মহম্মদ শাহাবুদ্দিন
নৃতত্ত্বের আলোকে ভারতের আদিবাসী মানুষকে নিয়ে গবেষণায় নিয়োজিত হবেন এই ভাবনা ভেরিয়ার এলুইনের কোনদিন ছিল না। মাত্র ২৫ বছর বয়সে এ্যাঙ্গলিকান ফ্রান্সিসকান মিশনারীর সেবামূলক কাজে যোগ দিয়ে এলুইন প্রথমে ভারতে আসেন। অক্সফোর্ডের পরিমণ্ডলে সাহিত্যচর্চা ছেড়ে মানবসেবাই তখন তাঁর জীবনের লক্ষ্য। যে ইংল্যান্ড তার ঔপনিবেশিক শাসন দণ্ড নিয়ে ভারতের মানুষের ওপর চেপে বসেছিল, সেই ইংল্যান্ডেরই কেন্ট শহরে তিনি জন্মেছিলেন ১৯০২ সালের ২৯ আগস্ট। পুনেতে মিশনারীর সদর দপ্তর থেকে কাজ শুরু করেছিলেন। এখানে সামাজিক কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ার সময় এলুইন গান্ধীজির অহিংস আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে পরিচিত হন। গান্ধীজির প্রভাব তাঁকে ভারতের মানুষের অনেক কাছাকাছি এনেছিল। এদেশের মানুষের দুর্দশার জন্য ইংরেজ শাসনের প্রতি তার ক্ষোভ জমা হয়। ১৯২৮-এ সাবরমতী আশ্রমে গান্ধীজির সান্নিধ্যে আসার পর তিনি এক মহতী জীবনবোধের মুখোমুখি হন। আদিবাসী মানুষের উন্নয়নের স্বপ্ন তাঁকে পেয়ে বসে। ভেরিরার এলুইন তাঁর আত্মজীবনী ‘দ্য ট্রাইবাল ওয়ার্লাড অফ ভেরিয়ার এলুইন গ্রন্থে লিখছেন—‘পাওয়া নয়, ভারতেকে কিছু দেওয়া, ভারতবাসীকে শাসন করা নয়, দরিদ্রতম মানুষের সেবা করা, যে দেশের উপর আমরা প্রভুত্ব করেছি আর যাকে দাবিয়ে রেখেছি, তার সঙ্গে ঐক্যস্থাপন—এই লক্ষ্য নিয়েই আমি এক্সফোর্ডের জীবনে ছেদ টেনে নানান প্রতিকূলতা মেনে নিয়ে এখানে জীবন অতিবাহিত করছি।’
ভেরিয়ার এলুইন মনে করতেন নৃতত্ত্ব হল মানুষের বিজ্ঞান। তা মানবগোষ্ঠী সম্পর্কে এক ধারণা এনে দেয়। নৃতত্ত্ব প্রাকইতিহাস, মানবদেহের আকৃতি, তার বিবর্তনের নানা দিককে তুলে ধরে। নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন আদিবাসী জীবনের শিকড়ের সন্ধানে। আদিবাসী মানুষের সঙ্গে অন্তরঙ্গ যোগাযোগের প্রথম প্রয়াস গড়ে তুলেছিলেন মধ্যপ্রদেশের বৈগা আর গোন্ড উপজাতিদের মধ্যে। ঘুরেছেন, জব্বলপুরের উপকণ্ঠে মান্ডলা জেলার জঙ্গলাকীর্ণ উপত্যকায়। বৈগা উপজাতির জীবনচর্চা নিয়ে ১৯৩৯ এ লিখেছিলেন ‘দ্য বৈগা’ গ্রন্থ। অক্সফোর্ড এই গবেষণার জন্য তাকে ‘ডক্টরেট অফ সায়েন্স’ সম্মানে ভূষিত করে। ভেরিয়ার এলুইন আন্তর্জাতিক মানের নৃতাত্ত্বিক হিসাবে স্বীকৃতি পান।
বৈগা উপজাতি মানুষের কষ্টকর কৃষি জীবনের বর্ণনা উঠে এসেছে তাঁর গবেষণায়। মাটি ফসল বৃষ্টি ছিল তাঁদের কাছে ঈশ্বরের দান। ফসলের ক্ষেত ছিল ধরিত্রী মাতার মতো। শস্যদায়িনী মাটতে হলকর্ষণ করে আদিবাসী মানুষ তাকে আঘাত দিতে চাইত না। মৃত্তিকার আরাধনা আর ফসল ফলানোর পরিশ্রম, এই নিয়েই ছিল বেগাদের জীবন। এলুইনের ‘লিভস ফ্রম দ্য জাঙ্গল’ মধ্যপ্রদেশের গোল্ড আদিবাসী মানুষের নৃতাত্ত্বিক অনুসন্ধান। নর্মদার তীর ধরে গোণ্ডদের জীবনের ছন্দকে খুঁজেছেন এলুইন। সাতপুরা বিন্ধ্যপর্বতের বনভূমির ছায়ায় দেখেছেন তাদের সরল জীবন যাপন। গোন্ডদের জীবনের ছোঁয়া পেতে রয়ে গিয়েছিলেন অমরকণ্টকের কাছে করঞ্জিয়া গ্রামে।
