• facebook
  • twitter
Thursday, 20 March, 2025

প্রয়োজন যথাযথ নির্বাচনের

তাদের কোনও কাজের ভিত্তিতে কোনও দলকেই বিচার করা সঠিক নয় বলেই মনে করি। যাক সে কথা। এখন আমি বর্তমানে প্রশাসনের বালো কিছু সিদ্ধান্তের কথায়, যা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে।

প্রতীকী চিত্র

কবিতা মুখোপাধ্যায়

বর্তমান রাজ্য প্রশাসন বহু সমালোচিত, বিশেষত আরজি কর ঘটনার পর। ধর্ষণ, খুন, কাটমানি, থ্রেট কালচার, তোলাবাজি, পাচার— সবকিছু মিলিয়ে কান পাতা দায়। এর উপর রয়েছে দলের ছোটবড় সর্বস্তরের নেতা, সদস্যদের দলবিরোধী বক্তব্য, শৃঙ্খলাহীনতা। আর জেরেই সরকারের ভালো কাজগুলি পর্দার আড়ালে চলে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, উচ্চস্তরের বেশির ভাগ নেতাদের চেয়ে মাঝারি এবং তৃণমূল স্তরের নেতা-কর্মীদের অতিরিক্ত ‘লোভ’ পার্টি এবং প্রশাসনকে করে তুলেছে কলঙ্কিত। অবশ্য পার্টি সমর্থকদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে বেশ মজার কিছু অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে। এ বিষয়ে একটা মজার অভিজ্ঞতার কথা বলি। সময়টা ২০১১-র নির্বাচনের আগে। একটা বড় মিছিল চলেছে শহরের রাজপথ দিয়ে। মিছিলটি তৃণমূলের। মিছিলের নানা স্লোগানের মধ্যে অন্যতম প্রধান স্লোগান ‘বদলা নয়, বদল চাই…। এই স্লোগান মিছিলের অগ্রভাগের। আর সেই মিছিলেরই শেষভাগে তৃণমূলের পতাকা হাতে সমর্থকদের মধ্যে স্লোগান— ‘ভোট দেবেন কোনখানে, কাস্তে হাতুড়ির মাঝখানে’। এটাই হচ্ছে দলভারী করা পার্টি-সমর্থক।

সুতরাং তাদের কোনও কাজের ভিত্তিতে কোনও দলকেই বিচার করা সঠিক নয় বলেই মনে করি। যাক সে কথা। এখন আমি বর্তমানে প্রশাসনের বালো কিছু সিদ্ধান্তের কথায়, যা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। যেমন লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, সবুজসাথী, বিনামূল্যে রেশন। কিন্তু এই সমস্ত ভালো পরিকল্পনাগুলিকে বাস্তবায়নের সবচাইতে বড় অন্তরায় যথাযথ ক্ষেত্র সমীক্ষার। যদি সঠিক ক্ষেত্রে সুচিন্তিত ক্ষেত্র সমীক্ষা করে পরিকল্পনাগুলিকে রূপায়ণ করা হত, তবে প্রশাসনের কোষাগারের অনেক অর্থ যেমন বাঁচত এবং সেই অর্থে আরও বেশি তৃণমূল স্তরের সাধারণ মানুষকে পরিষেবা দেওয়া যেত।

প্রথমেই আসি, বিনামূল্যে রেশনে খাদ্যসামগ্রী বণ্টনের কথায়। ইংরেজিতে একটা কথা আছে ‘Lab to Land’ অর্থাৎ গবেষণাগারে যে তথ্য তৈরি হচ্ছে, তার সঠিক প্রয়োগ একেবারে তৃণমূলস্তরে। সরকারি বহু ভালো ভালো প্রকল্প সঠিক নজরদারির অভাবে সাফল্যের মুখ দেখছে না। বর্তমান সরকারের বেশ কিছু প্রকল্প ‘ভোটমুখি’ বলে বিরোধীরা দাগিয়ে দিলেও এগুলির প্রয়োজন অস্বীকার করার নয়। বিনামূল্যে রেশনে খাদ্য সরবরাহ বহু ‘আমলাশোল’ –এর ছবিকে অবশ্যই প্রতিহত করেছে, করছে এটা মানতেই হবে।

