• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

আরএসএস প্রচারক

নিজের সীমারেখা অতিক্রম করে নিজেকে একজন আরএসএস-এর প্রচারক বানিয়ে ফেলেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

শতবর্ষে পা রেখেছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস)। দিল্লিতে বাছাই করা শ্রোতাদের নিয়ে তিনদিনের সমারোহে বক্তব্য রেখেছেন আরএসএস বা সঙ্ঘপ্রধান মোহন ভাগবত। অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভেঙে রামমন্দির প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সারা দেশে দাঙ্গা ছড়িয়ে দিয়ে, আরএসএস প্রধান এবার মথুরা ও কাশী নিয়ে বিতর্ক উসকে দিয়েছেন। রামমন্দির ইস্যুকে সামনে র্খে ২০২১-এর ভোটে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে। এবার ২০২৬ সালে উগ্র হিন্দুত্ববাদী আরএসএস মথুরা ও কাশী বিতর্ক সামনে রেখে মোদী বাহিনীকে আবার ক্ষমতায় বসাতে চাইছে। যদিও মোহন ভাগবত কিছুদিন আগে বলেছিলেন, দেশের নেতৃত্ব পদে ৭৫ বছরের ঊর্ধ্বে কাউকে রাখা হবে না। অবশ্য সেকথা দু’দিন পরই পাল্টে ফেলেছিলেন আরএসএস প্রধান।

ভাগবতের দাবি, কাশী ও মথুরার দু’টি মসজিদকে ছেড়ে দিতে হবে মুসলিমদের, সেটাই নাকি হবে দেশের ‘সম্প্রীতি’র উৎস। অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর যে ঘটনা ছড়িয়ে পড়েছিল দেশজুড়ে , যার সঙ্গে আরএসএস প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল, যার রেশ এখনও দেশ বয়ে বেড়াচ্ছে সঙ্ঘ পরিবারের দৌলতে।

Advertisement

বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনার পর সংসদে একটি আইন পাশ করা হয়। যে আইনে ১৯৪৭ সালের আগে বিদ্যমান ধর্মীয় স্থাপনার চরিত্র বদল করা যাবে না বলা হয়। এই আইন অনুসারে মথুরা ও কাশী সহ সমস্ত ধর্মীয় স্থানের স্থিতাবস্থা বজায় রাখা বাধ্যতামূলক। সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িক শক্তির দাবি পরোয়া না করেই এই আইনি সুরক্ষার কথা বলা হয়। কিন্তু মোহন ভাগবতের এই দাবি আসলে সাম্প্রদায়িক উস্কানি ছড়ানো, মানুষের দৃষ্টি ঘোরানো এবং সমাজকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত করা। স্বাভাবিকভাবেই আরএসএস প্রধানের এই ভাষ্যের তীব্র নিন্দা করেছে দেশের গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি। আসলে এই বক্তব্য ভারতের সংবিধানের প্রতি আরএসএস-এর অবজ্ঞা এবং দেশের আইনকে সরাসরি লঙ্ঘনের ঔদ্ধত্য মাত্র।

Advertisement

বিজেপি সরকারের প্রতি বাড়তে থাকা জনরোষ ঢাকতে সচেতনভাবেই ভাগবত এর আগেও বারবার এই বিভাজনমূলক বক্তব্য রেখেছেন এবং এই রাজনীতিকে সামনে রেখেই একই কথা বলেছেন নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহরাও। আরএসএস এবং তার সহযোগী সংগঠনগুলির চিরাচরিত কৌশলই হলো যখন জনজীবনে অর্থনৈতিক সঙ্কট বেড়ে ওঠে, তখনই সাম্প্রদায়িক বিভাজন উস্কে দিয়ে মানুষের দৃষ্টি অন্য দিকে ঘোরানোর চেষ্টা। বর্তমানে আমেরিকার বাড়তি শুল্ক, দেশের দুর্বল অর্থনীতি, শ্রমিক-কৃষকদের উপর আক্রমণ বৃদ্ধি এবং নির্বাচনী কারচুপি ও প্রভাব খাটানোর একের পর এক প্রমামের ফলে সাধারণ মানুষ ক্রমশ বিজেপি সরকারের ব্যর্থতাগুলি স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছে। আর সেই কারণেই বিভাজনের উত্তেজনা তৈরি করতে চাইছে আরএসএস।

এ বছরের স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লা থেকে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণেও এমন ইঙ্গিতটাই পাওয়া গেল। স্বাধীন ভারত যাঁদের কাছে ঋণী, সেইসব মহান শহিদ ও অগণিত মানুষের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন না করে আত্মপ্রচার, দলীয় রাজনীতির প্রচার ও দেশের মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিকারী শক্তিগুলির পক্ষে প্রচার করলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। দেশের স্বাধীনতার ৭৯তম বছরের ভাষণে মোদী একটি ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রীর পরিবর্তে একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠনের প্রচারকের ভূমিকা পালন করলেন। স্বাধীনতা দিবসের মতো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় অনুষ্ঠানে মোদী যেভাবে আরএসএস-এর ভূয়সী প্রশংসা করলেন তা শুধু সবাইকে অবাক করেনি, বরং বলা যায় এক অশনি সংকেত বহন করে নিয়ে এসেছে। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে ঘটে যাওয়া বহু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার তদন্তে গঠিত সরকারি কমিশনগুলিও আরএসএস-এর ভূমিকা নিয়ে, তাদের কার্যকলার নিয়ে বারংবার প্রশ্ন তুলেছে।

যে আরএসএস-এর বিরুদ্ধে হিংসা ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোর অসংখ্য অভিযোগ, তাদের এভাবে মহিমান্বিত করার নেপথ্যে যে অন্য উদ্দেশ্য লুকিয়ে রয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। নিজের সীমারেখা অতিক্রম করে নিজেকে একজন আরএসএস-এর প্রচারক বানিয়ে ফেলেছেন নরেন্দ্র মোদী। ভারতের ঐক্য ও অখণ্ডতা রক্ষা যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, একথা নরেন্দ্র মোদীকে বুঝিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।

Advertisement