রম্যাঁ রলাঁ
পূর্ব প্রকাশিতর পর
Advertisement
কয়েকজন মহাপ্রাণ ব্যক্তির সাহচর্যে। ইহাদের মধ্যে ছিলেন স্প্রিটলী; তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য লুসার্নে গিয়াছিলাম; ছিলেন আইন্টাইন; ইনি ১৯১৫ সালের সেপ্টেম্বর তারিখে ভেবেতে আমার সহিত দেখা করিতে আসেন; আর ছিলেন আমার তখনকার দিনের প্রতিবেশী সিঙ্কিভিচ এবং শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কারের অ্যালফ্রেড এইচ ফ্রায়েড।
Advertisement
আফ্রিকার ফরাসী অধিকৃত গাবনের ল্যাম্বারিন নামক স্থানের একটি হাসপাতাল হইতে আলসেসের একজন বিখ্যাত মনীষী অ্যালবার্ট সোয়াইজার আমাকে ভ্রাতৃত্বের অভিনন্দন বাণী পাঠাইলেন (ইহাকে ফরাসীদের বেতনভূক নিগ্রোদের পাহারায় রাখা হইয়ািছিল। ভাগ্যের কি পরিহাস!) ইনি আমাকে লিখিলেন যে, ‘‘মনুষ্যের আবাসহীন অরণ্যের নির্জনতায় পর্যন্ত’ প্রবন্ধগুলির প্রতিধ্বনি গিয়াছে এবং ‘‘আমার ভাবধারা এই দুর্দিনে একটি পরম আশ্বাস ও সান্ত্বনার বস্তু… সংগ্রাম চালাইয়া যান, আমার হৃদয় আপনার সহিত রহিয়াছে যদিও বর্তমান অবস্থায় আপনাকে কার্যকরীভাবে সাহায্য করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’’ কিন্তু স্প্রিটলারের ‘প্রমেথুস্’ই ছিল তখনকার দিনের আমার সর্বশ্রেষ্ঠ সাথী। ইহা ছিল আমার নিকট পাহাড়ের বুক চিরিয়া বাহিরে আসার ঝরণার মত। আল্পস্ পাহাড়ের এই দুর্দম, দুঃসাহসী বীরের আত্মা যেভাবে আমার আকুল স্বাধীনতা পিপাসাকে মিটাইতে পারিত পৃথিবীতে আর কিছু তাহা পারিত না। যাহা হউক কয়েকমাস অন্তর্লোকে বাসের পর এই সকল মৈত্রীতীর্থে পুণ্যস্নান সারিয়া আমি আবার রণাঙ্গনে ফিরিয়া আসিলাম। কিন্তু সংগ্রামের তখন এক নূতন স্তর শুরু হইয়াছে। তখন আর জুর্নাল দ্য জেনেভ পত্রিকার লিখিবার প্রশ্নই উঠে না। উহা তখন শান্তির বিরুদ্ধে, পোপের বিরুদ্ধে, হল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে, ফোর্ড মিসনের বিরুদ্ধে অর্থাৎ এক কথায় যাহারাই যুদ্ধরত জাতিগুলির মধ্যে একটা আপোশের চেষ্টা করিতে চাহিতেছিলেন তাহাদের বিরুদ্ধে পাগলের মতো চীৎকার করিতেছিল। চার্লস বের্নার-এর ক্ষুদ্র পত্রিকা রেভু মাঁস্যুয়েল ছাড়া জেনেভাতে এমন একখানি সুইস পত্রিকা ছিল না যাহাতে আমি লিখিতে পারি। কিন্তু একজন ফরাসী সহকর্মী আমার জুটিয়া গেল। ইহার নাম আঁরি গিলবো। এই ফরাসী তরুণটির উৎসাহ ছিল অসীম। সংগ্রামের উত্তেজনায় তাহার নাসারন্ধ্র যেন সর্বতা বিস্ফারিত হইয়া থাকিত। ইনি ছিলেন এক মূর্তিমান সংগ্রাম। ১৯১৫ সালের জুন মাসের প্রারম্ভে তিনি পারি হইতে জেনেভায় আসেন এবং ১৯১৬ সালের জানুয়ারী মাসে দ্যম্যাঁ নামক পত্রিকা বাহির করেন। আমি ছিলাম ইহার ধর্মপিতা এবং অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক। সব সময়েই যে তাহার সহিত আমার মতের মিল হইত তাহা বলিতে পারি না। আমি যতটা চাহিতাম তাহার চেয়েও উগ্র ছিল এই পত্রিকার সুর।
জেনেভার কয়েক মাস থাকিবার পর লেনিন, রাডেক, ডিনোভিয়েভ প্রমুখ প্রবাসী রুশবিপ্লবীদের সহিত গিলবোর মিশিবার সৌভাগ্য হয়। ফলে তাহারা এই তরুণকে বিপ্লবের পথে টানিয়া লইয়া যান, যে পথে তখনও আমি পা দিই নাই। ইহা ছাড়া, আবেগ ও উত্তেজনার আতিশয্যে গিলবো এমন ভাষা ব্যবহার করিত, অথবা এমন সকল কাজ করিয়া বসিত যাহার ফলে যে আদর্শকে আমরা রক্ষা করিতেছিলাম তাহাই বিপন্ন হইয়া পড়িত।
যুদ্ধের মধ্যে শত্রুদের অপেক্ষা বন্ধুদের সহিতই আমার সংগ্রাম করিতে হইয়াছিল বেশি এবং আমার বিশ্বাস এ অভিজ্ঞতা অস্বাভাবিক নহে। গিলবো ও আমার মধ্যে কত পত্রালাপই না হইয়াছে। তথাপি আমার এই তরুণ বন্ধুটির নিষ্কলঙ্ক আদর্শনিষ্ঠা কঠোর আত্মাভিমান ও দুঃখব্রতী নিঃস্বার্থপরতা এবং দুঃসাহসী বীরত্বের পায়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি না দিয়া আমি পারি না। ফ্রান্সের জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রগুলি এই লোকটির বিরুদ্ধে যে কতখানি হীন কুৎসা প্রচার করিয়াছে তাহা কি বলিব (ইহার অদম্য মনোবলকে তাহারা এখনও ক্ষমা করিতে পারে নাই)। অবশেষে সুইস কর্তৃপক্ষ তাহাকে প্রথমে কারাগারে নিক্ষেপ করে ও পরে নির্বাসিত করে। তারপর ক্লেমাসোর উকিলেরা তাহাকে ধরিয়া মিথ্যা অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। (১৫ বৎসর পরে এই দণ্ডাজ্ঞার পরিবর্তন হয়)।
ব্যক্তিগত সাহস ও চিন্তাশীলতা ছাড়াও তাহার আর একটি গুণ ছিল। তিনি ছিলেন সংগঠনকার্যে পারদর্শী। তাহার সম্পাদনার দ্যম্যাঁ পত্রিকাখানি প্রথম বৎসরেই আলোচনায় ও তথ্যপ্রচারে একটি উচ্চস্তরের পত্রিকা বলিয়া পরিগমিত হয়।
(ক্রমশ)
Advertisement



