২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে কলকাতা পুরসভা একটি ঘোষণায় তিলোত্তমার নাগরিকদের শুনিয়েছে সারা শহরে সব দোকানপাট বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড ইংরেজিতে লেখা হয়েছে, তা পরিবর্তন করে বাংলায় লিখতে হবে— পাশে ছোট করে ইংরেজি বা হিন্দিতে লেখা যেতে পারে অবাঙালিদের জানার জন্য! ঘোষণাটিকে আমরা সাধুবাদ জানাই, তবে সেই সঙ্গে সন্দেহের ঊর্ধ্বে ওঠা যাচ্ছে না যে আদৌ কি তা কার্যকরী হবে, নাকি ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। কারণ কলকাতা পুরসভা অতীতে অনেক সিদ্ধান্তই নিয়েছে, তা কার্যকরী করা হয়নি— সুতরাং সারা শহরের বিপণিগুলির সাইনবোর্ড বাংলায় লেখা সত্যিই যদি বাস্তবে দেখা যায়, তাহলে এই কাজের জন্য পুরসভাকে বাহবা না জানিয়ে কোনও উপায় নেই। কারণ অতীতে অনেক সিদ্ধান্ত কার্যকরী হওয়া থেকে শুধু কথা বা ঘোষণায় তা সীমাবদ্ধ থেকেছে। পুরসভা এই ঘোষণাও নিছক আবেগের বশে করল কিনা কে বলবে?
রাজ্যে এবারও একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহিদের আন্দোলনের স্মরণে অনেক সভা-সমিতি হয়েছে। মাতৃভাষার ব্যবহার সরকারি কাজে আরও বেশি করে করার জন্য দাবি জানানো হয়। প্রতি বছরই শহরের বহু মানুষ এবং বিশিষ্টজনরা এখানে এসে শহিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। এবার সেই কার্জন পার্কের যে ছবি আমরা দেখলাম, তার জন্য বিস্ময় এবং দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া উপায় নেই। সেই শহিদ স্মারক স্তম্ভ ভেঙে ফেলা হয়েছে। চারদিকে নোংরায় ভরা। কার্জন পার্কের এই দশা দেখে সবাই পুরসভাকে দায়ী করেন। এই পার্কের এবং শহিদ স্মারক স্তম্ভ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কলকাতা পুরসভার। শহিদ দিবস উপলক্ষে এই পার্কের জীর্ণ দশা দেখে সবাই অবাক!
সুতরাং যে প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ পুরসভার ওপর শহরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব যে পুরসভা, শহরের সৌন্দর্য বর্দ্ধনের দায়িত্বে নিয়োজিত, সেই পুরসভার পক্ষে এই বিরাট শহরের দোকানপাটের সাইনবোর্ডগুলির নাম বাংলায় রূপান্তরিত করার কাজ অত্যন্ত দুরূহ। তবু পুরসভা কর্তৃপক্ষ যখন ঘোষণাটি করেছে, শহরবাসীর কিছুদিন দেখতেই হবে কাজটিতে হাত লাগানো হয় কিনা। প্রসঙ্গত বলা যায়, বেশ কয়েক বছর আগে এই শহিদ দিবসের একটি অনুষ্ঠানে খ্যাতনামা সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন যেসব দোকানের, ব্যবসায়ী এবং কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের নাম ইংরেজিতে সাইনবোর্ড লিখেছে, তাদের তা বাংলায় রূপান্তরিত করতে হবে। এর জন তাঁরা সারা শহরে একটি অভিযানে নামবেন বলে ঘোষণা করেছিলেন। সুনীলবাবুরা এই অভিযানে নেমেওছিলেন, কিন্তু তাঁদের অনুরোধে কেউ সাড়া দেয়নি। ইংরেজিতে লেখা সাইনবোর্ড কেউ পাল্টায়নি। তারপর আবার বাংলায় সাইনবোর্ড লেখার কথা ঘোষণা করা হল।
কলকাতা পুরসভা একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং আইনও পাশ করেছে যে প্রকাশ্য রাস্তায় কেউ থুথু ফেললে তাদের জরিমানা করা হবে। কয়েক বছর আগেই পুরসভার স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্তা প্রকাশ্য রাস্তায় থুথু ফেলার বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর কথা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু কোনও অভিযান চালানো হয়নি। এবার তো আইনই পাশ হয়েছে থুথু ফেলার বিরুদ্ধে। কিন্তু শহরবাসী কি এ পর্যন্ত কোনওদিন দেখতে পেয়েছেন পুরসভা থুথু ফেলার বিরুদ্ধে কোনও অভিযান চালাতে? ভবিষ্যতে চালানো হবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তাহলে আইন পাশ করে লাভ কী— যদি তা কার্যকর করাই না হয়।
শহরের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরলে দেখা যাবে যে সব বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং টানানো হয়েছিল, কয়েক বছর আগে তা এখনও রয়েছে। বর্ষার জল পড়ে তার কদর্য চেহারা হয়েছে যা শহরের সৌন্দর্য নষ্ট করেছে। কিন্তু হোর্ডিংগুলি খুলি ফেলার দায়িত্ব কার? কলকাতা পুরসভা এবং কলকাতা পুলিশের। কিন্তু এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে পুরসভা দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে দোষ চাপায় কলকাতা পুলিশের ওপর। আবার কলকাতা পুলিশ দোষ চাপায় পুরসভার ঘাড়ে। সারা শহরময় পুরনো হোর্ডিং এবং ছেড়া ব্যানারে ভরা। এর ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকা একটি কদর্য রূপ নিয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছিল শহরে যে গাছ রয়েছে, তার গায়ে কেউ বিজ্ঞাপন লাগাতে পারবে না, পারবে না পেরেক পুঁততে। কিন্তু কেউ কি দেখে? পুরসভা শুধু বলে, কাজে দেখায় না।
শহরে এবং শহরসংলগ্ন স্থানে ঘটছে আবার আর এক বিপদ। বেশ কয়েকটি চার-পাঁচতলা আবাসন একে অপরের গায়ে হেলে পড়েছে। দু-একটি বাড়ি পুরসভা ভেঙেও ফেলেছে। নিম্নমানের মশলা দিয়ে এইসব আবাসন নির্মাণের ফলে কয়েকদিনের মধ্যেই তা ভেঙে পড়ার দশা। নিয়ম হল নির্মাণকালে প্ল্যান অনুযায়ী আবাসনগুলি নির্মাণ হচ্ছে কিনা, তা দেখা পুরসভার ইঞ্জিনিয়ারদের দায়দায়িত্ব। কিন্তু এ কাজে গাফিলতির অভিযোগ জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে আবাসিকরা। কিন্তু যেসব চার-পাঁচতলা বাড়ি হেলে পড়েছে, তা ভাঙা হল না— তা একদিন ভেঙে পড়বেই এবং বিপর্যয়ের সৃষ্টি হবে। এই সব আবাসনের আবাসিকদের প্রশ্ন, তাঁরা এখন কোথায় যাবেন? ‘আমরা তো বহু অর্থ ব্যয়ে ফ্ল্যাট কনেছি।’ এছাড়া তো শহরের পুরনো বাড়ির সমস্যা রয়েছেই। বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি দিলীপ ঘোষকে যখন এই হেলে পড়া বাড়ির কথা জিজ্ঞাসা করা হল, তখন তিনি বললেন, এই সরকারই হেলে পড়েছে— তাই বাড়িও হেলে পড়েছে।’