বরুণ দাস
জলের সঙ্গে মাছ আর হাড়ের সঙ্গে মাংস-উভয়েই উভয়ের সঙ্গে আবহমানকাল ধরে যেমন ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত হয়ে আছে, ঠিক তেমনি রাজনীতির সঙ্গেও আমাদের জীবন জড়িয়ে গেছে! জীবনের সঙ্গে জীবন নয়, রাজনীতির সঙ্গে জীবনের যোগই আজকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য! মানুষ চান বা না-ই চান, ওই সম্পৃক্ততা থেকে কোনও ভাবেই যেন মুক্তি নেই তাঁদের। এ এক কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি আমরা। এই কঠিন সময় থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার তেমন কোনও আশা আপাততঃ দেখা যাচ্ছে না।
অনেক মানুষই সক্রিয় রাজনীতি করেন না। রাজনীতিতে আগ্রহ নেই। আগ্রহ না থাকারও যথেষ্ট কারণ আছে এবং সেসব কারণ নতুন করে বলারও অপেক্ষা রাখে না। সবাই কমবেশি তা জানেন। শুধু ‘জানেন’ বললেও বোধহয় সবটা বলা হয় না। বরং বলা ভালো, হাড়ে হাড়ে জানেন! আমাদের প্রতিদিনকার সংসার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে রাজনীতির প্রতিফলন (পড়ুন দূষণ) ঘটে চলেছে এবং আজ আর কেউ এর বাইরে নন! কেউ হয়তো প্রত্যক্ষভাবে, কেউ-বা আবার অপ্রত্যক্ষভাবে। উনিশ-বিশ!
যাঁরা আদ্যন্ত সারস্বত জগতের মধ্যেই আবদ্ধ, কোনও রকম সক্রিয় রাজনীতিরই অন্ততঃ ধার ধারেন না (যদিও নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শন হয়তো আছে এবং থাকাটাই স্বাভাবিক), তাঁদেরকেও যখন-তখন টেনে-হিঁচড়ে রাজনীতির কাদা-মাখা ময়দানে নামাচ্ছেন আজকের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা। নীরবতাও যে প্রতিবাদের জোরালো ভাষা, তা হয়তো তাঁরা জেনে গেছেন। তাই তাঁদের ‘চুপ করে থাকা’টাকেও কোনওভাবে মেনে নিতে পারছেন না মতবাদ নির্বিশেষে রাজনীতির জগতের ‘দিকপাল’ জনেরা।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কেউ কেউ ধরেই নিয়েছেন যে, যাঁরা সরাসরি বিরোধিতা করছেন না বটে; তবে ‘আমাদের পক্ষে’ জোর গলায় সওয়ালও তো করছেন না, তাই তাঁরা নিশ্চিত আমাদের বিপক্ষে। ‘বিপক্ষ’-এর লোকেরা কখনও আস্থাভাজন কিম্বা বন্ধু হতে পারেন না; তাঁরা শত্রু। অতএব যেন-তেন-প্রকারেন তাঁদের (পড়ুন সম্ভাব্য শত্রুদের) আক্রমণ করো। হাতে-গরম কোনও ইস্যু খুঁজে না পেলে, ইস্যু তৈরি করেই না-হয় তাঁদের আক্রমণ শানাও ! ‘শত্রু’দের কখনও শান্তিতে থাকতে দেওয়া উচিত নয়।
আবার এমন অনেক বিশিষ্টজন আছেন যাঁরা কোনও দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকলেও মতবাদ নির্বিশেষে যেকোনও শাসকের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে কখনও-সখনও প্রতিবাদে সরব হন। অরাজনৈতিক প্রতিবাদী মানুষের মিছিলে হাঁটেন। তাঁদের সম্মেলক প্রতিবাদে সহমত পোষণ করে লিখিত বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন। কিম্বা বুলেটিন বা নিউজলেটারে নিজের মতামত জানান। যা অনেক সময়েই শাসকদলেরই পছন্দ নয়। এক্ষেত্রে অত্যাচারি-স্বৈরাচারি শাসকদলের বড়োকর্তারা চায়, ওই বিশিষ্টজনেরা চুপ থাকুন।
কিন্তু যাঁরা কোনও সরকারেরই দেওয়া কোনও বিশেষ সুযোগ-সুবিধে কিম্বা দান-অনুদান-উপহার-পুরস্কার-সন্মান (পড়ুন ঘুষ গ্রহণ করেননি, শিরদাড়া বা মেরুদন্ড টান অর্থাৎ প্রতিবাদী মানসিকতা বজায় রাখার জন্য, তাঁরা কেন সরকারপক্ষের (রাজ্য কিম্বা কেন্দ্র) অন্যায় আচরণ দেখেও চুপ করে থাকবেন? বিশেষ করে প্রতিবাদী জনতা যথন তাঁদের কাছে যান এবং পাশে দাঁড়ানোর বিনীত অনুরোধ জানান, তখন প্রতিবাদী জনতার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া তো আসলে কাপুরুষতারই পরিচয়!
