• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

ইউজিসি-র গেরুয়াকরণ

চেষ্টা হয়েছে কর্ণের মাতৃগর্ভের বাইরে জন্মের কারণ হিসাবে এই জিন প্রযুক্তি কিংবা ‘সারোগেট মাদারের’ ধারণাকে একইভাবে প্রতিষ্ঠা করার।

প্রতীকী চিত্র

তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর এদেশের শাসক দল বিজেপি এখন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের শতবর্ষপূর্তি পালন করছে। ফলে শাসক দল বিজেপি-র গোপন অ্যাজেন্ডা আজ আর গোপন থাকছে না। তাদের হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের যাবতীয় উদ্যোগ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, প্রতিফলিত হচ্ছে, শিক্ষা থেকে প্রশাসনের বিভিন্ন সংস্কারের মধ্যে দিয়ে। দেশের নির্বাচন কমিশনের মতো স্বশাসিত সংস্থাগুলি শাসকের নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হওয়ার কারণে যেমন হিন্দুত্বের গোপন অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়িত করার চেষ্টা হচ্ছে দেশজুড়ে, তৈরি করা হচ্ছে দেশের সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণার রাজনীতি। ঠিক একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) মতো স্বশাসিত সংস্থা নিয়ন্ত্রণের রাজনীতির যাঁতাকলে পড়ে দেশের উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন বিষয়ের সিলেবাস পরিবর্তনে উদ্যোগী হয়েছে। হিন্দুরাষ্ট্রের ধারণাকে ছলে বলে কৌশলে পাঠ্যসূচির মাধ্যমে সংক্রামিত করার লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নেমেছে গেরুয়া বাহিনী। আধুনিক রসায়নের পাঠ্যসূচিতে আয়ুর্বেদিক খাদ্যাভাসের চর্চা, কিংবা গণিত শাস্ত্র কিংবা পদার্থবিদ্যায় ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে বৈদিক যুগের কাল গণনার শিক্ষাসূচি, ঢুকছে সরস্বতী বন্দনার পাঠ। হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে সাভারকারের লেখা বই। যিনি গোটা স্বাধীনতা আন্দোলনে ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিবর্তে ব্রিটিশ শাসকদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। আজ পাঠ্যসূচি পরিবর্তনের নামে তাঁকেই নায়কের আসনে বসানোর চেষ্টা হচ্ছে।

আধুনিক ম্যানেজমেন্ট কিংবা বাণিজ্যের পাঠ্যক্রমে নিয়ে আসা হচ্ছে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রকে। এমনকি কর্পোরেট সোশাল রেসপন্সিবিলিটির সঙ্গে রাম রাজ্যের ধারণাকে দেশের ম্যানেজমেন্ট পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। গীতার উপদেশ কিংবা রামায়ণ এবং মহাভারতের শিক্ষা অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব রয়েছে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কূটনীতেতে। একইভাবে সাম্প্রতিক অতীতে চেষ্টা করা হয়েছে, রামায়ণের পুষ্পক রাথের ব্যবহারের সঙ্গে সেযুগের উড়ান প্রযুক্তির আবিষ্কারকে কিংবা মহাভারতে কর্ণের জন্মবৃত্তান্তের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সম্পর্ক। চেষ্টা হয়েছে কর্ণের মাতৃগর্ভের বাইরে জন্মের কারণ হিসাবে এই জিন প্রযুক্তি কিংবা ‘সারোগেট মাদারের’ ধারণাকে একইভাবে প্রতিষ্ঠা করার। চেষ্টা চলেছে বঙ্গোপসাগরের শ্রীলঙ্কা ও তামিলনাড়ুর মধ্যে হনুমান নির্মিত রামায়ণ যুগের রামসেতুর অস্তিত্ব প্রমাণ করার। অথচ ভূতাত্ত্বিক গবেষণায় ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে যে রামাসেতুর কোনও অস্তিত্বই সেভাবে ছিল না। সেই অঞ্চলের সমুদ্রবক্ষের নুড়ি পাথরের বিশেষ আকার, আকৃতি এবং বর্ণের বিজ্ঞান-সম্মত ব্যাখ্যাও পাওয়া গিয়েছে।

Advertisement

একইভাবে দেশেজুড়ে বিভিন্ন মসজিদের নিচে মন্দিরের কাঠামো লুকিয়ে আছে প্রমাণ করার জন্য আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়াকে নিয়ন্ত্রণের রাজনীতির হাতিয়ার করে একের পর এক যে ছদ্ম প্রমাণ দিয়ে দেশজুড়ে ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরি করা হচ্ছে। এই প্রেক্ষিতে পাঠ্যসূচির পরিবর্তন আনেকটা সেই আঙ্গিকেই তৈরি করা হচ্ছে দেশে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। হিন্দুরাষ্ট্রের প্রবক্তারা এদেশের ইতিহাসকে কেবলমাত্র হিন্দুদের ইতিহাস হিসাবে তুলে ধরে সেটাকেই সুকৌশলে ঢুকিয়ে দিতে চাইছেন দেশের শিক্ষার পাঠ্যসূচিতে। নতুন প্রজন্মের কাছে বিশ্বের আধুনিক জ্ঞানভাণ্ডার তুলে ধরা নয়, ভারতীয় জ্ঞানভাণ্ডারের মোড়কে ধর্মীয় ভাবনার অনুপ্রবেশ ঘটানোই তাঁদের লক্ষ্য। রাষ্ট্রীয় এই তৎপরতার মূল কারণ কেবল হিন্দুদের ইতিহাসকেই দেশীয় সাফল্যের জয়গাথা হিসাবে তুলে ধরা। ধর্মীয় বিভাজনের গৌরবগাথা বানিয়ে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রীয় চরিত্রের বিসর্জন ঘটিয়ে ধর্মীয় রাষ্ট্র গঠনের পথে হাঁটা। আর এখানেই তৈরি হয় বিজ্ঞানের সঙ্গে অপবিজ্ঞানের সংঘাত। যে অবিজ্ঞান ও কুসংস্কারের হাত থেকে রামমোহন, বিদ্যাসগরের মতো মানুষেরা বের করে এনেছিলেন দেশের মানুষকে, সেই কষ্টার্জিত অগ্রগতিকে আবার উল্টোদিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে গেরুয়া বাহিনী। ইতিহাস নিশ্চয়ই সেই ভুল করবে না।

Advertisement

Advertisement