নরেন্দ্রনাথ কুলে
ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক তরুণ নেতার মৃত্যুতে বাংলাদেশ উত্তপ্ত। নৈরাজ্যের আগুনে জ্বলছে বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি। বাংলাদেশে এই প্রতিবাদে হিংসা, মৃত্যুর মত ঘটনা ঘটে চলেছে একের পর এক। যদিও এই পরিবেশে প্রতিবাদ না প্রতিশোধ, শব্দদুটির কোনটি বেশি প্রযোজ্য তা কি বোধগম্য? প্রতিবাদ আর হিংসা পরস্পর পরিপূরক তা কখনোই বলা যায় না। কিন্তু কোনো বিশেষ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তা কখনো ঘটে যেতে পারে। তবে প্রতিশোধের সাথে হিংসা জড়িয়ে থাকে। সেই হিংসার রূপ সময়ভেদে পৃথক পৃথক চেহারা নেয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রতিবাদ, প্রতিশোধ শব্দদুটির আক্ষরিক অর্থের পার্থক্য যেন হারিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবাদ চেতনার এক স্ফূরণ। প্রতিশোধ পরিকল্পনার একটি অংশ হল হিংসা।
Advertisement
ইনকিলাব মঞ্চের তরুণ নেতার মৃত্যুর ঘটনায় মানুষের প্রতিবাদ কোনো চেতনার স্ফূরণ তা বলা যায় না। এ যেন প্রতিশোধের স্পৃহা। কিন্তু সেই প্রতিশোধের চেহারায় নৈরাজ্যের আগুন। প্রিয় নেতা চলে যাওয়ার এমন প্রতিবাদ ইনকিলাব মঞ্চের কর্মী ও সমর্থক যেন বিস্ফোরণের স্রোত। ইনকিলাব শব্দটির রাজনৈতিক তাৎপর্যে এত বিপুলসংখ্যক অনুগামী ও সমর্থক বাংলাদেশের বুকে ফ্যাসিবাদী দুর্নীতিপরায়ণ সরকারের পক্ষে বিপজ্জনক হবে এবং সেই বিপজ্জনক পরিস্থিতির ফল কি এই বিস্ফোরণ? এই বিস্ফোরণ কি ইনকিলাব শব্দের? ইনকিলাব শব্দে যে বিপ্লবের ডাক আসে, এ কি তারই ফলস্বরূপ? তার ফলে কি একের পর এক হিংসাত্মক আগুনে বাংলাদেশ জ্বলছে। বাংলাদেশের এই হিংসাত্মক ও ধ্বংসাত্মক আগুনে কি সেই বিপ্লবের ডাক আছে?
Advertisement
বিপ্লবের ডাকে ইনকিলাব ধ্বনি যে বিপ্লবীর মুখে প্রথম ধ্বনিত হয়েছে, তাঁর কাছে বিপ্লবের যা অর্থ তা কি বাংলাদেশের এই হিংসাত্মক কর্মকান্ড বলে? সেই বিপ্লবী ভগৎ সিং-এর কথা অনেক কিছু স্পষ্ট করে দেয় তা। তিনি বলেছেন, ‘…বিপ্লবের মধ্যে হানাহানি অনিবার্য নয়। এর মধ্যে ব্যক্তিগত প্রতিশোধ লিপ্সার কোনো অবকাশ নেই। বিপ্লব বোমা-পিস্তলের সংস্কৃতি নয়। অন্যায়ের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত সমাজব্যবস্থাকে পরিবর্তিত করার জন্যই বিপ্লব আমাদের চাই।—যদি সময় থাকতে মানবসভ্যতার কাঠামোকে রক্ষা করা না যায়, তবে তা ধ্বংস হয়ে যাবে এবং এই জন্যই বিপ্লব অত্যাবশ্যক।’ ইনকিলাব মঞ্চের নেতার মৃত্যুর প্রতিবাদে বাংলাদেশের উত্তাল চেহারা সে কথা বলে না। তাহলে এ কি নিছক বিদ্রোহ! বিদ্রোহ কখনো বিপ্লবের রূপ নিতে পারে। তবে তার রূপ আলাদা। ভগৎ সিং-এর কথায়, ‘বিদ্রোহকেও বিপ্লব বলা যায় না, যদিও বিদ্রোহ চূড়ান্ত পরিণামে বিপ্লবে পরিণত হতে পারে ।’ ইনকিলাব শব্দ বা শ্লোগানে সেই বার্তা দিতে পারে বলে ভগৎ সিং মনে করেন। তাঁর কথায়, ‘এই শ্লোগানে বিপ্লব শব্দের অর্থ হল প্রগতির জন্য পরিবর্তনের-চিন্তা এবং আকাঙ্খা। মানবজাতির আত্মার সঙ্গে বিপ্লবী চিন্তা এমন ওতোপ্রতোভাবে মিলেমিশে যাওয়া দরকার যাতে মানবজাতির প্রগতির জায়গায় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে।’ বাংলাদেশের উত্তাল পরিস্থিতি তে কি বলা যায় যে বিপ্লবী চিন্তা সে দেশের জনগণের আত্মার সঙ্গে মিলেমিশে গেছে? নতুন সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠার জন্য যে বিপ্লব তা কি বাংলাদেশের এই ধ্বংসাত্মক আগুনে দেখা যাচ্ছে? এ সম্পর্কে বিপ্লবী ভগৎ সিং-এর কথায় আলোকপাত করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, ‘বিপ্লবীরা মনে করে— দেশের বুকে এক নতুন সামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সিংসদরঘাট উন্মুক্ত হয়ে যাবে— বিপ্লবের আঘাতে পুঁজিবাদ, শ্রেণী বিভেদ তথা মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে বিশেষ অধিকার তুলে দেয় এমন সমাজ ব্যবস্থার অবসান ঘটে যাবে। বিপ্লব দেশকে আত্মনির্ভর হবার পথ করে দেবে। বিপ্লবের মধ্য দিয়ে— দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তগত করে বসে থাকা অবাঞ্ছিত সামাজিক শক্তিগুলির দখলদারিদের খতম করে দেবে।’ কিন্তু বাংলাদেশে এমন অবাঞ্ছিত শক্তিগুলিই আজ যেন বাঞ্ছিত শক্তি যা মানুষের পরিচয়কে বিনাশ করে।
ভগৎ সিং মানবসভ্যতাকে ধ্বংসের হাত থেকে বিপ্লবের আদর্শ দিয়ে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই আদর্শ চাষের জমি কি অরক্ষিত হয়ে পড়েছে? পৃথিবীজুড়ে মানবসভ্যতা তাই ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশে এই হিংসাত্মক ও ধ্বংসাত্মক আগুনে সেই পথ যেন আরও প্রসারিত হয়ে চলেছে।
বাংলাদেশের ধারাবাহিক অস্থিরতা, হিংসাত্মক ও ধ্বংসাত্মক ঘটনা দিয়ে ইনকিলাব মঞ্চের সমর্থনে এই উত্তাল পরিস্থিতির ব্যাখ্যা তাই অবান্তর হয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক উত্তাল আগুনে পুড়ছে ধর্ম, ইতিহাস, সংস্কৃতি, মনুষ্যত্ব, নীতি, নৈতিকতা, মানবিকতা, মানবতা। বিপ্লব কখনো এগুলো ধ্বংস করে না। বাংলাদেশে যখন এগুলোর ধ্বংস খেলায় জনতা উন্মত্ত ইনকিলাব মঞ্চের নামে, তখন ইনকিলাব ধ্বনির তাৎপর্য ধূসর হয়ে ওঠে। এই জনতা ইনকিলাব ধ্বনি— সংস্কৃতির চর্চা-রহিত হিসেবেই নিজেদের পরিচয় দিয়েছে। সেই পরিচয়েই ইতিহাস, সংস্কৃতি, মানবতা, নৈতিকতা ভাঙার খেলায় তারা আজ উন্মত্ত। এই উন্মত্ততা কি তাদের রাজনৈতিক পরিচয় দেয়? নাকি রাজনৈতিক পরিচয়ের আর এক খোলস মাত্র। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশে সেই খোলসের রঙ আরো তীব্র হয়ে উঠছে। আর সেই তীব্রতার রঙে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের পরিচয়। মানুষের পরিচয় হারিয়ে যায় উগ্র জাতীয়তাবাদ আর মৌলবাদের বিষে। এই বিষে জর্জরিত শুধু বাংলাদেশ নয়। চলমান রাজনৈতিক বাতাবরণে এই বিষ ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর বাতাসে। দেশের মাটি থেকে যুক্তিবাদী মন মরে গেলে এই বিষ ছড়িয়ে পড়ে অতি দ্রুত। বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বলে দিচ্ছে যুক্তিবাদী মনের মৃত্যু মড়কের আকার নিয়েছে। তাই দেশের গঠনশৈলীর ইতিহাস ও উন্নত সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্রগুলিকে নিশ্চিহ্ন করার খেলায় মেতে উঠেছে উগ্র জনতা ইনকিলাব মঞ্চের নেতার জন্য শোকের নামে। এই জনতা আর ইনকিলাব মঞ্চ সমার্থক নয়। সমার্থক করে তোলার পিছনের কারিগরদের এক পরিকল্পনা। যে পরিকল্পনায় হিংস্র চেহারা লুকিয়ে থেকে কখনো অতর্কিতে হানা দেয়, বা হানা দেওয়ার সুযোগ খোঁজে। সেই সুযোগ করে দিয়েছে ইনকিলাব মঞ্চের নেতার খুন। কিংবা সুযোগ করে নিতে এই খুন। যাই হোক, সুযোগের সদ্ব্যবহার অতি সহজে করতে পারে যখন দেশের জমিতে মরে যায় যুক্তিবাদী মন। তখন প্রতিক্রিয়াশীল ভাবধারা সমাজজীবনে প্রবেশের পথ সৃষ্টি হয়। উগ্র জাতীয়তাবাদ আর মৌলবাদ অনায়াসে মাথা চাড়া দেয় স্বমহিমায়। তখন মানবজাতির প্রগতির ধারা নিম্নমুখী। মানবসভ্যতা ধ্বংসের মুখে এগিয়ে চলে। বাংলাদেশ আজ সেই দিকে এগিয়ে চলেছে।
Advertisement



