মরতে চান ভারতীয় হিসেবে

তাঁর বড় আশা একজন ভারতীয় হিসেবে মরা। এই আশা পূরণ হবে কিনা তা তিনি জানেন না।

Written by SNS Kolkata | October 21, 2019 2:27 pm

এনআরসি সেবা কেন্দ্রের বাইরে লোকেরা অপেক্ষা করছে। (Photo: IANS)

তাঁর বড় আশা একজন ভারতীয় হিসেবে মরা। এই আশা পূরণ হবে কিনা তা তিনি জানেন না। কিন্তু বড় কষ্ট, বড় বেদনার এই অনিশ্চয়তা। ঠাকুরের কাছে তাঁর প্রার্থনা : ‘তুমি দেখাে আমি যেন একজন ভারতীয় হিসেবে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারি’।

তিনি হলেন মালতীবালা দাস বয়স ৫২। অসমে কাছাড় জেলায় এক প্রত্যন্ত গ্রামে তাঁর বাড়ি। এতদিন অসমে বসবাসকারী হিসেবে ছিলেন ভারতীয় নাগরিক-এখন ‘সন্দেহজনক বিদেশি’দের তালিকায় তাঁর নাম উঠেছে। অসমে যে নাগরিকপঞ্জি তৈরি (এনআরসি) হয়েছে, তার ফলে নাগরিকত্ব হারিয়েছেন। এই মালতীবালার মতাে আরও হাজার হাজার মালতীবালার নাম চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জির তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। তাঁদের আবার কারাের নাম সন্দেহজনক বিদেশিদের তালিকায় স্থান পেয়েছে। মালতীবালা তাঁদের মধ্যে একজন। খবরে প্রকাশ এই মালতীবালার দুটি কিডনিই প্রায় অকেজো। সারাদিন প্রায় শুয়েই দিন কাটান। রােগযন্ত্রণায় কাতর সম্প্রতি তিনি শুনেছেন চূড়ান্ত নাগরিক তালিকায় তাঁর নাম নেই- আছে সন্দেহজনক বিদেশিদের তালিকায়। অর্থাৎ তাঁকে এখন আরও নথিপত্র ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়ে প্রমাণ করতে হবে তিনি বিদেশি নন। সন্দেহজনক কথাটা বাদ দেওয়া হবে তখনই। 

তাই ডাক পেলে শত রােগযন্ত্রণা সহ্য করেও স্বামী ও ছেলের সাহায্যে ট্রাইব্যুনালের সামনে তিনি হাজির হন নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য। ট্রাইব্যুনাল কর্তাদের তােলা নানা প্রশ্নের জবাবও দেন। কিন্তু এখনও জানেন না, ওই সন্দেহজনক বিদেশি বলে চিহ্নিত তাঁকে ভারতের নাগরিক হিসাবে গণ্য করা হবে কিনা। মালতী দেবী বলেছেন, তিনি রােগযন্ত্রণা নিয়েও ট্রাইব্যুনালে হাজির হচ্ছেন। কারণ তিনি যে বিদেশি এই তকমাটা তিনি মনে নিতে পারছেন না। 

মালতী যে বিদেশি নন, তার প্রমাণস্বরূপ তিনি ১৯৬৭ সালে উদ্বাস্তু হিসেবে রেশন পেতেন, তাঁর কাগজপত্র জমা দিয়েছেন। ১৯৭৫ সালে সরকার জমি দেয়, সে কাগজও তাঁর আছে এবং তাও জমা পড়েছে ট্রাইব্যুনালে। ১৯৬৫ সালের রিফিউজি রেজিস্ট্রেশন কার্ড রয়েছে। মালতীর স্বামীর নামের পাশে সন্দেহজনক বিদেশি কথাটি লেখা রয়েছে। এই অসহনীয় অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় খুঁজছেন তাঁরা। কারণ তাঁরা ভারতের নাগরিক- সেই নাগরিক হিসেবেই নানা সুযােগসুবিদে এতদিন পেয়ে আসছিলেন। 

দারিদ্রের মধ্যেই তাঁদের সংসার চলছিল। তবুও সংসারে শান্তি ছিল। কিন্তু এই বিদেশি তকমা তাঁদের শান্তিটুকও কেড়ে নিয়েছে। চিকিৎসকেরা বলেছেন, মালতীর অকেজো কিডনির দুটির প্রতিস্থাপন করতে হবে, নইলে নিয়মিত ডায়ালিসিস ছাড়া বাঁচার কোনও রাস্তা নেই। কিন্তু তাঁর জন্য যে বিপুল অর্থের প্রয়ােজন, তা তাঁদের নেই। 

সম্প্রতি অসমে নাগরিপঞ্জির যে চুড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হয়েছে তা থেকে ১৯ লক্ষ নাগরিকের নাম বাদ পড়েছে। তাঁদের মধ্যে একটি বড় অংশকে বিদেশি বলে সন্দেহের তালিকা রাখা হয়েছে। চূড়ান্ত তালিকা থেকে যারা বাদ পড়েছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছে প্রায় ৯ লক্ষ বাঙালি হিন্দু এবং প্রায় ৪ লক্ষ বাঙালি মুসলমান। এরা সবাই দীর্ঘদিন হল বাড়িঘর করে বিষয়সম্পত্তি নিয়ে অসমে বসবাস করছেন। নাগরিকত্ব প্রমাণের কাগজপত্র জমা দিলেও তাঁদের চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ রাখা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল এবং শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টে যদি তাঁরা নাগরিকত্ব প্রমাণে ব্যর্থ হন, তাহলে তাঁদের বিকল্প ব্যবস্থা কী? তাঁদের অন্য কোথাও ঠেলে দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশে তাে নয়ই। তাহলে? অসম সরকার কি তাঁদের ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠাবে? খবরে জানা যায় অসমের গােয়ালপাড়ায় কয়েক বিঘা জমির ওপর ওই ক্যাম্প তৈরি হওয়ার কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। যদি শেষ পর্যন্ত তাঁদের ওই ক্যাম্পেই পাঠানাে হয়, তাহলে কি তাঁরা বাকি জীবন এখানেই কাটাবেন? এই প্রশ্ন তাঁদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে। ওই ক্যাম্পে ৪০০০ নাগরিকত্ব হারাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। শােনা যায় আরও ক্যাম্প নাকি তৈরি হবে। 

তবে যে বিষয়টা নিয়ে ক্ষোভ সর্বত্র বিরাজ করছে তা হল চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জির তালিকা নাকি ভুলে ভরা। যাদের নাম নাগরিক হিসেবে উঠেছে, তাদের নাম, বয়স, পেশা ইত্যাদি সঠিকভাবে লেখা নেই। অসমের প্রায় সব রাজনৈতিক দল এই তালিকা নিয়ে আদৌ সন্তুষ্ট নয়। তাঁরা এই ভুলভ্রান্তি সংশােধনের দাবি জানিয়েছে। নাগরিকপঞ্জি নিয়ে অসমে একটা অস্থিরতা বিরাজ করছে। যদিও আটোসাঁটো নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য আইনশৃঙ্খলার এখনও অবনতি হয়নি। তবে নাগরিকত্ব হারাদের মধ্যে কেউ কেউ আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন।