সুব্রত রায়
সিনেমা দেখে কি ইতিহাস শেখা যায়? এরকম একটি অমোঘ প্রশ্নের মুখোমুখি আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে যে সিনেমাটি তা অবশ্যই ‘বেঙ্গল ফাইলস’। ছবির পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী। অনেকে বলবেন এই ছবিতে যেভাবে ইতিহাসকে চিত্রিত করা হয়েছে তা একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের প্রপাগান্ডা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই ভাবনা কিছু বেসিক প্রশ্ন উসকে দিয়েছে। ইতিহাস মানে তো আমরা বুঝি সন তারিখের হিসাব আর জন্ম মৃত্যুর ইতিবৃত্ত। কিন্তু ইতিহাস এর প্রভাব আরো গভীর আর সুদূরপ্রসারী।ইতিহাস আর ইতিবৃত্ত তো এক নয়। কিন্তু ‘বেঙ্গল ফাইলস’ এ যেভাবে ইতিহাসকে দেখানো হয়েছে সেখানে তো ইতিহাসের অন্তর্জলি যাত্রা দেখানো হয়েছে, কখনো কখনো চলচিত্রেরও। কিন্তু তাও তিনি সাহস করে তো তা দেখিয়েছেন। এখান থেকেই দর্শক বুঝে নেবে এই ছবি তাঁরা দেখবেন কি দেখবেন না। সেখানে প্রশাসনের আগ বাড়িয়ে এই ছবি নিষিদ্ধ করে আসলে ছবিটির প্রতি মানুষের আগ্রহ বহুগুণ বেড়ে গেল,যেমন করে নিষিদ্ধ বই, চিত্রকলা আর যা যা রাষ্ট্র নিষিদ্ধ করে তার প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়ে যায় দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ ছবির টিম যেমনটি আশঙ্কা করেছিল, তেমনটিই ঘটল। বাংলার সিনেমা হলে ব্রাত্য হল দ্য বেঙ্গল ফাইলস।
Advertisement
পরিচালর বিবেক অগ্নিহোত্রীর এই ছবি নিয়ে বহুদিন ঘরেই বিতর্ক চলছিল। বিশেষ করে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের এক মন্তব্য সেই বিতর্কের বারুদে আগুন দিয়েছিল। যেখানে অভিনেতা বলেছিলেন, এই ছবির নাম ‘দ্য দিল্লি ফাইলস’ থেকে কেন দ্য বেঙ্গল ফাইলস হয়েছে, তার কাছে কোনও ধারণাই দেওয়া হয়নি। এমনকী, শাশ্বত জানিয়ে ছিলেন, তাঁর অভিনীত অংশ ছাড়া, পুরো ছবিটির গল্প সম্পর্কেও তাঁর কোনও ধারণা ছিল না। শাশ্বত এমন মন্তব্য করায়, তাঁকে ভীতু বলেও কটাক্ষ করেন বিবেক ও পল্লবী যোশী। আর এবার বাংলার সিনেমা হল মালিকদের ভয়ের কথা জানালেন পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী।
Advertisement
বিবেক সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘বাংলার বহু সিনেমা হলের মালিকদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগতভাবে কথা হয়েছে, তাঁরা জানিয়েছেন, বাংলা প্রশাসনের তরফ থেকে তাঁদের কাছে চাপ এসেছে, যাতে ছবিটি না দেখানো হয়। যদিও তাঁরা স্পষ্ট কারও বিরুদ্ধে মুখ খোলেননি।’ বিবেকের দাবি, ‘নিজেদের সম্পত্তি বাঁচাতেই সিনেমা হলের মালিকরা দ্য বেঙ্গল ফাইলস দেখাচ্ছেন না।’ বিবেক আরও জানিয়েছেন, বাংলার প্রশাসনের এমন আচরণের বিরুদ্ধে তিনি আইনি পথেও হাঁটবেন।
কয়েকদিন আগেই সোশাল মিডিয়ায় একটি ভিডিয়ো শেয়ার করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এই ছবির মুক্তি না আটকানোর অনুরোধ করেছিলেন বিবেক। এই ভিডিওতে মমতাকে বিবেক জানালেন, প্রথমত, ‘আপনি ভারতীয় সংবিধান শপথ নিয়েছেন। ভারতের প্রত্যেক নাগরিকের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত রাখারও শপথ নিয়েছেন। এই ছবি ইতিমধ্যেই সিবিএফসি (সেন্সর বোর্ড) থেকে পাস সার্টিফিকেট পেয়েছে, এই সিবিএফসি সাংবিধানিক সংগঠন। সুতরাং এই ছবি যাতে শান্তিপূর্ণভাবে মুক্তি পায়, তাঁর দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে।’ বিবেক এই ভিডিয়োতে আরও জানান, ভারতবর্ষ প্রথম থেকেই প্রতারিত। বহু বছর ধরে এই দেশের আত্মা, শিল্প, সাহিত্যকে বেঁধে রাখা হয়েছে। শাস্তি পেয়েছে গোটা দেশ। বিশেষ করে, ডিরেক্ট এক সেন প্ল্যান ও নোয়াখালিতে হিন্দু গণহত্যার মতো ঘটনা এই দেশকে বিভাজিত করেছে। এই ঘটনা না ঘটলে হয়তো দেশ ভাগ হত না। এই ঘটনা ভুলে গিয়েছে বহু মানুষ, হয়তো বা ধামাচাপা ওদেওয়া হয়েছে।
