞ্জিনগুলোর কাছে কোনও অনুসন্ধান করতে গেলে তারা এই সম্বন্ধীয় লিঙ্কগুলো আমাদের কাছে হাজির করে। কিন্তু চ্যাট-জিপিটি সরাসরি উত্তর দিয়ে দেয় যার সিংহভাগই সঠিক।

চ্যাট জিপিটি অনেক ক্ষেত্রে মানুষকে টেক্কা দিয়ে তার থেকে অনেক কম সময়ে ও ভালোবাবে কাজ সম্পন্ন করতে পারে। যেমন, সকল ধরনের প্রশ্নোত্তর ও সমস্যার সমাধান খুব তাড়াতাড়ি বাতলায়, গল্প কবিতা প্রবন্ধ ইত্যাদি লিখতে সিদ্ধহস্ত, ভার্চুয়াল সহকারি হিসাবে কোনও বিষয়ে পরামর্শ দিতে এরা পিছপাও হয় না, লাখ লাখ মানুষের তথ্য বিশ্লেষণ করে অতি অল্প সময়ে রোগীকে ওষুধ দিয়ে দেওয়া। চ্যাট জিপিটির পাশাপাশি আরো কিছু চ্যাটবট অ্যাপ বাজারে চলছে, যেমন গুগল কোম্পানির ‘জিমিনি’, মাইক্রোসফটের ‘কপিলট’, মেটার ‘মেটা এআই’ ইত্যাদি। তবে জনপ্রিয়তায় সবাইকে পেছনে ফেলেছে ‘চ্যাট জিপিটি’।

কিন্তু সেই জনপ্রিয়তার সিংহাসনকে টলমল করে দিয়েছে চিনা এআই কোম্পানি ‘ডিপসিক’। মাত্র দেড় বছর আগে, ২০২৩ সালের জুলাই মাসে চিনের হাংঝু শহরে এর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। এটা এআই চালিত একটা চ্যাটবট অ্যাপ। কিন্তু শুরুতেই এই চিনা অ্যাপ যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সারির এআই কোম্পানিগুলোকে কড়া প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলে দিয়েছে।
ডিপসিক-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ‘লিয়া ওয়েন ফেং’ হচ্ছেন একজন তথ্য-প্রযুক্তি স্নাতক। বছর চল্লিস বয়সের মি: ওয়েন ফেং প্রায় ৫০,০০০ আইসি চিপ জোগাড় করেছিলেন, যেগুলো এআই এর কাজে ব্যবহৃত হয়। এর বেশির ভাগ চিপই আমেরিকা থেকে আমদানি করা। কিন্তু বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র এই চিপ আর চিনে রপ্তানি করে না। বিশেষজ্ঞদের ধারণা ওই জমিয়ে রাখা চিপ এর সঙ্গে আরো কিছু প্রয়োজনীয় চিপ যুক্ত করে মি: ওয়েন ফেং এবং তার সহকারীরা ‘ডিপসিক’ চ্যাটবট বানিয়েছে।

এই বছর (২০২৫) ১০ জানুয়ারি ডিপসিক এআই অ্যাপ আমেরিকার বাজারে ছাড়া হয়। বাজারে মুক্তি পাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই এটা ‘অ্যাপল স্টোর’ এ সর্বাধিক ডাউনলোক করা ফ্রি অ্যাপের তালিকায় এক নম্বরে উঠে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় এআই চ্যাটবট অ্যাপ যেমন চ্যাট জিপিটি, জেমিনি ইত্যাদিকে পেছনের সারিতে ঠেলে দিয়েছে।
মার্কিন মুলুকে এই ডিপসিক এর হঠাৎ বিপুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে প্রযুক্তিগত খরচার পার্থক্য। ওপেন এআইএর চ্যাট জিপিটি যে কাজ করে, সেই একই কাজ ডিপসিক করতে পারে। কিন্তু খরচের তুলনা টানলে দেখা যাবে চ্যাট জিপিটির তুলনায় ডিপসিক এর ব্যয় নগন্য। ডিপসিক অ্যাপ প্রস্তুত করতে যেখানে কম-বেশি ৬০ লক্ষ ডলার খরচা হয়েছে সেখানে চ্যাট জিপিটির পেছনে কোম্পানিকে প্রায় ১০০ কোটি ডলার ঢালতে হয়েছে। খরচের এই বিশাল ফারাক ডিপসিককে অনেকটা পথ এগিয়ে দিয়েছে।

এত কম খরচে এই চিনা অ্যাপ তৈরির ব্যাপারটা প্রকাশ্যে আসতেই যুক্তরাষ্ট্রে শোরগোল পড়ে গেল। তার ফল সরূপ মার্কিন শেয়ার বাজারে উথাল-পাথাল দেখা গেল। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হল এনভিডিয়া। তার কারণ এনভিডিয়া হচ্ছে আমেরিকার সবচেয়ে শক্তিশালী এআই চিপ তৈরির এক নম্বর কোম্পানি। কিন্তু তাদের থেকে অনেক অনেক কম দামে এবং কম জটিল প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিপসিক চিপ বানিয়েছে। ফলে শেয়ার বাজারে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ওই এনভিডিয়া। এছাড়া পৃথিবীর আরো অনেক কোম্পানি যারা এআই চিপ বানায় বা ডেটা নিয়ে কারবার করে তাদেরও পুঁজিতে টান পড়েছে ডিপসিক-এর আগমনে।

এনভিডিয়ার মতো দৈত্যকে ধরাশায়ী করে দিয়ে ডিপসিক এমন শিরোনামে। কম খরচে ও কম জটিল প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিপসিক পৃথিবীর সমস্ত নামী দামী এআই চিপ প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলোকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। এতোদিন এআই গবেষণার জন্য যে সব উন্নতমনের চিপ ব্যবহার করা হচ্ছিল তাদের মূল্য আকাশ ছোঁয়া। ফলে এআই গবেষণার জন্য খুব বড় ধরনের বরাদ্দের দরকার হচ্ছিল। কিন্তু ডিপসিকের এই সাফল্য অনেক ব্যয় বহুল গবেষণাকে মাটিতে নামিয়ে আনবে। ফলে ভবিষ্যতে অনেক কম খরচে এআই-এর উন্নতি সাধন সম্ভব হবে।