করোনার অতিমারীর সময় থেকে কেন্দ্র-রাজ্য উভয় সরকারই বিনামূল্যে রেশনের মাধ্যমে খাদ্য সরবরাহ করতে থাকে। করোনার প্রভাব মুক্ত হওয়ার পর কেন্দ্র রেশন দেওয়া বন্ধ করে, তবে রাজ্য সরকার এখনও বিনামূল্যে মাথাপিছু ৩ কেজি চাল এবং ৩ প্যাকেট আটা ‘দুয়ারে রেশন’-এর মাধ্যমে দিয়ে চলেছে। মাসে একবার এই রেশনের জন্য খুব সাধারণ মানুষ উন্মুখ হয়ে থাকে। কেননা এই রেশন তাঁদের বেঁচে থাকার রসদ জোগায়। আধার কার্ডের সংযোগের মাধ্যমে পরিবারের যে কোনও একজনের আঙুলের ছাপ নিয়ে রেশন দেওয়ার এই ব্যবস্থায় স্বচ্ছতার কোনও অভাব নেই। কিন্তু এখানেও থেকে যাচ্ছে কিছু প্রশ্ন যার জন্য প্রশাসন বা রেশন ডিলার কাউকেই সেভাবে দায়ী করা যায় না। কেননা করোনার সময় থেকেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলির কাছে এই বিনামূল্যের চাল-আটা হয়ে উঠেছে অর্থ উপার্জনের একটা মাধ্যম। এখানে বলতে গেলে জড়িত গ্রাহকদের অসাধুতা। যেটা পরিহার করতে পারলে সরকারি কোষাগারের অনেক টাকা বাঁচতে পারে।

বিষয়টা তুলে ধরার চেষ্টা করি। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলি যাদের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ নয়, তারা প্রথমাবধি রেশনের সরবরাহ করা চাল-আটা আধার সংযোগের মাধ্যমে তোলেন কিন্তু সেই চাল-আটা তাঁরা খান না। সেগুলিকে তাঁরা বিক্রি করে দেন। বিনামূল্যের চাল প্রথমে ১৫ টাকা, এখন ২৫ টাকা দরে বিক্রি হয়ে যায়। আর বিনামূল্যের এক প্যাকেট আটা ১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যাদের পরিবারে অনেক চালের দরকার কিন্তু বাজারে বিক্রি হওয়া চাল কেনার সমর্থ নেই তাঁরা এই ২৫ টাকা দরের চাল সংগ্রহ করেন। এছাড়া বহু দোকানও এই চাল কিনে, আরও বেশি দামে বিক্রি করে দেয়। যদি এই অসাধুতা প্রতিরোধ করা যায়, তবে সরকারের আর্থিক দায় যেমন লাঘব হতে পারে, পাশাপাশি যাদের সত্যিই প্রয়োজন আছে, তাদের খাদ্যের পরিমাণ বৃদ্ধিও করা যেতে পারে। আর এর জন্যই প্রয়োজন সঠিক সমীক্ষা। এটা নির্দিষ্ট করা কোনও শ্রেণির মানুষ, অর্থাৎ আর্থিক অবস্থানটা কী, সেটা নির্ণয় করে বিনামূল্যে খাদ্য বণ্টন করা, গণবণ্টন নয়।