বিবেকের কথায়, ‘বাংলা শুধুই ব্যথার ইতিহাস বহন করে তা তো নয়, বাংলা সভ্যতার মুকুট। এই বাংলা এমন একটা প্রদেশ, যেখানে ভারতের নবজাগরণের শুরু। বাংলা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, সুভাষচন্দ্র বোস উঠে এসেছেন। এরাঁ সবাই বাংলার সন্তান। বাংলা গোটা দেশকে প্রাণ সঞ্চার করে। জাতীয়তাবাদের শিক্ষা দেয়। কিন্তু এটাও সত্যি, বাংলা এমন এক রাজ্য যা দু’বার বিভাজিত হয়েছে। একবার ১৯০৫ সালে, একবার ১৯৪৭ সালে। বাংলা যতটা আহুতি দিয়েছে, তা হয়তো আর কোনও রাজ্য দেয়নি। কিন্তু নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কি এই ইতিহাস সম্পর্কে অবগত?’ এমনকী, অভিনেত্রী পল্লবী যোশীও সম্প্রতি রাষ্ট্রপতিকেও এই বিষয়ে অবগত করেছেন।
শুধুমাত্র কলকাতা দাঙ্গা ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকার সৌজন্যে গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং হয়ে ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে বছরের পর বছর টিঁকে আছে। আপনি বলতেই পারেন কলকাতা আর অন্য কোনও জায়গা তো এক নয়। তাছাড়া তখন সেখানে মুসলিম লিগের রাজত্ব। তাছাড়াও, স্বাধীনতার শেষ লগ্নে বাংলা ভাগ হলে কলকাতা কোন দিকে যাবে তা নিয়ে উৎকন্ঠা যে হিন্দু মুসলমান দুতরফেই যথেষ্ট ছিল— তা নিয়ে আজ আর কোনও বিতর্ক নেই। শুধু রাজনৈতিক মহল নয়, কলকাতা নিয়ে দড়ি টানাটানিতে বিরাট ভূমিকা ছিল একাধিক শিল্প গোষ্ঠীর। বিড়লা ও অন্যান্য হিন্দু শিল্পপতিদের যেমন ছিল, তেমনি ছিল ইস্পাহানিদের মতো নব্যউত্থিত লিগপন্থী ব্যবসায়ীদেরও। ব্রিটিশ সরকারের কাছেও কলকাতা ছিল নানা কারণে মাথাব্যথার বিষয়। ৪৬ সালে একের পর এক গণবিদ্রোহের ঢেউ ব্রিটিশ সরকারের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। নৌবিদ্রোহ, রশিদ আলি হত্যা, ডাক ও তার ধর্মঘট, সব মিলিয়ে উত্তাল শহর কলকাতাকে হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা শাসকদের কাছে ছিল একান্ত প্রয়োজনীয়।
ফলে দাঙ্গা কোনও এক পক্ষের প্ররোচনায় হয়েছে এটা বলা যায় না। এটা ঠিক যে রাজ্যের প্রশাসনিক হেড, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন সোহরাওয়ার্দি। তাই অভিযোগের তীর মূলত তাঁর দিকে উঠবে এও অস্বাভাবিক নয়। উনি যে পুরোপুরি ধোয়া তুলসীপাতা নন, তাও সে সময়ের ঘটনাপঞ্জি বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে। কিন্তু একতরফা একজনকেই অপরাধী বলে সারাজীবন চিহ্নিত করা— এটা অনেকটাই উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের প্রচর। দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং-এও বিপুল ভূমিকা ছিল এই অতিরঞ্জিত প্রোপাগান্ডার।
এতকিছুর পরেও ‘বেঙ্গল ফাইলস’ এত প্রশ্ন তুলে দিতে পারতো না,যদি বাংলার বিখ্যাত চলচিত্রকাররা ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি পাশ কাটিয়ে যেতেন। ঋত্বিক কুমার ঘটক তাঁর ‘কোমল গান্ধার’, ছবির যে দৃশ্য ভৃগু ও অনসুয়া ইছামতির তীরে দাঁড়িয়ে বলছে ওই যে দূরে যে আলো জ্বলছে ওটা আমার দেশ, কিন্তু আজ ওখানে যেতে গেলে কাঁটাতারের বেড়া টপকাতে হয়। পাসপোর্ট লাগে। ওটা বিদেশে। কিন্তু কেন ভৃগুর বাবা মা ওই দেশ থেকে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিল,তার কোন সদুত্তর ছবিতে পাওয়া যায়না। অন্যদিকে ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিতে যখন নীতার বাবা বলেন ‘আই একুইস’। শংকর তখন তাঁর বাবাকে বলে, ‘কাকে? ‘তার উত্তরে শংকর এর বাবা বলেন, “কারেও না’। এখানেও ঋত্বিক কুমার ঘটক পুরো ইতিহাসকে তুলে ধরলেন না।এটা কি সচেতন ভাবে না এর পেছনে অন্য কোন কারন আছে। জানি না। তাই এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত চলচ্চিত্রের একজন ছাত্র হিসাবে এই প্রশ্নগুলোর অন্বেষণ চলবে।
Advertisement