এলুইন এদেশের আদিবাসী মানুষকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে অনুসন্ধান করেছেন। যে সব জনজাতির মধ্যে প্রাচীন জীবনধারা অব্যাহত ছিল তাদের প্রতি তিনি প্রথম আগ্রহ দেখিয়েছেন। তাদের মধ্যেই দেখেছিলেন যৌথ জীবনের আদর্শকে। পেয়েছিলেন সমবায় জীবন প্রথার রীতিনীতি। এলুইনের মতে তাদের ঐতিহ্য ও পরম্পরা তাদের জীবনকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলেছিল। ওড়িশার কেওনঝড়ের জুরাং আদিবাসীদের কথা বিশদভাবে বলেছেন। এখানকার মানুষ বেড়া দিয়ে ঘেরা জমিতে বসবাসের ঘর তৈরি করতো। সব ঘরের মুখোমুখি দরজা। যেন সবার ঘর সবার জন্য। বাসগৃহের এই নির্মাণ কৌশল তাদের জীবন যাপনের আন্তরিক সম্পর্ককে স্পষ্ট করে। প্রকৃতির কোলে প্রকৃতির রসদে এদের জীবন কাটে। গোদাবরী নর্মদা মহানদী সুবর্ণরেখার তীরে এমনই তাদের জীবনধারা। দলবদ্ধ জীবনেই ছোট বড় সংসার, তাদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম স্বপ্ন। এর মধ্যেই উৎসব আর গান। গোধূলির অবসানে শুক্লপক্ষের আলো আঁধারীতে নৃত্যের তালে বেজে উঠতো ঢোল মৃদঙ্গের শব্দ। নিবিড় রাত্রির অন্ধকারে বসত তাদের আনন্দের হাট। সমতলের আদিবাসী মানুষের সমস্যা আরও জটিল হতে দেখেছেন তিনি। নগরায়ণের প্রভাব এসে কোনঠাসা করে দিচ্ছিল তাদের। ধূলো ধোঁয়া বাঁধানো রাস্তা পাল্টে ফেলছিল তাদের জীবনের গতিকে। প্রকৃতির ওপরও এসে পড়ছিল এর প্রভাব। জঙ্গল পাহাড় মালভূমির অর্ধেকটা ভারতে দেখেছিলেন অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা আদিবাসী জনজাতিকে। এই মানুষের সংখ্যা তখন আড়াই কোটিরও বেশি। মধ্য ভারতের ভূগোল পেরিয়ে এলুইনের দৃষ্টি পৌঁছেছিল উত্তর-পূর্ব ভারতে। ‘দ্য আবওরিজিনালস’-এ এলুইন লিখেছেন আসাম মণিপুরের নাগা জীবনের কষ্টের কাহিনি। সেই সৈন্য সাজের নাগা মানুষদের আর দেখা যেত না। দারিদ্র আর মহামারী তাদের সারা বছরের সঙ্গী। শীত থেকে বর্ষা পরণে একই পোশাক। বর্ষায় ভেজা পোশাক রোদ উঠলে তবে শুকাতো। পাহাড়ের গায়ে দম বন্ধ করা ছোট ঘর। পুষ্টিহীন অনেকেরই শরীরে বাসা বাঁধে ক্ষয়রোগ। সীমান্ত অঞ্চলের উপজাতি মানুষকে নিয়ে গবেষণার জন্য শিলং-এ এলুইন স্থাপন করেছিলেন তথ্যসংগ্রহ কেন্দ্র। ‘এ ফিলজফি ফর নেফা’ এবং ‘রিপোর্ট অফ দি শিডিউল্ড ট্রাইবস কমিশন’—এ দুখানি গ্রন্থ ভারতের উপজাতি সমস্যা নিয়ে এক গুরুত্ববহ পথ নির্দেশ দিয়েছে।
ভেরিয়ার এলুইনের পড়াশোনা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় নৃবিজ্ঞান কখনও বিষয় ছিল না। সাহিত্য ও থিওলজি নিয়েই তাঁর বিদ্যা চর্চা। সাহিত্য ও দর্শনে তাঁকে প্রভাবিত করেছিল ইয়েটস, সুইনবান, টিএস ইলিয়ট ওয়ার্ডস ওয়ার্থের চিন্তা। পরে কাছে পেয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী রবীন্দ্রনাথকে। এদের আদর্শে অনুপ্রাণিত এলুইন নৃবিজ্ঞানের মধ্যে