উল্লেখ্য, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম কান্ডের সময় তো বটেই, বাংলার উন্নয়ন-কান্ডেও বর্ষীয়ান কবি তথা ‘জনতার বিবেক’ বলে চিহ্নিত শ্রীশঙ্খ ঘোষ যখন তাঁর বলিষ্ঠ লেখনির মধ্য দিয়ে সরকারের অসঙ্গতিগুলোকে ধরিয়ে দেওয়ার প্রয়াস চালান, তখন তাঁকে লক্ষ্য করে সরকারের পারিষদবর্গ উগরে দেন নানাবিধ অশালীন মন্তব্য। সত্য উচ্চারণ করার অপরাধে প্রাজ্ঞকবিকে দাঁড় করান আসামির কাঠগড়ায়। তাঁকে নিয়ে চলে অনাকাঙ্ক্ষিত কাটাচেরা। যা দেখে লজ্জায়-ঘৃণায় মাথা হেঁট হয়ে যায় আপামর সাধারণ মানুষের।
অথচ চুপ থাকেন বাংলারই সরকার-ঘেঁষা অন্যান্য ‘বিশিষ্টজন’-এরা! এক আশ্চর্য-অখন্ড নীরবতা তাঁদেরকে ঘিরে রাখে আদ্যন্ত! এই একুশ শতকে পা রেখেও একমাত্র সত্য বলার অপরাধে লাঞ্ছিত হতে হয় কোনও সর্বজন শ্রদ্ধেয় স্বনামধন্য শিক্ষাজীবী তথা প্রবীণ ও প্রাজ্ঞ কবিবরকে! অথচ আমরা বাংলার হারিয়ে যাওয়া সাবেকি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনের কতো বড়াই না করি! শ্রীশঙ্খ ঘোষ-দের মতো শ্রদ্ধেয় প্রাজ্ঞ মানুষদের অপমান করে কোন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনের বড়াই করা যায়?
প্রশ্ন আসলে এখানেই। কোনও রাজনৈতিক দলের জেলা স্তরের এক অর্বাচীন নেতা (নিন্দুকেরা বলেন মাফিয়া) যদি ‘বাংলার বিবেক’ বলে খ্যাত এক স্বীকৃত ও স্বনামধন্য অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে অপমান করার দুঃসাহস দেখিযেও তাঁর দলের কান্ডারির সামান্যতম নিন্দামন্দ না শুনতে হয় তো বাংলার রাজনৈতিক দুর্দশার আর কি বাকি থাকে তা আমাদের কারও জানা নেই। দলমত নির্বিশেষে বাংলার রাজনীতি থেকে শিষ্টাচার, শালীনতা, সহিষ্ণুতা এবং সন্মানীয় জনকে সন্মান করার বোধটুকুও আজ অনেকদিন উধাও!
অন্যদিকে যাঁরা ‘সোনার বাংলা’ গড়ে দেবেন বলে এই বাংলার আম-জনতাকে নির্বাচনের আগে আশ্বাস দিয়ে থাকেন এবং এখনও দিচ্ছেন, তাঁরাও কি বাংলার তো বটেই, দেশের গৌরব ও অহংকার বলে চিহ্নিত সন্মানীয় ব্যক্তিদের সন্মান জানাতে আদৌ প্রস্তুত? বাস্তব কি বলে? মোটেই নয়। শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণেই আন্তর্জাতিক স্তরের এক প্রবীণ ও প্রাজ্ঞ ভারতীয় অর্থনীতিবিদকে নানাভাবে লাগাতর অপমান ও মানসিকভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে। সেই অপমানের ভাষা কখনও-বা শালীনতার সীমা লঙ্ঘন করে যাচ্ছে!
ড. অমর্ত্য সেনের মতো মানুষের কাছ থেকে নোবেল পুরস্কার কেড়ে নেওয়ারও হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে! যাঁর মতো বড়ো মাপের ব্যক্তিত্বকে ওই সন্মান বা পুরস্কার প্রদান করা হলে সংশ্লিষ্ট পুরস্কার বা সন্মানের ওজনও যায় কয়েক গুণ বেড়ে, তাঁরই হাত থেকে ভারত সরকারের দেওয়া পুরস্কার বা সন্মান কেড়ে নেওয়ার মতো অশালীন কথা উচ্চারণ করা কতোটা ঔদ্ধত্যের বহিপ্রকাশ, তা কি ওই দলের মাথারা একবারও ভেবে দেখেছেন? কিম্বা ওই কথা বলার জন্য সামান্যতম তিরস্কারটুকু করছেন অর্বাচীন বক্তাদের?
উত্তরে বলতে হয়, না করেননি। সবাই জানেন, ওই দলের মাথারা সচেতনভাবেই নীরবতা পালন করেছেন অর্থাৎ চুপ ছিলেন এবং চুপ আছেন! চুপ থাকার কারণ? কারণ তাঁরাও চাইছিলেন ওই মানুষটিকে কিছুটা ‘টাইট’ দিতে। অপদস্থ করতে। যাতে ভবিষ্যতে সরকার-বিরোধিতার পথে না হাঁটেন। তাই তিরস্কার করার প্রয়োজনই মনে করেননি। আন্তর্জাতিক মানের প্রবীণ ও প্রাজ্ঞ অর্থনীতিবিদকে অপমান করার পিছনে দলের বড়োকর্তাদের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় ও সমর্থন ছিল বলেই হয়তো তিরস্কার করার দায় কাঁধে চাপেনি!
সবাই কমবেশি এও জানেন যে, ড. অমর্ত্য সেনের মতো বিশ্ব-বিখ্যাত মানুষের কাছ থেকে কোনও বিষয়ে সমর্থন, সমালোচনা কিম্বা বিরূপ মন্তব্য এলে তার আন্তর্জাতিক স্তরে গুরুত্ব কতোটা। গোটা বিশ্বই প্রায় প্রভাবিত হয় তাঁর যেকোনও কথায়। সুতরাং তাঁর সমর্থন কিম্বা সমালোচনার গুরুত্ব শাসকদলের মাথারা বুঝবেন না, তা কি কখনও হয়! আর হয়না বলেই তাঁর প্রতি শাসকদলের এতো ক্ষোভ বিদ্বেষ কিম্বা রাগ! তাঁর লেখায় কিম্বা সাক্ষাৎকারে তিনি বরাবরই বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসকদলের তীব্র সমালোচনা করে থাকেন।
