• facebook
  • twitter
Sunday, 28 December, 2025

সার্ধশতবর্ষে আরএসএসের দৃষ্টিতে বন্দেমাতরম

এই পরিস্থিতিতে নেহরু, মাওলানা আজাদ প্রমুখ নেতারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতামত জানতে চান। সুভাষচন্দ্র বসুও রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখে তাঁর মত জানতে চান।

ফাইল চিত্র

নোটন কর

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচিত ‘বন্দেমাতরম’ গানের সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষে দেশের রাজনৈতিক পরিসরে নতুন করে বিতর্ক উসকে দিলেন প্রধানমন্ত্রী। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে তিনি বলেন, কংগ্রেস জমানায় বন্দেমাতরম গানের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি স্তবক বাদ দেওয়া হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর দাবি, ১৯৩৭ সালে এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়েই দেশভাগের বীজ বপন হয়েছিল এবং সেই বিভাজনমূলক মানসিকতা আজও দেশের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাঁর এই মন্তব্যের পরেই রাজনৈতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়।

Advertisement

প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগের পাল্টা জবাব দিয়েছে কংগ্রেস। কংগ্রেস নেতৃত্বের বক্তব্য, আরএসএস কখনও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয়নি। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৫২ বছর তারা জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেনি। কংগ্রেসের দাবি, বিজেপি ও আরএসএস সংবিধান আক্রমণ করেছে, মহাত্মা গান্ধী এবং বাবাসাহেব আম্বেদকরের কুশপুতুল পোড়ানো হয়েছে, গান্ধীজির হত্যার সঙ্গে যুক্ত শক্তিকে আড়াল করা হয়েছে এবং আরএসএস স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ব্রিটিশদের পক্ষ নিয়েছিল। বন্দেমাতরমের দেড়শো বছর পূর্তিকে কেন্দ্র করে এই রাজনৈতিক তরজা নতুন করে দেশের ইতিহাস, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের প্রশ্নকে সামনে এনে দিয়েছে।

Advertisement

‘বন্দেমাতরম’ গানটির রচনাকাল ১৮৭৫ সাল। পরে ১৮৮২ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস প্রকাশিত হলে সেখানে এই গানটি উপন্যাসের মূল ভাবনা ও দর্শনের প্রতীক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। সেই নিরিখে বন্দেমাতরম গানের বয়স এখন দেড়শো বছর। ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের পটভূমি আঠারো শতকের শেষ ভাগ, যখন বাংলা একদিকে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে, অন্যদিকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শোষণে বিপর্যস্ত। ১৭৭০ সালের ছিয়াত্তরের মন্বন্তর এবং সন্ন্যাসী বিদ্রোহই ছিল উপন্যাসের মূল প্রেক্ষাপট। এই উপন্যাসে স্বদেশপ্রেম, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ, ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ এবং মাতৃভূমির মুক্তির জন্য আত্মত্যাগের গৌরবময় চিত্র তুলে ধরা হয়।

‘আনন্দমঠ’-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘সন্তান দল’। এই সন্তান দল আসলে সন্ন্যাসী ও ফকিরদের নিয়ে গঠিত একটি গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠন, যারা ব্রিটিশ শাসন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অর্থনৈতিক শোষণ, অত্যধিক কর আরোপ এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ গড়ে তুলেছিল। ইতিহাসে এই আন্দোলন ‘ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, এটি ছিল ভারতের প্রথম দিকের বড় ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনগুলির একটি। এই বিদ্রোহে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে এই ঐক্যবদ্ধ রূপটি পূর্ণমাত্রায় প্রতিফলিত হয়নি, বরং সেখানে হিন্দু ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

‘আনন্দমঠ’ প্রকাশের পর থেকেই বন্দেমাতরম গানটি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে এই গান ও ধ্বনি হয়ে ওঠে উদ্দীপনার উৎস। তবে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর রচনায় হিন্দু ধর্মীয় চেতনা ও প্রতীককে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। বন্দেমাতরম গানে ভারতকে মা হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে এবং সেই মাতৃরূপ দেবী দুর্গা বা দেবী লক্ষ্মীর প্রতীকে রূপ পেয়েছে। এই ধর্মীয় রূপকই পরবর্তী সময়ে গানটি নিয়ে বিতর্কের অন্যতম মূল কারণ হয়ে ওঠে।

এই বিতর্ক বোঝার জন্য উনিশ শতকের বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে তাকানো জরুরি। ১৭৫৭ সালে পলাশি যুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে বাংলার ক্ষমতা চলে যায়। ১৭৬৩ সালে বাংলা, বিহার ও ওড়িশার দেওয়ানি লাভ এবং ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের ফলে বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো আমূল বদলে যায়। এক নতুন জমিদার শ্রেণির উত্থান ঘটে, যাদের বড় অংশ ছিলেন বাঙালি হিন্দু। ব্রিটিশ শাসকের সঙ্গে এই জমিদারদের সখ্যতা থেকেই গড়ে ওঠে নতুন মধ্য ও উচ্চবিত্ত শ্রেণি। বহু ঐতিহাসিকের মতে, মুসলিম শাসনের অবসান ও ইংরেজ শাসনের সূচনাকে এই নব্য হিন্দু অভিজাত সমাজ স্বাগত জানিয়েছিল।