খুঁজেছিলেন মানবসত্তাকে। মিশনারীর একনিষ্ঠ সেবক হওয়া সত্ত্বেও সেখান থেকে নিজেকে সরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। আদিবাসী মানুষের প্রাচীন বিশ্বাসের পরিবর্তে মিশনারীরা সেখানে ধর্মান্তরীকরণের উদ্যোগ নেয়। ভেরিয়ার এলুইন এর বিরুদ্ধাচরণ করেন। মানুষের দুরাবস্থার জন্য তিনি পরাধীনতাকেই দায়ী করতেন। এতে ইংরেজের সঙ্গে তাঁর দূরত্বও তৈরি হয়। ইংল্যান্ড থেকে দ্বিতীয়বার ভারতে আসার সময় ইংরেজ সরকার তাঁর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে চেয়েছিলেন। আদিবাসী মানুষের জীবনে এলুইন আনতে চেয়েছিলেন মুক্ত ভাবনা, মুক্তির স্বাদ। তিনি এইসব পিছিয়ে থাকা মানুষের নিজস্ব সমাজ কাঠামোকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন। চেয়েছিলেন তাদের জন্য সংরক্ষিত অঞ্চল গড়ে তুলতে উপমহাদেশের আদিবাসী জীবন তাঁর কাছে হয়ে উঠেছিল নিজস্ব জগৎ।
এলুইন মনে করেন ভারতের আদিবাসীরা এদেশের ভূমিজ সন্তান। প্রস্তর সভ্যতার প্রথম পর্ব শুরু হয়েছিল তাদেরই হাতে। এলুইনের আক্ষেপ, এই জনজাতির যে অতীত আছে, তাদের সংস্কৃতির উত্থান পতন আছে, সে সম্পর্কে সভ্য মানুষের ধারণা পরিষ্কার নয়। আদি জনজাতি তাদের লোকজীবনের ধারা, নিজস্ব ভাষা ক্রমশ হারিয়ে ফেলছে। জনগণনায় তারা রয়ে গেছে শুধু পরিসংখ্যান হিসেবে। ‘দ্য অ্যাবওরিজিনালস’ এই ছোট বইতে ভেরিয়ার এলুইন আদিবাসী মানুষের শ্রেণিবিন্যাস, তাদের সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থার পরিচয় দিয়েছেন। মহারাষ্ট্রের উপকূল ভাগ ঘন সংবদ্ধ পাহাড় থেকে দক্ষিণের নীলগিরি, নাল্লামালাই, মধ্যভারতের বিন্ধ্য সাতপুরা পেরিয়ে ছোটনাগপুরের মালভূমিতে এলুইন দেখেছিলেন অগণ্য আদিবাসী মানব সমাজকে।
মানুষ জীবন হারিয়ে জীবন খোঁজে, মানুষকে হারিয়ে হারানো মানুষ খোঁজে। তেমনিই মানুষ তার প্রাচীন ঐতিহ্য হারিয়ে গেলে খোঁজে তার অতীত জীবনধারা, ভাষা সংস্কৃতিকে। ভেরিয়ার এলুইন একজন ভিনদেশী মানুষ। ভারতবর্ষকে ভালবেসে এদেশের আদিবাসী জনজাতিকে আপন করে তাদের সমস্যাকে আপন করে নিয়েছিলেন এই মানবপ্রেমী মানুষটি। দরিদ্র কুটিরে আদিবাসী মানুষের কথা বুঝতে বুঝতে তাদের হৃদয়ের ভাষাও বুঝতে চাইতেন। সেই সব মানুষের ভাষার লিখিত রূপ ছিল না। প্রচলিত গান লোকগাথার সবই ছিল মুখে মুখে। এলুইন তাদের লোক কবিতাকে লিখে রেখেছেন ডায়েরির পাতায়। সেখানে পেয়েছি প্রকৃতির কথা, বর্ষা বৃষ্টির কথা। সেখানে আছে ফসল তোলার গান আবার অনাবৃষ্টি অনাহারের কথা। তাদের গানে জায়গা করে নিয়েছে দুর্ভিক্ষের কষ্ট, আবার কখনও গানের অন্তরে মিশে আছে উৎসব পার্বন কিংবা বিয়ের গান। এই লোক সম্পদকে এলুইন আজীবন চেয়েছিলেন সভ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে, আর হাজার মাইল দূরে ইংল্যান্ড থেকে এসে এদেশের উপজাতি মানুষকে আপন করে ভালোবেসে তাদের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন মানবতার বার্তা।