অনেকে প্রায়ই বলে থাকেন, তাঁর মতো উঁচু মাপের মানুষের পক্ষে সরাসরি কোনও সরকারের বিরোধিতা করাটা ঠিক নয়। আপাতদৃষ্টিতে হয়তো কথাটা অনেকের কাছেই যথার্থ বলেই মনে হয়। সমাজের বা দেশের উঁচুস্তরের মানুষেরা সাধারণতঃ সরাসরি কোনও সরকারের সমর্থন কিম্বা বিরোধিতায় নিজেদেরকে এভাবে যুক্ত করেন না। কিন্তু পাশাপাশি একথাও তো ঠিক যে, সত্যকথা সহজভাবে উচ্চারণ করাটাই তো ঠিক। সত্য-মিথ্যে তো আর মানুষের উচ্চতা (পদ ও সন্মানের দিক থেকে) দিয়ে বিচার হয় না।
সম্প্রতি শান্তিনিকেতনে বসত জমি-বিবাদ নিয়ে সেখানকারই সন্মানীয় প্রাক্তনী ড. অমর্ত্য সেনের মতো ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যে অশালীন ও অরুচিকর আচরণ করা হচ্ছে তা কি কখনও কোনওভাবে কাম্য? বিশ্বভারতীর মতো ঐতিহ্যবাহী একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একজন উপাচার্যকে দিয়ে এমন দলীয় নোংরা নাটক করানোর কি মানে আছে? এতে মাননীয় উপাচার্য কিম্বা কেন্দ্রের সরকার বাহাদুর-কার মুখ পুড়ে যাচ্ছে, তা কি খেয়াল করছেন না কেউ! আজকের নেট-যুগের কল্যাণে গোটা নাটকটাই তো আবিশ্বে ছড়িয়ে যাচ্ছে!
এতে কার মুখই-বা উজ্জ্বল হচ্ছে? ভারত নামের এক সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী দেশের নাকি তার মাথায় বসে থাকা কোনও সরকারের? স্বনামধন্য রামমোহন-বিদ্যাসাগর -বিবেকানন্দ- শ্রীরামকৃষ্ণ-রবীন্দ্রনাথ-জগদীশচন্দ্র-গান্ধীজি-নেতাজি সুভাষচন্দ্র অধ্যুষিত এই দেশের এমন চূড়ান্ত নোংরামি দেখে আবিশ্বের মানুষ কি ধারণা করছেন এই দেশ সম্বন্ধে? ভাবতে অপার বিস্ময় লাগে, একবারও কি আমাদের মাথায় এলো না এসব সম্ভাব্য আশঙ্কার কথা? নাকি ‘লজ্জা-ভয়-সংশয়’ অতিক্রম করে আমরা ‘মহামানুষ’-এ উত্তীর্ণ হয়েছি!
এখন আম-জনতার প্রশ্ন হলো, আজকের রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতা বা মহাজনেরা নিজেদেরকে আর কতোটা নিচে নামিয়ে আনবেন? দেশকেই বা কতোটা লজ্জার মধ্যে ফেলবেন? রাজনীতি থেকে কি মূল্যবোধ বরাবরের জন্যেই উধাও হয়ে গেল? ন্যূনতম শালীনতা, রুচিবোধ কিম্বা সন্মানীয় ব্যক্তিদের সন্মান জানানো না হোক, অসন্মান করাটাই রেওয়াজ হয়ে গেল? এ কোন অন্ধকার সময়ের (পড়ুন দুঃসময়ের) মধ্য দিয়ে চলেছি আমরা? সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গেই কি আমাদের অসভ্যতার অন্ধকার ঘিরে ধরলো?
বলাবাহুল্য, তা মূল্যবোধহীন রাজনীতি ও তার ধারক-বাহক তথা দলমত নির্বিশেষে রাজনীতিকদেরই সৌজন্যে! রাজনীতির এমন কি অমোঘ শক্তি বা ক্ষমতা যা রাজনীতিকদের (বিশেষত দলের নানা মাপের নেতানেত্রীদের) ‘ধরাকে সরা জ্ঞান’ করতে শেখায়! পদ-খ্যাতি-স্বীকৃতি-মান-সন্মান নির্বিশেষে অন্যকে অসন্মান করতে ইন্ধন জোগায়? বিরোধিতাকে শত্রুতা হিসেবে গণ্য করতে শেখায়? নীতিহীন নীতিই কি গ্রাস করছে আজকের রাজনীতিকে? আজকের নতুন প্রজন্ম এসব নিয়ে কি আদৌ কোনও চিন্তাভাবনা করছে?