একথা অবশ্যই বলতে হবে যে, এই সব অসাধু লেনদেনের কথা প্রশাসনের পক্ষে সবসময় জানা সম্ভব নয়। এ ধরনের তথ্য দিতে পারেন একেবারে নিম্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরা। এবার আসি লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ও সবুজসাথী সাইকেল এবং ট্যাব প্রসঙ্গে। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার নারী শক্তিকে করেছে অনেকটা মজবুত। একথা আমাদের জানা যে, কিছুটা অর্থ যদি মানুষের হাতে না তাকে, তবে কোনও মানুষের পক্ষেই আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগোনো সম্ভব নয়। আমাদের দেশের অধিকাংশ মেয়েদের জীবন সংগ্রামের সব চাইতে বড় বাধা অর্থ। ঠিক এই জায়গায় দাঁড়িয়ে রাজ্য সরকারের এই ভাবনা-লক্ষ্মীর ভাণ্ডার এক অসাধারণ পরিকল্পনা। ওই সামান্য অর্থই অতি সাধারণ মেয়েদের মধ্যে, বিশেষত গ্রামবাংলার মেয়েদের মধ্যে এনে দিয়েছে একটা আত্মবিশ্বাস। কিন্তু এখানেও কিছু প্রশ্ন উঠে আসে এই লক্ষ্মীর ভাণ্ডার সর্বস্তরের মেয়েদেরই কি প্রয়োজন? কেননা যে সমস্ত মহিলা পারিবারিক পেনশন পান, বা যে পরিবারের সার্বিক আর্থিক অবস্থা ভালো, যাদের এক পা এগোতে গেলে অর্থহীনতার সম্মুখীন হতে হয় না, তাঁদের জন্য লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রসারিত না হওয়াই শ্রেয়। এর জন্যই প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট কিছু নীতি-নির্দেশ, যা নির্বাচন করবে কাদের জন্য লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, অবশ্যই সর্বস্তরের মেয়েদের জন্য নয়। যার দ্বারা হয়তো আখেরে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে। নিরীক্ষাই বলে দেবে কারা অপ্রয়োজনীয়ভাবে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার গ্রহণ করছে।
এবার আসি সবুজসাথীর সাইকেল প্রসঙ্গে। প্রথম যখন চাকা আবিষ্কার হয়, তখনই যাত্রা শুরু হয় বিশ্ব মানবের ক্রম অগ্রগতি। ঠিক তেমনই প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীদের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেবার লক্ষ্যে এই ভাবনা ছাত্রছাত্রীদের হাতে বিনামূল্যে সাইকেল দেওয়ার। এখন গ্রামবাংলার রাস্তায় স্কুলের পোশাক পরা ছাত্রছাত্রীদের সবুজ সাথীর সাইকেলে চেপে স্কুলে যাচ্ছে দেখা যায়। শুধু তাই নয়, ওই সাইকেল স্কুলের অবসরে বহু কাজে লাগছে। কিন্তু শহরের রাস্তায় সবুজসাথীর সাইকেলের সেভাবে ব্যবহার দেখা যায় না।

এখানেই বলার কথা, সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের নয়, সাইকেল দেওয়া হোক তাদের, যাদের সত্যিই এর প্রয়োজন আছে। শহরাঞ্চলে এমনই সাইকেলের ব্যবহার কম। সুতরাং এখানেও প্রয়োজন কিছু বিধিব্যবস্থা, যা প্রতিহত করতে পারে সরকারি অর্থের অপচয়। কেননা অপ্রয়োজনীয় সাইকেলগুলি বিক্রি হয়ে যায়।

সর্বশেষে বলি, ‘ট্যাব’ নয়, যে বিপুল পরিমাণে অর্থ বাৎসরিকভাবে সরকারি কোষাগার থেকে ব্যয় হচ্ছে, সেই অর্থ ব্যয়িত হোক স্কুলগুলির পরিকাঠামো উন্নয়নে এবং স্কুল-বিমুখতা নয়, অন-লাইন নয়, এখন প্রয়োজন স্কুল প্রাঙ্গণে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি, ক্লাসে বসে শিক্ষা গ্রহণ, যা প্রতিহত করবে নাবালক ছাত্রচাত্রীদের বিপথে যাওয়ার প্রবণতা।
পরিকল্পনা করলেই হবে না, তার বাস্তবায়নের জন্য অবশ্যই প্রয়োজন যথাযথ নির্বাচন।