এই সামাজিক কাঠামোর মধ্যেই গড়ে ওঠে এক শক্তিশালী মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণি, যারা সাহিত্য ও সংস্কৃতির মাধ্যমে নিজেদের চিন্তাভাবনা ছড়িয়ে দেয়। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যাঁরা বাংলার নবজাগরণের পথিকৃৎ বলে পরিচিত, তাঁদের বড় অংশই ব্রিটিশ শাসনের শ্রেষ্ঠত্ব ও আধুনিকতার প্রশংসা করেছিলেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা চেয়েছিল, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুবিধাভোগী এই শ্রেণি রাজনৈতিক আনুগত্য দেবে এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তাদের আদর্শ প্রচার করবে। এই প্রেক্ষাপটেই সাহিত্যসম্রাট ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আবির্ভাব, যিনি প্রবল হিন্দু জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রধান তাত্ত্বিক হয়ে ওঠেন।

১৮৯৬ সালে জাতীয় কংগ্রেসের এক অধিবেশনে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বন্দেমাতরম গানটি পরিবেশন করেন। এরপর কংগ্রেসের কর্মী থেকে শুরু করে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের কর্মীরা এই গানটিকে নিজেদের সংগীত হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় বন্দেমাতরম ধ্বনি বাংলায় বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তবে একই সময়ে মুসলিম সমাজের একাংশের মধ্যে এই গান নিয়ে আপত্তি তৈরি হয়। কারণ গানটিতে ভারতের রূপ দেবীমূর্তি হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে, যা ইসলামের ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। পাশাপাশি ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে মুসলিম সমাজ ও তাদের রাজনৈতিক অবস্থানকে প্রান্তিকভাবে দেখানো হয়েছে বলেও অভিযোগ ওঠে।

এই বিতর্ক চরমে পৌঁছায় ১৯৩৭ সালে। অবিভক্ত ভারতে নির্বাচনের পর একাধিক প্রদেশে কংগ্রেস সরকার গঠিত হয়। বিধানসভায় বন্দেমাতরম গাওয়া হলে বহু মুসলিম সদস্য আপত্তি জানান। তাঁদের বক্তব্য ছিল, গানের পৌত্তলিক ভাব তাঁদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত করছে। কংগ্রেসের পক্ষে তখন এক কঠিন পরিস্থিতি তৈরি হয়। একদিকে বন্দেমাতরম ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতীক, অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে মুসলিম আপত্তিকে উপেক্ষা করাও সম্ভব ছিল না।

এই পরিস্থিতিতে নেহরু, মাওলানা আজাদ প্রমুখ নেতারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতামত জানতে চান। সুভাষচন্দ্র বসুও রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখে তাঁর মত জানতে চান। রবীন্দ্রনাথ স্পষ্টভাবে জানান, বন্দেমাতরমের প্রথম দুটি স্তবক গাওয়া যথেষ্ট। তাঁর মতে, দেশকে দেবী হিসেবে কল্পনা করা মুসলিমদের অনুভূতিতে আঘাত করতে পারে এবং রাষ্ট্রীয় পরিসরে এমন গান সর্বজনীন হতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ লিখিতভাবে বলেন, আনন্দমঠ সাহিত্য হিসেবে মূল্যবান, কিন্তু রাষ্ট্রসভায় সকল ধর্মের মিলনক্ষেত্রে এই গানের সব স্তবক সংগত নয়।

রবীন্দ্রনাথের মতামতের ভিত্তিতেই ১৯৩৭ সালের ২৬ অক্টোবর কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি সিদ্ধান্ত নেয়, বিধানসভা ও জাতীয় সভাসমিতিতে বন্দেমাতরমের প্রথম দুটি স্তবক গাওয়া হবে। স্বাধীনতার পর ২৪ জানুয়ারি ১৯৫০ সালে গণ পরিষদের শেষ অধিবেশনে রাজেন্দ্র প্রসাদ ঘোষণা করেন, রবীন্দ্রনাথের ‘জনগণমন’ হবে জাতীয় সংগীত এবং বন্দেমাতরমের প্রথম দুটি স্তবক জাতীয় স্তোত্র হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।

তবুও আজ বন্দেমাতরমকে ঘিরে নতুন করে বিতর্ক উসকে দেওয়া হচ্ছে। বিজেপি ও আরএসএস নেতৃত্বের একাংশ জাতীয় সংগীত হিসেবে জনগণমনের বদলে বন্দেমাতরমকে সামনে আনার দাবি তুলছে। আরএসএস প্রধান সম্প্রতি কলকাতায় এসে প্রকাশ্যে এই মত পোষণ করেছেন। একই সঙ্গে বিজেপি শাসিত কয়েকটি রাজ্যে রবীন্দ্রনাথের লেখা পাঠ্যক্রম থেকে বাদ পড়ার অভিযোগ উঠেছে। সমালোচকদের মতে, বন্দেমাতরম গানটি বিজেপি ও আরএসএস-এর সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে সহজেই মিলে যায় বলেই এই বিতর্ক নতুন করে উসকে দেওয়া হচ্ছে।

অনেক বিশ্লেষকের মত, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী, নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু ও মাওলানা আজাদ বন্দেমাতরমের পরবর্তী স্তবকগুলি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন দেশভাগের বীজ বপনের জন্য নয়, বরং বিভাজনের সম্ভাবনা দূর করে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে শক্তিশালী করার জন্য। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য রক্ষা করাই ছিল তাঁদের লক্ষ্য। আজ বন্দেমাতরমের সার্ধশতবর্ষে দাঁড়িয়ে সেই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তকেই নতুন করে প্রশ্নের মুখে ফেলা হচ্ছে, যা দেশের রাজনীতিতে আবারও গভীর মেরুকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

Advertisement